মাহমুদুজ্জামান বাবুর কণ্ঠে চে আর নুসরাত

প্রথম আলো কার্যালয়ে গান শোনালেন মাহমুদুজ্জামান বাবু
প্রথম আলো কার্যালয়ে গান শোনালেন মাহমুদুজ্জামান বাবু

‘ঘুরে না দাঁড়ালে, সত্য উচ্চারণ না করতে পারলে, প্রতিবাদ-প্রতিরোধ না চিনলে, নতুন মানবিক পৃথিবী নির্মাণের স্বপ্ন না দেখলে, আমাদের হৃদয় হবে শকুন ও শেয়ালের খাদ্য।’ কথাগুলো মাহমুদুজ্জামান বাবুর। ছাত্ররাজনীতি ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন থেকেই তাঁর গানের সঙ্গে জড়িয়ে পড়া। আর তারপর থেকে গানই তাঁর সকাল-সন্ধ্যার সঙ্গী, গানই তাঁর অস্ত্র, গানই তাঁর প্রেমিকা। তিনি বিপ্লবী। তিনি গান গেয়ে বিপ্লব করেন।

রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে আজ শনিবার বিকেলে বসেছিল তাঁর গানের আসর। ঢাকা শহরের সময়জ্ঞান বলে কিচ্ছু নেই। সামান্য বৃষ্টিতেই সে স্থবির হয়ে পড়ে। আর শিল্পসুদ্ধ সেই স্থবিরতায় আটকা পড়েছিলেন সংগীতশিল্পী মাহমুদুজ্জামান বাবু। পথে প্রায় ঘণ্টাখানেক আটকে থাকার পর অবশেষে প্রথম আলো দেখা পেল তাঁর। প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান পরিচয় করিয়ে দিলেন এভাবে, ‘সরাসরি যাঁরা যুদ্ধক্ষেত্রে লড়ছেন, বাবু তাঁদেরই একজন।’

সেই যোদ্ধা গানের আসর শুরু করলেন আরেকজন যোদ্ধাকে দিয়ে। সেই যোদ্ধার নাম ‘নুসরাত’। নুসরাত জাহান রাফি। সারা গায়ে জ্বলন্ত আগুনের যন্ত্রণা নিয়ে যে বলেছিল, ‘আমি সারা বাংলাদেশের কাছে বলব, সারা পৃথিবীর কাছে বলব, এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করবার জন্য।’ যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুর আগে নুসরাতের সেই প্রতিবাদী স্বর ছুঁয়ে যায় এই শিল্পীকে। তাই নুসরাতকে নিয়ে তিনি গান বেঁধেছেন। সুর দিয়ে সেই শব্দমালাকে করেছেন গান।

দ্বিতীয় যে গানটি বাবু গাইলেন, সেটা শৈশব নিয়ে। নিজের অসাম্প্রদায়িক শৈশবের রঙিন দিনগুলোতে ফিরে গিয়ে গানটি লিখেছেন, সুর দিয়েছেন তিনি। সেই শৈশব, যেখানে আছে পুতুলের বিয়ে আর লাল–নীল ফুটবল। যেখানে মা মাখা ভাতের থালা হাতে তাঁর খোকাকে ডাকেন।

পরের গানটি নাকি মাহমুদুজ্জামান বাবুর সমস্ত আশ্রয়ের আধার। সমস্ত নৈরাজ্য থেকে ছুটে পালিয়ে তিনি আশ্রয় নেন এই গানের কাছে। গানটির নাম ‘ভোর হয়নি’। এই গানে সবকিছুর ঊর্ধ্বে গাওয়া হয়েছে আশার কথা। প্যান্ডোরার বাক্সতে যে আশা ছিল বলেই মানুষ আজও স্বপ্ন দেখে, ভোর আসবে। গানটির প্রথম দুই লাইন এ রকম, ‘ভোর হয়নি, আজ হলো না, কাল হবে কি না, তা–ও জানা নেই। পরশু ভোর ঠিক আসবেই, এই আশাবাদ তুমি ভুলো না।’

প্রথম আলো কার্যালয়ে গান শোনালেন মাহমুদুজ্জামান বাবু
প্রথম আলো কার্যালয়ে গান শোনালেন মাহমুদুজ্জামান বাবু

এরপরের গানটি তাঁর নতুন অ্যালবাম থেকে নেওয়া। অ্যালবামটি এখনো আলোর মুখ দেখেনি। ‘ভয় নেই’ এই অ্যালবামেরই একটা গান। এই গান সব ভীতসন্ত্রস্তদের শক্তি জোগায়—‘সোনালি সকাল মেঘে ঢেকে যাবে, ফসলের মাঠ আগুনে পুড়বে, বন্ধুর হাতে ছুড়ি ঝলসাবে, তবু ভয় নেই।’ তবে কি কাউকেই ভয় পান না এই শিল্পী?

এরপর তিনি ফিরে যান ১৯৭১ সালের ১ আগস্ট, নিউইয়র্ক সিটির ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে। সেখানে ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ আয়োজনে জোয়ান বায়াজের কণ্ঠে পৃথিবী শুনেছিল উদাত্ত আহ্বান। সেই আহ্বানই আবার শোনা গেল মাহমুদুজ্জামান বাবুর কণ্ঠে। তারপরই আসেন চে গুয়েভারা। ইংরেজি, স্প্যানিশসহ বিভিন্ন ভাষায় যে গানটি কোটিবার শোনা হয়েছে, সেই ‘আসতা সিয়েম্প্রে’ গানটি শোনালেন মাহমুদুজ্জামান বাবু। বাংলা ভাষায় গানটি অনুবাদ করেছেন তিনি। গানটি হলো, ‘তোমার না থাকা কিছু নয়/ সাহসে শুধু ঘুরে দাঁড়াতে হয়/ অন্ধকারে আলোকশিখা তুমি/ কমানদান্তে চে গেভারা’।

কেন গান করেন মাহামুদুজ্জামান বাবু? উত্তর আসল, ‘সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে।’

তিনি ভাবনাহীনতাকে ভাবিয়ে তুলতে চান। তিনি কান্নাহীনতার কালে কাঁদিয়ে তুলতে চান। তিনি প্রশ্নহীনতার কালে প্রশ্ন জাগিয়ে তুলতে চান। তাই তিনি গান গান।

বিকেল ফুরাল প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের ‘আমি বাংলায় গান গাই’ দিয়ে। গানটি গাইলেন মাহমুদুজ্জামান বাবু। জানালেন, যেখানেই থাকেন না কেন, এই বাংলাই তাঁর সব, বাংলা তাঁর হৃদয়, শরীর, মস্তিষ্ক। তাই দেশ থেকে দূরে বসেও তিনি বাংলাতেই ভাবেন, বাংলাতেই অভিমান করেন আর বাংলাতেই গান লেখেন, গান গান।