জন্মদিনে বব ডিলানের জানা-অজানা

বব ডিলান বিশ্বের অসংখ্য সংগীতশিল্পী ও মানবতাবাদীর প্রেরণার উৎস শিল্পী। তিনি একাধারে গীতিকার, সুরকার, গায়ক, সংগীত পরিচালক, চিত্রশিল্পী ও লেখক। শিল্পের এসব শাখার চর্চার মাধ্যমে বছরের পর বছর তিনি ফুটিয়েছেন মানবতাবাদ আর যুদ্ধবিরোধী চেতনার ফুল। ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’-এর মাধ্যমে পাশে দাঁড়িয়েছেন বাংলাদেশের মহান মুক্তিসংগ্রামে। আজ ২৪ মে বব ডিলানের ৮১তম জন্মবার্ষিকী। এই দিনে ছবি ও লেখায় আবার জেনে নিই তাঁর জীবনের জানা–অজানা কিছু কথা।

মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার পর অন্তরালে

১৯৬৬ সালটি ছিল কিংবদন্তি এই শিল্পীর জীবনে নানা দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। ওই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি শুরু করেন ওয়ার্ল্ড ট্যুর। বিভিন্ন দেশে ঘুরে ঘুরে কনসার্ট। ২৯ জুলাই শুক্রবার বিকেলে ব্যক্তিগত সহকারীর বাইকে চড়ে অ্যাকসিডেন্টের পর বেশ আঘাত পান তিনি। শুরুতে ঘটনাটি গোপন রাখা হয়েছিল।

বব ডিলান, তরুণ বয়সে

বব ডিলান ‘অশিষ্ট ও উদ্ধত’

২০১৬ সালে সাহিত্যে নোবেলজয়ী হিসেবে নাম ঘোষণার পর থেকে এ বিষয়ে পুরোপুরি নীরব থাকায় বিখ্যাত মার্কিন গীতিকার ও গায়ক বব ডিলানকে নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হয়েছিল। সেবার এই দলে যোগ দিয়েছেন খোদ সুইডিশ একাডেমির সদস্য ও লেখক পার ওয়াস্টবার্গ। নোবেলজয়ীর এই আচরণকে তিনি ‘শিষ্টাচারহীনতা ও ঔদ্ধত্য’ বলে অভিহিত করেছেন। সুইডেনের এসভিটি টেলিভিশনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সুইডেনের নোবেল কমিটির সদস্য পার ওয়াস্টবার্গ বলেন, ‘এটা অশিষ্ট ও ঔদ্ধত্য আচরণ’।

মূল্যবান শিল্পী হিসেবে গণ্য
ছয় দশকের ক্যারিয়ারে ডিলান ছয় শতাধিক গান করেছেন। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘ব্লোয়িং ইন দ্য উইন্ড’, ‘লাইক আ রোলিং স্টোন’, ‘মার্ডার মোস্ট ফাউল’-এর মতো কালজয়ী গান। ‘বিটলস’-এর পর এখন পর্যন্ত সংগীতে সবচেয়ে মূল্যবান শিল্পী হিসেবে গণ্য করা হয় নোবেলজয়ী বব ডিলানকে।

টাইম ম্যাগাজিনে প্রকাশিত ২০ শতকের ১০০ প্রভাবশালী ব্যক্তির তালিকায় বব ডিলানের নাম প্রকাশিত হয়। ২০০৪ সালে রোলিং স্টোন ম্যাগাজিনে প্রকাশিত সর্বকালের সেরা ১০০ গায়কের তালিকায় বব ডিলান ছিলেন দ্বিতীয় স্থানে।

২০১৬ সালে নোবেল পুরস্কারে বব ডিলানের নাম আসার পর বিশ্ববাসী চমকে ওঠে।

সে বছর ১৩ অক্টোবর বব ডিলানকে সাহিত্যে এবারের নোবেলজয়ী হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। তিনি এ ব্যাপারে তাঁর কোনো প্রতিক্রিয়া জানাননি। লাস ভেগাসে তাঁর একটি কনসার্ট ছিল। সবাই ধারণা করেছিলেন, ওই অনুষ্ঠানে তিনি হয়তো নোবেলপ্রাপ্তির অনুভূতি জানাবেন। তবে সবাইকে হতাশ হতে হয়েছে। কারণ, তিনি ওই কনসার্টে হাজির হয়ে নিজের মতো গান গেয়ে অনুষ্ঠানস্থল ত্যাগ করেছেন।

গানের সব ক্যাটালগ বেচে দিয়েছেন তিনি

গত বছরের ডিসেম্বরে নিজের গানের সমগ্র ক্যাটালগের স্বত্ব ইউনিভার্সাল মিউজিক গ্রুপের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন বব ডিলান। ভবিষ্যতে তাঁর গান থেকে যা আয় হবে, তার সবই পাবে ইউনিভার্সাল মিউজিক। ইউনিভার্সাল মিউজিক পাবলিশিং গ্রুপ ডিলানের সঙ্গে এ-সংক্রান্ত চুক্তির কথা প্রকাশ করেছে। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী জোডি গার্সন বলেন, ‘সংস্কৃতিতে তাঁর অবদানের কথা বলা বাহুল্য। তাঁর মতো শিল্পীর সংগীতকর্মের দায়িত্ব পাওয়া আমাদের জন্য পরম সৌভাগ্যের বিষয়।’ ডিলানের গানের স্বত্ব কত টাকার বিনিময়ে বিক্রি হয়েছে, তা জানানো হয়নি। তবে সূত্র জানিয়েছে এ অঙ্ক ৩০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি।

বব ডিলান
বব ডিলান ও মোহাম্মদ আলী

কেননা, ওই বছরই ছিল আরও অনেকগুলো কনসার্ট। কিন্তু আহত বব ডিলান সবগুলো কনসার্ট অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করে দিতে বলে নিজে চলে যান খণ্ডকালীন বিশ্রামে।১৯৭৪ সাল পর্যন্ত কোনো কনসার্টে অংশ নেননি তিনি।

বক্সিংয়ে বব ডিলান

একসময় ডিলান আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন বক্সিংয়ে। নিজেকে একবার তিনি বর্ণনা করেছিলেন একজন সার্কাসের দড়া বাজিকর হিসেবে।

সন্তানের সঙ্গে বব ডিলান। ছবি: সংগৃহীত

বব ডিলানের সংসার

১৯৬৫ সালের ২২ নভেম্বর বব ডিলান বিয়ে করেন সারা লাউন্ডসকে। ১৯৭৭ সালে তাঁদের বিচ্ছেদ হয়। তাঁদের রয়েছে চার সন্তান। জেসে বায়রন ডিলান, আন্না লিও, স্যামুয়েল আইজাক আব্রাম ও জ্যাকব ডিলান। ডিলানের পালিত সন্তান মারিয়া লাউন্ডস, যিনি মারিয়া ডিলান নামে পরিচিত।

বন্ধু পূর্ণদাস বাউলের ছেলের বিয়েতে ঝটিকা সফরে দক্ষিণ কলকাতার ঢাকুরিয়ায় যান তিনি

বিয়ের নিমন্ত্রণে কলকাতায়

১৯৯০ সালে ভারতের কলকাতায় গিয়েছিলেন বব ডিলান। বন্ধু পূর্ণদাস বাউলের ছেলের বিয়েতে ঝটিকা সফরে দক্ষিণ কলকাতার ঢাকুরিয়ায় যান তিনি। সেখানে তিনি ছিলেন মাত্র এক ঘণ্টা। এক সাক্ষাৎকারে সেদিনের স্মৃতিচারণা করে পূর্ণদাস বাউলের ছেলে দিব্যেন্দু বলেন, ‘বব ডিলান ঢাকুরিয়াতে আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন। সেখান থেকে আমার সঙ্গেই গিয়েছিলেন বালিগঞ্জ। অনুষ্ঠানে মাত্র এক ঘণ্টাই ছিলেন। হয়তো আরও কিছুটা সময় থাকতেন। তবে মিডিয়ার হুল্লোড়ে তিনি আর সময় কাটাননি।’

বব ডিলানের আসল নাম

সারা পৃথিবী তাঁকে বব ডিলান নামেই চেনেন। তবে এটি তাঁর আসল বা পরিবারের দেওয়া নাম নয়। তাঁর আসল নাম রবার্ট আলেন জিমারম্যান। ১৯৫৯ সালে মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন রবার্ট অ্যালেন জিবেরম্যান। সে সময় ডিনকিটাউন এলাকায় সলো পারফর্মার হিসেবে মঞ্চে ওঠেন। কিন্তু নিজের আসল নাম গোপন করে পরিবেশন করেন বব ডিলান নামে। অনেকের ধারণা, কবি ডিলান টমাসের নাম থেকে তিনি নিজের নতুন নামটা পছন্দ করেছিলেন।

বব ডিলান

বব ডিলান ও জোয়ান বায়েজ জুটি

৬০ দশকের শুরুতে জোয়ানের পরিচয় হয় বব ডিলানের সঙ্গে। তখন অবশ্য ডিলানের তারকাখ্যাতি ছিল না। একদিকে জোয়ান ‘লোকজ সংগীতের সম্রাজ্ঞী’ নামে পরিচিত, অন্যদিকে ডিলান এ জগতে নতুন। সংগীত জগতে বব ডিলান ও জোয়ান বায়েজ জুটি নানা কারণে ছিল আলোচিত।

বব ডিলান ও জোয়ান বায়েজ। একসময় তাঁদের মধ্যে ছিল রোমান্টিক সম্পর্ক

১৯৬০ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত দুজন একসঙ্গে বেশ কিছু সংগীতসফরে অংশ নেন। দুজন তখন একসঙ্গে তোলপাড় করেছেন আমেরিকা। সেখানে মঞ্চে, ক্যাফেতে শুধুই এই দুজনের নাম। তরুণদের মনে ঝড় তুলেছিল এই যুগল। সবার মুখে একই গল্প, বায়েজ আর বব ডিলানের ভালোবাসা।

কিন্তু সেই সম্পর্কের কথা তারা দুজনই প্রকাশ্যে স্বীকার করেননি। বরাবরই গানকে প্রতিবাদের ভাষা ও সমসাময়িক প্রসঙ্গ তুলে ধরার মাধ্যম হিসেবে ফুটিয়ে তুলতে জোয়ানকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিলেন বব ডিলান।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের তহবিল সংগ্রহের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে মেডিসন স্কয়ারে ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ অনুষ্ঠানে জর্জ হ্যারিসন, বব ডিলান ও লিওন রাসেল, ১ আগস্ট ১৯৭১। ছবি: সংগৃহীত

কনসার্ট ফর বাংলাদেশে বব ডিলান

জর্জ হ্যারিসন ও রবিশঙ্করের আহ্বানে কনসার্ট ফর বাংলাদেশ এ সাড়া দিয়েছিলেন বব ডিলান। কনসার্টে ডিলান একে একে গেয়েছিলেন পাঁচটি গান ‘আ হার্ড রেইনস আ-গনা ফল’, ‘ব্লোয়িং ইন দ্য উইন্ড’, ‘ইট টেকস আ লট টু লাফ’, ‘লাভ মাইনাস জিরো’ এবং ‘জাস্ট লাইক আ ‘ওম্যান’। ‘ব্লোয়িং ইন দ্য উইন্ড’–এর গুঞ্জন প্রতিবাদী করে তুলেছিল সারা পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষকে।

নিউইয়র্কের একটি ক্যাফেতে গান গাইছেন বব ডিলান, ১৯৬২

বাদক হিসেবে তাঁর প্রথম আয়

বব ডিলানের প্রথম পেশাদার রেকর্ডিং হয় ১৯৬০ সালে। না, গায়ক নন, হ্যারি বেলাফন্টির অ্যালবামে তিনি হারমোনিকা বাদক হিসেবে কাজ করেছিলেন। প্রথম কাজের জন্য পেয়েছিলেন ৫০ ডলার।