মিয়া–বিবির গানের দল
কোনো একদিন ঝড় হয়ে এলে
দমকা বাতাস আচমকা হেলেদুলে
কোনো একদিন পথ ভুলে গেলে
বুনো চারপাশ রাস্তা যেন বলে
এই গানের ইউটিউব ভিডিওর নিচে ওপার বাংলার এক ভক্তের মন্তব্য, 'দারুণ কাজ করছ তোমরা। পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং পাহাড় থেকে বসে এসব গান শোনার আলাদা আমেজ পাই...এসব কাজ আমাকে আরও আমাদের পড়শি বাংলাদেশকে ভালোবাসতে বাধ্য করে।'
বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে! কারা? একটু চোখ বুলাই। ইউটিউব চ্যানেলের নাম 'দ্য রেহমান ডুয়ো'। বিশটি ভিডিও। তার মধ্যে নিজেদের গান হাতেগোনা। বাকিগুলো কভার। এতেই বাজিমাত।
কথা, সুর, গায়কি, ভিডিও মিলিয়ে একেবারে দর্শকের মনের ঘরে ঢুকে পড়েছে। ইউটিউব ভিডিওর মন্তব্যগুলো অন্তত তা–ই প্রমাণ করে। কারও মন্তব্য, অর্ণবের পর খুব কম গানই এমন হয়েছে।
ফেসবুক ঘেঁটে হালসাকিন খুঁজে বের করা গেল। অতঃপর যোগাযোগ, কথাবার্তা। রেহমান ডুয়ো মানে দুই রেহমান, রুসলান আর রুবায়াত। গানের সূত্রেই পরিচয়, প্রেম, অতঃপর বিয়ে। জন্ম নিল ব্যান্ড দ্য রেহমান ডুয়ো।র
ব্যান্ড দ্য রেহমান ডুয়ো২০১৮ সাল থেকে যাত্রা। নিজেদের তাঁরা বলেন 'ইন্ডি ফোক/রক' ব্যান্ড। প্রথমে ওয়ারফেজ, আর্টসেল, শিরোনামহীন, মেঘদলের কিছু গান কভার করেন। ধীরে ধীরে নিজেদের গান করা শুরু করেন। 'অন্বয়', 'আসর' ও 'বলে দাও' নামে তিনটা মৌলিক গান এসেছে। কথার ফাঁকে একটা গোপন কথাও জানালেন রুসলান। তাঁদের প্রতিটি গানের শিরোনাম হবে বাংলা বর্ণমালার ক্রম অনুযায়ী। অ-তে অন্বয়, আ-তে আসর। আর পরের গান আসছে ই-তে ইতিবৃত্ত। কথায় কাব্যের প্রভাব আর যন্ত্রানুষঙ্গে পরিমিতি গানগুলোর বৈশিষ্ট্য। এসব গানের পাশাপাশি আলোচিত ওয়েব সিরিজ তকদির-এর আবহ সংগীত করেছেন রুসলান।
গোপালগঞ্জের ছেলে রুসলান। বাবার চাকরি সূত্রে খুলনায় কেটেছে শৈশব, কৈশোর ও তারুণ্য। তখন থেকেই কবিতার দিকে ঝোঁক। সঙ্গে চলল গান। খুলনার রোটারি স্কুলে পড়ার সময় গিটার শিখতেন স্কুলের পর্তুগিজ ফাদার পিন্টোজের কাছে। পাশাপাশি পিঙ্ক ফ্লয়েড, কোল্ড প্লে, লিনকিন পার্ক, আইরিশ ফোকসহ নানা ধরনের গান শোনা। দেশের এলআরবি, নগরবাউল, ওয়ারফেজের গান তো ছিলই।
জানালাম, একজন ভক্ত তাঁদের গানকে অর্ণবের পরে ব্যতিক্রমী গান হিসেবে উল্লেখ করেছেন। মুঠোফোনের অপর প্রান্তে রুসলান যেন একটু দম নিলেন! বললেন, 'এটা তো আমার কাছে দারুণ কমপ্লিমেন্ট।' কণ্ঠে বিনয়।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি অ্যান্ড উড টেকনোলজিতে পড়েছেন। কিছুদিন চাকরিও করেছেন। কিন্তু মনটা কেবলই পালাই পালাই করে। ইচ্ছা করে গান, সুর আর সাহিত্যে ডুবে থাকতে। ২০১৩ সালে ঢাকায় চলে আসেন। যুক্ত হয়ে যান একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থার সঙ্গে। কপি লেখা, অ্যাসিসটেন্সি করাসহ নানা কাজ করেন।
সেখানেই রুবায়াতের সঙ্গে পরিচয়। টাঙ্গাইলের ভারতেশ্বরী হোমসে পড়তেন রুবায়াত। এই স্কুলেই সংগীতশিক্ষা, গাইতেন রবীন্দ্রসংগীত। দুজন মিলে টুকটাক কাজ করেন। কাজ করতে করতেই কখন যেন এক হয়ে গেল দুজনের সুর।
২০১৯ সালের ২১ আগস্ট থেকে ইউটিউবে গান পোস্ট করা শুরু করেন তাঁরা। একেবারেই আটপৌরে ঘরোয়া আয়োজন। কিন্তু ভিডিওগুলোই ভক্তদের পছন্দ। লাখ লাখ টাকা খরচ করে বানানো মিউজিক ভিডিওর থেকে এগুলোই যেন ভক্তদের কাছে টানে বেশি। তাঁদের মনে হলো, এরা আমাদেরই শিল্পী।
রুসলান বলেন, 'আমরা বাণিজ্যের দিকে কখনোই মনযোগ দিইনি। আমরা নিজেদের মতো করে বানিয়েছি। এটা দর্শক ও শ্রোতা পছন্দ করেছেন। আমাদের গানের নিচে মন্তব্যগুলো দেখবেন। খুব কম নেতিবাচক। বেশির ভাগই ইতিবাচক। যাঁরা মন্তব্য করেছেন, একেবারে ভেতর থেকে ভালোবেসে করেছেন।'
টোনাটুনি নিজেদের ঘরেই গড়ে তুলেছেন স্টুডিও। ইউটিউবের গানগুলো ওখানেই তৈরি। ভিডিওগুলো তৈরিতে রুবায়াতের অবদান বেশি। রুসলানের ভাষায়, 'আমি একেবারেই অগোছালো। ইনস্ট্যান্ট কাজ করতে ভালোবাসি। রুবায়াত আবার গোছালো। কিউরেটিং ও-ই করে।' রুবায়াত রেহমান নিজেদের পথচলা নিয়ে বলেন, 'নিভৃতে গান করে যেতে চাই আমরা।'
আলাপের শেষে চলে আসি। কী নিয়ে ব্যস্ত এখন? জানান, অচিরেই সিনেমায় অভিষেক হতে যাচ্ছে। তবে এখনই নাম বলা মানা। পরিচালক নাকি দুঠোঁটে আঙুল ঠেকিয়ে বলেছেন, নিষেধ আছে।