ফেসবুক লাইভ নয়, কনসার্ট

২৫ নভেম্বর সন্ধ্যায় রাজধানীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র–শিক্ষক কেন্দ্রের অডিটরিয়ামে এক ছাদের নিচে মিলিত হলো সোনার বাংলা

‘ভাই, কিছু বলেন’। দুটো গানের ফাঁকে ‘সোনার বাংলা সার্কাস’–এর ভোকাল প্রবর রিপনের কাছ থেকে কিছু শোনার জন্য মুখিয়ে ছিলেন ভক্তরা। ‘এটা কোনো ফেসবুক লাইভ নয়।’ ১৯ মাস পর ‘হায়েনা এক্সপ্রেস’ অ্যালবাম মুক্তির কনসার্টে এভাবেই ভক্তদের আশ্বস্ত আর নিশ্চিত করলেন এই শিল্পী। কেননা, এর আগে এই অ্যালবাম নিয়ে যত আয়োজন হয়েছে, সেখানে এই ব্যান্ডের সঙ্গে ভক্তদের সবার দেখা হয়েছে ভার্চ্যুয়াল দুনিয়ায়।
এই প্রথম ২৫ নভেম্বর সন্ধ্যায় রাজধানীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র–শিক্ষক কেন্দ্রের অডিটরিয়ামে এক ছাদের নিচে মিলিত হলো সোনার বাংলা। ‘আমরা কোনো করপোরেট স্পনসর ছাড়া এ রকম একটি শোর সফল আয়োজন করতে পেরেছি। এর কৃতিত্ব প্রথমত আমাদের, তারপর আপনাদের। যাঁরা টিকিট কেটে আমার গান শুনতে এসেছেন, আপনারা প্রত্যেকে এ শোর স্পনসর। যাঁরা ঢাকার বাইরে থেকে এসেছেন, তাঁদের জন্য আমার বিশেষ ভালোবাসা।’  

কনসার্ট শুরু হওয়ার কথা ছিল সাতটায়, শুরু হলো প্রায় ৪০ মিনিট পর। আগেই হলরুম ভরা ছিল। গিটার, ড্রাম, কি–বোর্ড বাজতে শুরু করলে ঘরটা যেন গমগম করতে শুরু করল।

‘মৃত্যু উৎপাদন কারখানা’ গানটার বেলায় দর্শক–শ্রোতাদের বাঁধ ভাঙল

‘হায়েনা এক্সপ্রেস’–এর ‘এক্সপেরিয়েন্স’ নিতে ভক্তরা যেন প্রস্তুত হয়েই এসেছেন। বিধিনিষেধের সময়টা বোধ হয় কাজে লাগিয়েছেন তাঁরা। সবার সব লিরিক মুখস্থ! কী ‘এপিটাফ’, কী ‘অন্ধ দেয়াল’ বা ‘আমার নাম অসুখ’—স্টেজ থেকে আসা গান পথ হারিয়েছে দর্শক–শ্রোতার সারিতে। ভক্তরা গাইল, প্রবর রিপন তাতে গলা মেলালেন—এমনটা বললেও বাড়াবাড়ি হবে না। কেননা, এমনও হয়েছে যে রিপন লিরিক ভুলে স্মৃতি হাতড়াচ্ছেন, কিন্তু দর্শকেরা ভোলেননি। তাঁরা ঠিকই গানটা এগিয়ে নিয়ে গেছেন। ‘মৃত্যু উৎপাদন কারখানা’ গানটার বেলায় দর্শক–শ্রোতাদের বাঁধ ভাঙল। রিপনের জীবনসঙ্গী তানহা জাফরিন এদিন কেবলই এক সাধারণ ভক্ত।

তাঁর নেতৃত্বে একদল হইরই করে সামনে গিয়ে রিপনের থেকে গান কেড়ে নিয়ে গাইতে শুরু করলেন,
‘প্রতিটি মৃত্যুর সাথে
প্রতিটি লাশের সাথে
বিনা মূল্যে দিয়েছি একটি করে গোলাপ
পরিহাসের বিষয় হলো
সেই গোলাপের রংটিও লাল!
তোমার শিশুর হাসির মতো লাল!
তোমার প্রেমিকার কপালের টিপের মতো লাল!
তোমার শরীরে বয়ে চলা রক্তের মতো লাল!
আমরা মৃত্যু উৎপাদন করি।’
কেন ভক্তদের এসব গানের লিরিক মুখস্থ? এর উত্তর খুঁজতে গেলাম ‘সোনার বাংলা সার্কাস’–এর ইউটিউব চ্যানেলে। সেখানে একজন তো লিখেছেন, অসহ্য ২০২০ সালকে নাকি এই গানের দলের গানগুলো সহনীয় করে তুলেছে। মহামারিকালে অনেক হতাশার ভেতর এই ব্যান্ডের গানগুলো নাকি বাংলা গানের দলের ভক্তদের সবচেয়ে বড় পাওয়া। অনেকে এসব গানের নিচে মন্তব্য করেছেন, একেকজন একেকটি গান টানা দু–তিন দিন ধরে শুনেছেন। তবু নাকি ‘মাথা থেকে নামছে না।’

রিপন কথা দিলেন, এই কনসার্ট তিনি সারা দেশে নিয়ে যাবেন।

এর কারণ কী? কনসার্টে উপস্থিত জীবন মালাকার যা বললেন, তাতে হয়তো এ প্রশ্নের খানিকটা উত্তর মিলবে। তিনি বললেন, ‘এই অ্যালবামটাই অন্য রকম। ধরুন, এখানে একজন শ্রোতা “হায়েনা এক্সপ্রেস”–এ উঠল। এই গাড়িটি তাকে জন্ম থেকে মৃত্যু হায়েনার মতো এগিয়ে চলা পর্যন্ত মানবসভ্যতার নানা বাঁক ঘুরিয়ে আনল।

একবার গানটা শেষ হয়ে গেলে মাথার ভেতর অটোপ্লে হতে থাকে। ফলে কয়েকবার না শোনা পর্যন্ত উপায় থাকে না।’ এত দর্শক হওয়ার কারণও বললেন তিনি। জানালেন, তাঁর মনে হয়, দর্শকদের একটা বড় অংশ যতটা না সোনার বাংলা সার্কাসের, তার চেয়ে বেশি প্রবর রিপনের ভক্ত।

দর্শকসংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে আয়োজকদের কল্পনাকেও। তাই তো রিপন বললেন, ‘আমি কী বলব, বুঝতে পারছি না। আপনারা প্রমাণ করলেন, ফেসবুক সত্য কথাও বলে। অনলাইনে আপনাদের যে ভালোবাসা দেখি, তা বাস্তব। সত্যি বলতে কী, দর্শক দেখে আমি তব্দা খেয়ে গেছি। আমরা কেউ ভাবিনি, আপনারা এভাবে সাড়া দেবেন।’ এরপর নিজেই যোগ করলেন, ‘তাই বলে ভাববেন না, আমি আপনাদের জন্য গাই। আমি নিজের জন্য গাই। আমার গাইতে ভালো লাগে, তাই গাই।’

কনসার্টের ফাঁকে ফাঁকে দর্শকসারিতেই চলেছে সার্কাস দলের দুটো ছোট প্রদর্শনী। গানের সঙ্গে সঙ্গে পেছনে প্রজেক্টরে চলেছে মানানসই সব দৃশ্য ছবি। কনসার্টের শেষ দিকে এই গানের দলের ভোকাল ও গিটারিস্ট প্রবর রিপন একে একে নিয়েছেন পাণ্ডুরাঙ্গা ব্লুমবার্গ (গিটারিস্ট), এনামুল হাসান (ড্রামার), শাকিল হক (বেজ গিটার) ও সাদ চৌধুরী (কি-বোর্ড) আর সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ারদের নাম। প্রতিটি নামের সঙ্গে করতালিতে ফেটে পড়েছে দর্শক। রিপন কথা দিলেন, এই কনসার্ট তিনি সারা দেশে নিয়ে যাবেন।

‘হায়েনা এক্সপ্রেস’–এর ‘এক্সপেরিয়েন্স’ নিতে ভক্তরা যেন প্রস্তুত হয়েই এসেছেন।

সোনার বাংলা সার্কাসের সেই প্যাভিলিয়নের পেছন আনন্দ করতে করতে দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ শহরে যাবে ভক্তরাও। কনসার্ট শেষে ভিড় জমল হলরুমের বাইরের প্যাভিলিয়নে। সেখানে বিক্রি হচ্ছে এই অ্যালবাম, অ্যালবামের নাম, গানের লিরিক লেখা গলার লকেট, চাবির রিং, পোস্টার, টি–শার্টসহ নানা কিছু। যদিও কনসার্টের শুরুতে সেখানে তেমন ভিড় দেখা যায়নি। মনে হলো কনসার্টটা দর্শক–শ্রোতাদের ভালো লেগেছে বলেই তারা এসব স্যুভেনির সংগ্রহ করছে। কনসার্ট শেষ হয়েও যেন শেষ হলো না। আধঘণ্টা পর ভক্তদের সঙ্গে আড্ডায় বসলেন এই গানের দল। হাসিমুখে সেলফি শিকারিদের কবলে পড়ে পোজ দিয়েছেন তাঁরা। দিন শেষে রাতটি হয়ে থাকল এই ব্যান্ড আর তাঁর ভক্তদের জন্য একটা আনন্দের স্মৃতি।