তারা ভরা রাতে তোমার কথা মনে পড়ে

সময়টা ২০০০ সালের শুরুর দিকে। কলকাতার তাজ বেঙ্গল হোটেলে গিয়েছিলাম মেহেদী হাসানের ইন্টারভিউ করতে। গিয়ে শুনলাম, তিনি সকালে কলকাতা ছেড়ে চলে গেছেন। মনটা খারাপ হয়ে গেল। আরও একজনকে দেখলাম হোটেলের রিসেপশনে মন খারাপ করে বসে আছেন। তিনি বাপ্পী লাহিড়ী। কাছে গিয়ে পরিচয় দিলাম। মন খারাপের কথাও বললাম। ভদ্রলোক বললেন, ‘আপনার যে কারণে মন খারাপ, একই কারণে আমারও।’
কিছুটা কৌতুক করে বাপ্পী লাহিড়ী বললেন, ‘মন আমার বেশি খারাপ, নাকি আপনার?’ আমি বললাম, ‘আমার।’ তিনি বললেন, ‘তাহলে আমার একটা ইন্টারভিউ করেন, আপনার মন ভালো হয়ে যাবে।’
রাজি হলাম। আমার প্রথম প্রশ্ন ছিল—ইদানীং কলকাতাতে বেশি সময় কাটাচ্ছেন। বলিউডের কাজ কি কমিয়ে দিয়েছেন?’
বিরক্ত হলেন বাপ্পী। বললেন, ‘শুরুর প্রশ্নটা কি কখনো এমন হয়? শুরুতে আপনার প্রশ্ন করা উচিত ছিল আমি কার ছেলে, কবে আমার জন্ম, ইতিহাসে আমার কোনো জায়গা আছে কি না...।’ আমি বললাম, ‘আপনি কার ছেলে তা জানি। আপনার বাবা অপরেশ লাহিড়ী, মা বাঁশরী লাহিড়ী।’
শুনে বেশ তৃপ্তি সহকারে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনি কি জানেন, আমি মুক্তিযুদ্ধের সময় একটি ঐতিহাসিক গান বানিয়েছিলেন।’ এবার আমার অবস্থা তর্কে হেরে জব্দ হওয়ার মতো। বললাম, ‘না।’
এবার একটু নড়েচড়ে বসে বললেন, ‘সো, আপনার প্রথম প্রশ্ন কী হবে, সেটা আমিই বলে দিচ্ছি। আমাকে প্রশ্ন করবেন, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় আপনি কি বিশেষ কোনো ভূমিকা রেখেছিলেন?’
তার কথামতো আমি প্রশ্ন করলাম। বাপ্পী বললেন, ‘হাজার বছর পরে আবার এসেছি ফিরে বাংলার বুকে আছি দাঁড়িয়ে’ গানটা শুনেছেন? ওটা আমার সুর করা। লিখেছিলেন শ্যামল গুপ্ত। শ্যামল গুপ্তকে চেনেন?’
বললাম, ‘উনি একজন গীতিকার।’
‘গীতিকার, সে তো সবাই জানে। আসলে আপনি কিছুই জানেন না। তিনি আমাদের সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের স্বামী। মস্তবড় গীতিকার’—বলে আমাকে আরেক দফা জ্ঞান দিলেন বাপ্পী লাহিড়ী। এবার বললেন, ‘গানটা কে গেয়েছিল, সেটা জানেন তো?’
বললাম, ‘আবদুল জব্বার।’
বাপ্পী বললেন, ‘আহ হা...কী যে কণ্ঠ। কোথাও বাজছে শুনলে আমি এখনো কান পেতে থাকি। আচ্ছা বলুন তো, জব্বার ভাই কেমন আছেন?’
বললাম, ‘এখন গান তেমন একটা করেন না। শরীরটাও ভালো আছে বলে মনে হয় না।’
হতাশ হওয়ার ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বাপ্পী লাহিড়ী বললেন, ‘শুনেছি লোকটা নিজের ওপর অবিচার করে। “ওরে নীল দরিয়া” গানটি এত সুন্দর করে গেয়েছে, আমি মুগ্ধ। এ গান এত সুন্দর করে আর কেউ গাইতে পারবে না। “তুমি কি দেখেছো কভু” আরেকটা অসাধারণ গান। “তারা ভরা রাতে’ শুনলে মনে হয় তালাত মাহমুদ গাইছেন। আমি লোকটাকে অনেকবার বলেছি কলকাতায় আসতে। পাত্তাই দেয়নি। কণ্ঠটা ধরে রাখতে পারলে এখনো কাজ করা যেত।’
আবদুল জব্বারের মৃত্যুসংবাদ শোনার পর আমার কল্পনায় ১৭ বছর আগের সেই দৃশ্যটা ভেসে ওঠে। এত দিন বুঝিনি। আজ মনে হচ্ছে, বাপ্পী লাহিড়ী আমাকে অতুলনীয় একটি সময় উপহার দিয়েছিলেন।
আরও একটি ঘটনা মনে পড়ে। আনোয়ার পারভেজের ইন্টারভিউ করতে গিয়েছিলাম। তিনি শোনালেন ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ গানের ইতিহাস। জানলাম, আনোয়ার পারভেজ আর গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার রিকশায় ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। বিস্ময়কর হলো, রিকশায় বসেই গাজী সাহেব ‘জয় হিন্দ’-এর আদলে লিখে ফেললেন ‘জয়বাংলা’ এবং সঙ্গে সঙ্গে আলম খান সুরও দিয়ে দিলেন। গানটি পরে ‘জয় বাংলা’ সিনেমায় ব্যবহার হয়েছিল। তারপরে রাত-দিন বেজেছে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে।
আবদুল জব্বারের আরও একটি কালজয়ী গান ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’। গানটির সুরকার তিনি নিজেই। গীতিকার ফজল-এ-খোদা। এই গান সম্পর্কে আবদুল জব্বার বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমকে বলেছেন, গানটি তৈরি হওয়ার পর তা প্রচারের উপযুক্ত সময় পাচ্ছিলেন না। প্রায় দুই বছর পর ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ সেই সুযোগ করে দেয়। এই গান গাইতে গাইতে সেদিন তাঁরা রেসকোর্স ময়দানে হাজির হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ শুনতে।
সুরকার আলম খানের কাছে গোল্ডেন ভয়েজ হলো আবদুল জব্বারের কণ্ঠ। প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘ওরে নীল দরিয়া’ গানটির অস্থায়ী সুর ১৯৬৯ সালে করা। ১৯৭৪-৭৫ সালের দিকে আবদুল্লাহ আল-মামুন (প্রয়াত) তাঁর ‘সারেং বৌ’ ছবির সুর করার জন্য আলম খানের কাছে যান। আবদুল্লাহ আল মামুন বলেছিলেন, ছবির সিকোয়েন্সে দেখা যাবে, সারেং গান গাইতে গাইতে বাড়ি ফিরছেন—এই বিষয়টিকে মাথায় নিয়ে সুর করতে হবে। আলম খান বুঝতে পারেন, ছয় বছর আগে করা সুরটি এবার কাজে লাগবে। এরপর আলম খান গানটি লেখার দায়িত্ব দেন গীতিকার মুকুল চৌধুরীকে।
‘ওরে নীল দরিয়া’ গানের সঙ্গে ঠোঁট মিলিয়েছিলেন নায়ক ফারুক। জব্বারের মৃত্যুসংবাদ শোনার পর প্রতিক্রিয়া জানিয়ে ফারুক বলেন, ‘শুরুতে গানটি শোনার পর পাত্তাই দিইনি। কিন্তু যখন ফাইনাল টেক হলো, তখন গানটি শোনার পর আমার ভেতরটা দুমড়ে-মুচড়ে গেল। একটি গানে এতটা দরদ ঢেলে দেওয়া চাট্টিখানি কথা নয়।
আবদুল জব্বার এ দেশের গণমানুষের হৃদয়ে কতটা স্থান নিয়ে আছেন, সেটা বিবিসির জরিপেও প্রকাশ পেয়েছে। সর্বকালের সেরা ২০টি বাংলা গানের মধ্যে তিনটিই তাঁর। গানগুলো হলো ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’, ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ এবং ‘তুমি কি দেখেছ কভু’।
বছর পনেরো আগে কোনো আড্ডার টেবিলে আমার সঙ্গে কথা হচ্ছিল আবদুল জব্বারের। প্রসঙ্গ বঙ্গবন্ধু। জব্বার বললেন, ‘বঙ্গবন্ধু কখনো “পাগল” কখনো “গান পাগল” বলে ডাকতেন। আমাদের সম্পর্ক ছিল পিতা-পুত্রের মতো। তাঁর যখন ইচ্ছে হতো ব্যক্তিগত সহকারীকে দিয়ে ডেকে পাঠাতেন। বলতেন, পাগলা গান শোনা। শুনে বাহবা দিতেন।’
আবদুল জব্বারের কাছ থেকেই জেনেছি, তাঁকে ঢাকায় নিয়ে আসেন কবি আজিজুর রহমান। তিনি তখন ঢাকা বেতারে চাকরি করতেন। শিল্পীর গাওয়া ‘তারা ভরা রাতে তোমার কথা মনে পড়ে বেদনায়’ গানটি এই আজিজুর রহমানেরই লেখা। সুর করেছিলেন মোসলেহ উদ্দিন। যে গানে কিনা বাপ্পী লাহিড়ী আবদুল জব্বারের কণ্ঠে তালাত মাহমুদের স্বর খুঁজে পেয়েছিলেন। শিল্পীর প্রয়াণের পর এটা ধরে নেওয়া যায়, লাখো লাখো ভক্ত-শ্রোতা তারা ভরা রাতে আবদুল জব্বারকেই স্মরণ করবেন।