২০১৬: দুঃখের নয় সুখের গান

কণা
কণা

২০১৬ ছিল সংগীত অঙ্গনের জন্য বাঁকবদলের বছর। বিগত বছরগুলোর জেঁকে বসা প্রযুক্তি পরিবর্তনের ধাক্কা, সীমাহীন পাইরেসি, স্রোতের মতো সস্তা কথার সরব উপস্থিতি, নকল সুরে একের পর এক গানের প্রাদুর্ভাব অটো টিউন আর ভোকর্ড মেশানো কৃত্রিম কণ্ঠ আর একঘেয়ে মিউজিক কম্পোজিশনের হতাশার দীর্ঘশ্বাস কাটিয়ে উঠতে বছরজুড়েই সব মহল থেকে আমরা লক্ষ করেছি অনেকগুলো উদ্যোগ। তাই পরিবর্তন আর রূপান্তর ছিল এ বছরের মূল প্রাপ্তি।
অডিও থেকে গানের ভিডিও
চলচ্চিত্রের গানের বাইরে অডিও গান কেবলই শোনার বিষয় ছিল। ভিডিওনির্ভর গানের জয়যাত্রা ঘটেছে এ বছরেই। পরিচ্ছন্ন ও মানসম্পন্ন মিউজিক ভিডিওর কল্যাণে বিশ্বদরবারে বাংলা গান জানান দিয়েছে নিজেদের শক্তি ও সামর্থ্যও। ২০১৫ সালের ইমরানের ‘বলতে বলতে’ গানটি এ বছরই প্রথমবারের মতো এক কোটির বেশি মানুষ দেখেছে। এ খবরটি বাংলা গানের জন্য দারুণ সুবাতাস। মাত্র ছয় মাস আগে মুক্তি পাওয়া মিনারের ‘ঝুম’ গানটি এখন ৮০ লাখ ছুঁই ছুঁই করছে। মমতাজ-প্রীতমের ‘লোকাল বাস’, কনার ‘রেশমি চুড়ি’, শাওন গানওয়ালার ‘ইচ্ছে মানুষ’, হাবিবের ‘মন ঘুমায় রে’, বাপ্পা মজুমদারের ‘জানালার গ্লাস’, প্রিন্স মাহমুদের সুরে তাহসানের ‘ছিপ নৌকা’, ইমরানেরই আরেক গান ‘ফিরে এসো না,’ মুনের ‘তুই আমার মন ভালো রে’, ন্যান্‌সির ‘আমি ছুঁয়ে দিলেই’, অদিতের ‘মন দরিয়া’, ‘জ্যোৎস্না’, ‘উড়ে যাই’, ‘তুমিময়’, প্রীতম হাসানের ‘আসো মামা হে’, তানজীবের ‘মেয়ে তুই মিথ্যা শিখাইলি’সহ আরও বেশ কিছু গান ভিডিওর কল্যাণে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে যায়। এসব ভিডিও নির্মাণের কল্যাণে পরিচালক হিসেবে আলোচনাও এসেছেন তানিম রহমান, শাহরিয়ার পলক, চন্দন চৌধুরী, শুভব্রত সরকার, ইমরান কবির।

হাবিব
হাবিব

দুঃখের গান ছাপিয়ে সুখের গানে আগ্রহ
সাধারণত এ দেশে শ্রোতারা অধিকাংশ সময় দুঃখের গান বেশি পছন্দ করতেন। কিন্তু এ বছরের চিত্র পুরোটাই উল্টো। ইমরানের ‘তুই চলে যাবি’, ‘সবাই চলে যাবে’, সালমার ‘তুমি আসবা নাকি’-এর মতো অনেক মানসম্পন্ন গানও শ্রোতাদের পছন্দের শীর্ষে যেতে পারেনি। তবে এ বছর মেলোডিনির্ভর সুখের গানের জনপ্রিয়তা ছিল। এ ক্ষেত্রে হাবিব-তাহসানদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে আসেন ইমরান, মিনার ও শাওন গানওয়ালার মতো মেধাবী তরুণেরা। মেয়েদের মধ্যে নিজেদের মেলোডি গান নিয়ে সরব থাকেন ন্যান্‌সি ও কনা। এ ছাড়া বেশ কিছু ড্যান্স মুডের গান এ বছর নতুন ধারা তৈরি করে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। বছরের শেষে এসে তারকাবহুল প্রীতম প্রতীকের ‘বেয়াইনসাব’ গানটি নিয়ে আলোচনা চলে প্রচুর। এ বছর মূলধারার বেশ কজন শিল্পী যাত্রা শুরু করেন নিরীক্ষাধর্মী ইলেকট্রনিকস ড্যান্স মিউজিকেরও।

ন্যান্‌সি
ন্যান্‌সি

বাউলদের নিয়ে ফিউশন ও হিপহপ
এ ধারার শুরুটা হয় বছরের প্রথমেই। বাউল কুদ্দুস বয়াতিকে সঙ্গে নিয়ে তরুণ প্রীতম হাসান আসেন ‘আসো মামা হে’ গান নিয়ে। গানটি ব্যাপক আলোচনায় আসে। এরপর আসে মমতাজ ও প্রীতমের ‘লোকাল বাস’। গানবাংলা ও চ্যানেল নাইন লোকজ ও আধুনিকের সমন্বয়ে পৃথক পৃথক আয়োজনে সবার দৃষ্টি কেড়ে বছরব্যাপী প্রচার করতে থাকে ‘উইন্ড অব চেঞ্জ’ আর ‘ফিউশন লাউঞ্জ’। দুটি আয়োজনই বেশ জনপ্রিয় হয়।
নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের উত্থান
অনেক নতুনের আগমন ঘটে এ বছর। তবে প্রীতম হাসান ও শাওন গানওয়ালার অভিষেক হয় রাজকীয় কায়দায়। ঊর্ধ্বমুখী ভিউ আর সাধারণ শ্রোতাদের কাছেও সমান জনপ্রিয় হয় তাঁদের গানগুলো। এ ছাড়া আলোচনায় আসে বাম্মি, শাহতাজ, আবদুল্লাহ, তৌফিকসহ অন্য তরুণ শিল্পীরা।

ইমরান
ইমরান

বছরের আলোচিত কয়েকজন
গায়কদের মধ্যে মমতাজ, হাবিব, তাহসান, মিনার, ইমরান ছিলেন বছরজুড়ে আলোচনায়। দারুণ সব সুর আর কম্পোজিশনে সরব ছিলেন হাবিব, প্রিন্স মাহমুদ, বাপ্পা, তাহসান, অদিত, মুন, মিনার, ইমরান, বেলাল, প্রীতম ও সাজিদ সরকার। গীতিকবিদের মধ্যে এ বছর প্রিন্স মাহমুদ আলোচিত গান ‘ছিপ নৌকা’ দিয়ে তাঁর ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছেন।
সিডি থেকে ডিজিটাল—আশা থেকে হতাশা
২০১৫ পর্যন্তও মানুষের আগ্রহ ছিল সিডি থেকে গান শোনার। কিন্তু ক্যাসেটের মতোই সিডি জনপ্রিয়তা হারায় ডিজিটালি গান শোনার নতুন ধারার কাছে। পুরো পৃথিবীকে অনুসরণ করে বাংলাদেশের সংগীত উদ্যোক্তারাও ঝুঁকেছেন মোবাইল অ্যাপস ও অন্তর্জালনির্ভর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও ইউটিউবে। কিন্তু এই দুটি মাধ্যমে গানের প্রচার যথেষ্ট হলেও আয়ের পরিমাণ থেকে গেছে নগণ্যই। ফলে ব্যবসা হিসেবে এই মাধ্যমকে এখনো অলাভজনক হিসেবেই দেখা হচ্ছে। নতুন মোবাইল অ্যাপসগুলো নতুন উপায়ে মানুষকে বাংলা গান শোনানোর জন্য সক্রিয় ছিল বছরজুড়েই। তবে শ্রোতা অভিজ্ঞতা বিশ্বমানের না হওয়ায় শেষ ভাগে এসে বোঝা যাচ্ছে এদের এগোতে হলে প্রযুক্তি উন্নয়নে আরও বেশি বিনিয়োগে মনোযোগী হতে হবে। অন্যদিকে তৃণমূলে গান শোনার সবচেয়ে আকর্ষণীয় উপায় মোবাইল রেডিও ও ওয়াপের ক্ষেত্রে বছরের শেষদিকে ডাবল কনফারমেশনসহ বিটিআরসির নতুন বিধিনিষেধ, কনটেন্ট প্রোভাইডারদের ব্যাপারে নানান অসংগতির অভিযোগে মোবাইল অপারেটরদের এ সার্ভিসে অনাগ্রহ ও বহুদিনের গড়ে তোলা ডেটাবেইস ফেলে দেওয়া পুরো গানের জগৎকেই অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিয়েছে। যা মারাত্মক প্রভাব ফেলে উপার্জনের বড় উৎস সিআরবিটির ক্ষেত্রেও। একদিকে এফএম রেডিওর বিরামহীন বিনা মূল্যে গান প্রচার, উন্নত দেশের মতো লাইভ শো থেকে কণ্ঠশিল্পীদের একক উপার্জনে গানের রচয়িতাদের ভাগ দেওয়ার বিধান না থাকা আর অন্যদিকে ডিজিটাল রূপান্তরের চ্যালেঞ্জ সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, বিটিআরসি, মোবাইল অপারেটর আর গান-সংশ্লিষ্ট সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সমাধান না করলে আবার হয়তো সম্ভাবনাময় গানের বাজার তার পথ হারাবে হতাশার চোরা গলিতে।

মিনার
মিনার

গানের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্রিয় ভূমিকা
সিডি চয়েস, সিএমভি, ঈগল মিউজিকসহ বেশ কিছু অডিও প্রতিষ্ঠান নতুন নতুন গান তৈরি এবং প্রচার-প্রসারে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে এ বছর। আলোচনায় ছিল আমাদের গানচিল মিউজিকও। নতুন করে যাত্রা শুরুর পর এ বছরে ২.৫ কোটি ভিউ হয়েছে গানচিলের নানান মিউজিক ভিডিও, সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮৬,৫৫৩। সিডি চয়েস, ঈগল মিউজিক ও সিএমভিও ব্যাপক সরব ছিল অন্যান্য বছরের তুলনায়। সাউন্ডটেক ও সংগীতার নতুন করে ফিরে আসাটাও একটা ইতিবাচক আলোচনা ছিল এ বছরে। এ বছর ভালো গান উপহার দেওয়ার জন্য এত বছর গান বাঁচিয়ে রাখা দুটি প্রতিষ্ঠান জি সিরিজ আর লেজার ভিশন থেকে আমাদের প্রত্যাশা ছিল আরও বেশি।
সংগীতাঙ্গনের একতাবদ্ধ হয়ে কাজ করা
প্রখ্যাত শিল্পী ও সুরকার লাকী আখান্দ্‌, স্বীকৃতিসহ অন্য শিল্পীদের অসুস্থতার সময় সংগীতাঙ্গনের প্রায় সবাই এক হয়ে কাজ করেছেন। শিল্পীদের পাশে দাঁড়ানোর কাজে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হকের প্রচেষ্টাকে স্বাগত জানিয়েছেন সবাই।

সব মিলিয়ে অনেক প্রত্যাশা-প্রাপ্তির বছর হলেও ২০১৬ সালে মিউজিক আয়োজনে এখনো দুর্বলতা রয়ে গেছে। বিশ্ব মানের মিউজিক করতে এখনই প্রস্তুত হওয়া দরকার। কারণ, কিছুদিন আগেও আকাশ সংস্কৃতির প্রভাবে অন্য দেশের গানেই অধিক মনোযোগী ছিল তারা। এবার চিত্রটা ভিন্ন। শ্রোতারা ভালো বাংলা গান হলেই লুফে নেয়। মোদ্দা কথা হচ্ছে, বাংলা গানকে বিশ্বের মানুষের কাছে পৌঁছাতে হলে প্রয়োজন সবাই মিলে সততার সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী ও মতৈক্যে পৌঁছানো। আশা করা যাচ্ছে, ২০১৭ তথা নতুন বছর বাংলা গান বিশ্বদরবারে দাঁড়াবে মাথা উঁচু করেই।

লেখক: গীতিকবি, ই-মেইল: [email protected]