‘রম্‌জানের ঐ রোজার শেষে’ গানের পেছনের গল্প

কাজী নজরুল ইসলাম (১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬—১২ ভাদ্র ১৩৮৩)
প্রতিকৃতি: সব্যসাচী মিস্ত্রী

ঈদের চাঁদ দেখা গেলেই বেজে ওঠে ‘রম্‌জানের ঐ রোজার শেষে এল খুশীর ঈদ্‌’ গানটি। এ গান যেন ঈদের খুশিকে দ্বিগুণ করে তোলে। আর রোজা শেষে এই গান যেন ঈদের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে গেছে। গানটি প্রথম গেয়েছিলেন আব্বাসউদ্দীন, লিখেছিলেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। এ গানটির পেছনের গল্পটি অসাধারণ।

কবি কাজী নজরুল ইসলাম তখন শ্যামাসংগীত লিখতেন। শ্যামাসংগীতের জন্য রীতিমতো খ্যাতির শিখরে পৌঁছে গিয়েছিলেন তিনি। এক রাতে রেকর্ডিং শেষে কাজী নজরুল ইসলাম বাড়ি ফিরছিলেন। পথে তাঁকে থামালেন শিল্পী আব্বাসউদ্দীন। কবির কাছে একটা আবদার ছিল তাঁর। না শোনা পর্যন্ত নজরুলকে যেতে দেবেন না। আব্বাসউদ্দীন কবি নজরুলকে সম্মান করতেন। শ্রদ্ধাভরে তাঁকে কাজী দা বলে ডাকতেন। নজরুল বললেন, ‘বলে ফেলো তোমার আবদার।’ আব্বাসউদ্দীন সুযোগটা পেয়ে গেলেন। বললেন, ‘কাজী দা, একটা কথা আপনাকে অনেক দিন ধরেই বলব বলব ভাবছি। দেখুন, পিয়ারু কাওয়াল, কাল্লু কাওয়ালরা কী সুন্দর উর্দু কাওয়ালি গায়। শুনেছি তাদের গান প্রচুর বিক্রি হয়। বাংলায় ইসলামি গান তো তেমন নেই। বাংলায় ইসলামি গান গাইলে কেমন হয়? আপনি যদি ইসলামি গান লেখেন, তাহলে মুসলমানদের ঘরে ঘরে আপনার জয়গান বাজবে।’ বাজারে তখন শ্যামাসংগীতের জয়জয়কার। যে শিল্পীই শ্যামা সংগীত গাইতেন, তিনিই রীতিমতো বিখ্যাত হয়ে যেতেন।

মার্কেট ট্রেন্ডের বাইরে গিয়ে বিনিয়োগ করলে ব্যবসায় লালবাতি জ্বলতে পারে। আব্বাসউদ্দীন যতই অনুরোধ করছেন, ততই তিনি বেঁকে বসছেন। আব্বাসউদ্দীনও নাছোড়বান্দা। এত বড় সুরকার হওয়া সত্ত্বেও তিনি ভগবতী বাবুর পিছু ছাড়ছেন না, অনুরোধ করেই যাচ্ছেন। দীর্ঘ ছয় মাস চলল অনুরোধের আসর।

নজরুল নিজেও শ্যামাসংগীত লিখতেন, সুর করতেন। গানের বাজারের যখন এই অবস্থা, তখন আব্বাসউদ্দীনের এমন আবদারের জবাবে নজরুল কী জবাব দেবেন, বুঝে উঠতে পারেন না। আবার ‘ইসলাম’ শব্দটার সঙ্গে তাঁর অনেক আবেগ মিশে আছে। ছোটবেলায় মক্তবে পড়েছেন, কোরআন শিখেছেন এমনকি তাঁর নিজের নামের সঙ্গেও ‘ইসলাম’। আব্বাসউদ্দীনকে তক্ষুনি সরাসরি ‘হ্যাঁ’ বলা যাচ্ছে না। স্রোতের বিপরীতে সুর মেলানো চাট্টিখানি কথা নয়। আবেগে গা ভাসালে চলবে না। গান রেকর্ড করতে হলে তো বিনিয়োগ করতে হবে, সরঞ্জাম লাগবে। এগুলোর জন্য গ্রামোফোন কোম্পানির রিহার্সেল-ইন-চার্জ ভগবতী বাবুর কাছে যেতে হবে। নজরুল বললেন, ‘আগে দেখো ভগবতী বাবুকে রাজি করাতে পারো কি না।’

আব্বাসউদ্দীন ভাবলেন, যাক, কাজী দার কাছ থেকে সবুজসংকেত পাওয়া গেল। এবার ভগবতী বাবুকে রাজি করানোর পালা। তিনি ভগবতী বাবুকে গিয়ে অনুরোধ করলেন। কিন্তু ভগবতী বাবু ঝুঁকি নিতে রাজি না। মার্কেট ট্রেন্ডের বাইরে গিয়ে বিনিয়োগ করলে ব্যবসায় লালবাতি জ্বলতে পারে। আব্বাসউদ্দীন যতই অনুরোধ করছেন, ততই তিনি বেঁকে বসছেন। আব্বাসউদ্দীনও নাছোড়বান্দা। এত বড় সুরকার হওয়া সত্ত্বেও তিনি ভগবতী বাবুর পিছু ছাড়ছেন না, অনুরোধ করেই যাচ্ছেন। দীর্ঘ ছয় মাস চলল অনুরোধের আসর।

কাজী নজরুল ইসলাম ও আব্বাসউদ্দীন। ছবি: সংগৃহীত

একদিন ভগবতী বাবুকে ফুরফুরে মেজাজে দেখে আব্বাসউদ্দীন বললেন, একবার এক্সপেরিমেন্ট করে দেখুন না। যদি বিক্রি না হয় তাহলে আর নেবেন না। ভগবতী বাবু আর কত ‘না’ বলবেন। এবার তিনি হেসে বললেন, ‘নাছোড়বান্দা আপনি জনাব। আচ্ছা যান, করা যাবে। গান নিয়ে আসুন।’ শুনে আনন্দে আব্বাসউদ্দীনের চোখে যেন জল এসে গেল। এবার একটা গান বাঁধতে হবে। তিনি গেলেন কবি নজরুলের কাছে। কবি চা আর পান পছন্দ করেন। এক ঠোঙা পান আর চা নিয়ে আব্বাসউদ্দীন নজরুলের ঘরে গেলেন। পান মুখে নজরুল খাতা-কলম হাতে ঘরের দরজা বন্ধ করলেন। বাইরে দাঁড়িয়ে আব্বাসউদ্দীন অপেক্ষার প্রহর গুনতে শুরু করলেন। সময় যেন থমকে দাঁড়িয়েছিল। সময় কাটানোর জন্য আব্বাসউদ্দীন পায়চারি করতে লাগলেন। প্রায় আধঘণ্টা কেটে যায়। বন্ধ দরজা খুলে নজরুল বের হন। পানের পিক ফেলে আব্বাসউদ্দীনের হাতে তিনি একটা কাগজ ধরিয়ে দিলেন। সেই কাগজ তাঁর আধঘণ্টার সাধনা, আব্বাসউদ্দীনের ছয় মাসের পরিশ্রমের ফল। আব্বাসউদ্দীন কাগজটি পড়তে শুরু করলেন—ও মন রম্‌জানের ঐ রোজার শেষে এল খুশীর ঈদ্‌ / তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানী তাগিদ ...। আব্বাসউদ্দীনের চোখ পানিতে ছলছল করে উঠল। একটা গানের জন্য কত কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে তাঁকে। সেই গান এখন তাঁর হাতের মুঠোয়। তিনি কি জানতেন, এই গান একদিন ঘরে ঘরে আনন্দের বার্তা পৌঁছে দেবে, ঈদের চাঁদ দেখার সঙ্গে সঙ্গে টেলিভিশনে বেজে উঠবে!

এ রকম সুযোগ একবারই আসে। আব্বাসউদ্দীন যখন এই চিন্তায় মগ্ন, তখন পাশে বসা এক যুবক গুনগুনিয়ে গাওয়া শুরু করলেন, ‘ও মন রম্‌জানের ঐ রোজার শেষে এল খুশীর ঈদ্‌।’ আব্বাস ভাবলেন, এই যুবক গানটি কোথায় শুনল? নাকি তিনি ভুল শুনছেন?

দুই মাস পর রোজার ঈদ। গান লেখার চার দিনের মধ্যে রেকর্ডিং হয়ে গেল। আব্বাসউদ্দীন এবারই প্রথম ইসলামি গান রেকর্ড করলেন। গানটি তখনো তাঁর মুখস্থ হয়নি। গানটি চলবে কি না, এই নিয়ে গ্রামোফোন কোম্পানিও ছিল শঙ্কায়। তবে কাজী নজরুল ইসলাম বেশ রোমাঞ্চিত। কীভাবে গাইতে হবে, তিনি সেটা আব্বাসউদ্দীনকে দেখিয়ে দেন। হারমোনিয়ামের ওপর আব্বাসউদ্দীনের চোখ বরাবর কাগজটি ধরে রাখলেন কাজী নজরুল ইসলাম নিজেই। আব্বাসউদ্দীন গানটি গাইলেন। ঈদের সময় এ গানসহ অ্যালবামটি বাজারে এল। তারপর হয়ে গেল ঈদের ছুটি। আব্বাসউদ্দীন বাড়িতে ঈদ কাটাতে গেলেন।

আব্বাসউদ্দীনের মনের ভেতর উচাটন, কখন কলকাতা যাবেন। গানটি থেকে কতটা সাড়া মিলল, সেটা জানার জন্য তিনি অস্থির হয়েছিলেন। ছুটি কাটিয়ে চটজলদি তিনি ফিরলেন কলকাতায়। ঈদের ছুটির পর প্রথমবারের মতো অফিসে যাচ্ছেন। ট্রামে চড়ে অফিসের পথে যত এগোচ্ছেন, বুকটা ততো ধকধক করছিল তাঁর। অফিসে গিয়ে কী দেখবেন? গানটা ফ্লপ হয়েছে? গানটা যদি ফ্লপ হয় তাহলে তো আর কোনো দিন ইসলামি গানের কথা ভগবতী বাবুকে বলতে পারবেন না। ভগবতী বাবু কেন, কোনো কোম্পানি আর ঝুঁকি নেবে না। এ রকম সুযোগ একবারই আসে। আব্বাসউদ্দীন যখন এই চিন্তায় মগ্ন, তখন পাশে বসা এক যুবক গুনগুনিয়ে গাওয়া শুরু করলেন, ‘ও মন রম্‌জানের ঐ রোজার শেষে এল খুশীর ঈদ্‌।’ আব্বাস ভাবলেন, এই যুবক গানটি কোথায় শুনল? নাকি তিনি ভুল শুনছেন? তিনি যুবককে আবারও গাইতে শুনলেন। এবার তাঁর শরীরের ভেতর এক শীতল বাতাস বয়ে গেল। অফিসে ফিরে বিকেলে যখন গড়ের মাঠে গেলেন, তখন আরেক দৃশ্য দেখে তিনি আবার অবাক হলেন। কয়েকটা ছেলে দল বেঁধে মাঠে বসে আছে। তাদের মধ্যে একজন গাইছে ‘ও মন রম্‌জানের ওই রোজার শেষে এল খুশীর ঈদ।’ আব্বাসউদ্দীন এ আনন্দ যেন সইতে পারলেন না। ছুটে গেলেন নজরুলের কাছে। গিয়ে দেখেন কবি নজরুল দাবা খেলছেন। দাবা খেলার সময় তিনি আশপাশে তাকান না। সেদিন আব্বাসউদ্দীনের গলার স্বর শোনার সঙ্গে সঙ্গে নজরুল দাবা খেলা ছেড়ে লাফিয়ে উঠে তাঁকে জড়িয়ে ধরলেন। নজরুল বললেন‚ ‘আব্বাস, তোমার গান কী হিট হয়েছে!’