রাতে গ্রামের দরিদ্র মানুষের পাশে সেই ইমন খান

করোনায় অসহায় স্বল্প আয়ের মানুষকে সহায়তা দিতে এগিয়ে এসেছেন সংগীতশিল্পী ইমন খান। করোনার এই সময়ে রাতের আঁধারে আশপাশে হতদরিদ্র খেটে খাওয়া ৯টি গ্রামের মানুষের বাড়িতে বাড়িতে সহায়তা পৌঁছে দেন এই সংগীতশিল্পী। ‘আজও প্রতি রাত জেগে থাকি তোমার আশায়’ গান দিয়ে রাতারাতি জনপ্রিয়তা পান তিনি। দারুণ ব্যবসাসফল গানটি তাঁকে অল্প সময়ে পরিচিতি দেয়। সেই থেকে এখনো নিয়মিত গান করে চলেছেন ইমন খান।
মানুষের সহায়তায় এগিয়ে আসা প্রসঙ্গে ইমন খান বলেন, ‘আমি গ্রামের ছেলে। আমার অজপাড়া গ্রামেই আমি বড় হয়েছি। অনেক ছোট থেকেই আশপাশের গ্রামের মানুষের সঙ্গে আমার ভালো সুসম্পর্ক। তাঁরা সবাই আমাকে ভালোবাসেন। তাঁদের মধ্যে অনেকেই আছেন দিনমজুর। যাঁরা দিনে যা আয় করেন, সেই উপার্জন দিয়ে খেয়ে–পরে কোনোমতে বেঁচে থাকেন। তাঁদের বাড়তি কোনো সাধ–আহ্লাদ নেই। তাঁরা বেশির ভাগ পেশায় রিকশাচালক, কেউ ভ্যানচালক, চা দোকানদার, নাপিতের কাজ করেন কেউ, অনেকে মুচি। তাঁরা কেউই এই দুর্যোগে কাজ করতে পারছেন না। সরকারি আদেশে তাঁরা ঘরে আছেন। খেটে খাওয়া দিনমজুর মানুষগুলোর কর্ম না থাকায় চরম অসহায় হয়ে পড়েছেন। আমি শুনেছি অনেকেই ঠিকমতো পরিবার নিয়ে চলতে হিমশিম খাচ্ছেন। অনেকের ঘরে বলতে গেলে খাবার নেই। তখনই সিদ্ধান্ত নিই এই দুঃসময়ে তাঁদের নিয়ে একসঙ্গে যতটুকু ভালো থাকা যায়, তার চেষ্টা করব। এই ভ্যানচালক, চা দোকানদার, নাপিত, মুচি তাঁদের জন্য মন কাঁদে ভাই। এ জন্যই এগিয়ে এসেছি।’

সেই সহায়তার উদ্দেশ্যে নিজ থেকে এগিয়ে এলেও পরে এই শিল্পী ভাবতে থাকেন তাঁর নিজের খুব বেশি সামর্থ্য নেই। কিন্তু তাঁকে ভালোবাসার অনেক মানুষ আছেন। তাঁরা যদি কেউ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন, তাহলে গরিব মানুষের জন্য কিছুটা উপকার হবে। সে জন্য প্রথমেই ইমন খান কয়েকজনকে ফোন দেন। সেখান থেকে সাড়া পেয়ে গত সপ্তাহেই সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে একটি স্ট্যাটাস দেন আর্থিক সহায়তা চেয়ে। তাঁর এই উদ্যোগে এগিয়ে আসেন ভক্ত এবং শুভাকাঙ্ক্ষীরা। ১০০ থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত সহায়তা দিয়েই গড়ে তোলেন ফান্ড। এ প্রসঙ্গে ইমন খান বলেন, ‘আমি প্রথমে ভেবেছিলাম আমার যা সামর্থ্য আছে, তাই দিয়ে সহায়তা করব। পরে মনে হলো আমার খুব বেশি সামর্থ্য নেই, কিন্তু আমাকে ভালোবাসেন এমন অনেক মানুষ আছেন। আমি তাঁদের ফোন দিই। তাঁরা অনেকেই এগিয়ে এলে মনে সাহস পাই। তখন মনে হয় আমার ফেসবুকে অনেক বন্ধু, বড় ভাই, ছোট ভাই, ভক্ত আছেন—তাঁরা যদি কিছুটা সহায়তা করেন, তাহলে হয়তো এই দরিদ্র মানুষগুলো আরও একটু ভালো থাকতে পারবেন। অনেকের কাছে মেসেঞ্জারে আর্থিক সহায়তা চেয়ে খুদে বার্তা পাঠাই। সেখান থেকে অনেকে সাড়া দিয়েছেন। সেই অর্থ দিয়েই মানুষের পাশে দাঁড়ানোর ক্ষুদ্র চেষ্টা করেছি।’
‘এখন পর্যন্ত দেশ এবং দেশের বাইরে সবার আর্থিক সহযোগিতায় ১৪৫টি পরিবারকে সাহায্য করতে পেরেছি। আমার ভক্ত এবং যেসব শুভাকাঙ্ক্ষী, যাঁরা আমার নম্বরে টাকা পাঠিয়েছেন, তাঁদের কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ’—বলেন ইমন খান। যাঁরা টাকা পাঠিয়েছেন, তাঁদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘আপনারা যাঁরা আমার ওপর আস্থা রেখে এই অসহায় মানুষের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন এবং দিচ্ছেন। আপনাদের সবার কাছে আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। আপনারা সবাই আজ যে মানবতা দেখালেন, সেটায় আমার বুকটা ভরে গেছে।’

ইমন খানের গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া থানার মাঝিপাড়া গ্রামে। অসহায় মানুষের তালিকা করার জন্য তিনি গ্রামের মেম্বার বা গ্রামপ্রধান, গ্রামের মানুষের সহায়তা নিয়েছেন। সেই তালিকা ধরেই গতকাল রাত আটটা থেকে রাত দুইটা পর্যন্ত মাঝিপাড়া, মালিপাড়া, গঙ্গারামপুর, ধরাইলসহ ছয়টি গ্রামের মানুষকে সহায়তা করেন। বাকি তিনটি গ্রামে আজ সন্ধার পরে সহায়তা করবেন। এই রাতে অসহায় মানুষের বাড়িতে ত্রান পৌঁছে দেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘দুটি কারণে আমরা সন্ধ্যার সময়কে বেছে নিয়েছি। প্রথমত, জনসমাগম এড়িয়ে চলার জন্য এই সময়টা সুবিধাজনক। আরেকটি কারণ আমাদের হাতে সীমিত ত্রাণ আছে। সেটা দিয়ে অনেকের চাহিদা পূরণ করতে পারব না। দিনে অনেকেই ভিড় করবেন ভেবে এই সময়টা বেছে নিয়েছি। ত্রাণ না পেয়ে অনেকে ফিরে যান, এটা আমাদের খুবই কষ্ট লাগে। মন চায় সবাইকে দিতে। আমাদের সাধ আছে কিন্তু সাধ্য নেই। যাঁদের ঘরে একদমই খাবার নেই, আমরা শুধু তাঁদের এই মুহূর্তে সহায়তা দিচ্ছি। আমাদের খুব বেশি অর্থ নেই ভাই। কী বলব, যাঁরা ভিড় করছেন সবাই অসহায়। তাঁদের দিতে পারছি না, এই কষ্টটায় কান্না আসছে।’

তাঁর এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানান গ্রামের মানুষ। রাসেল আহমেদ তাঁদের গ্রামের একজন। তিনি শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তিনি মুঠোফোনে বলেন, ‘দেশের এই ক্লান্তিলগ্নে আমাদের গ্রামের অনেকের পক্ষে খেয়ে–পরে বেঁচে থাকাই কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এই দুর্যোগের সময়ে যাঁরা দিন এনে দিন খায়, তাঁদের চলার কোনো উপায় নেই। কেউ একবেলা খাচ্ছে, কেউ খাচ্ছে না, তাঁদের পাশে যে ইমন ভাই দাঁড়িয়েছেন, এটাকে আমি সাধুবাদ জানাই।’
সহায়তা পাওয়া চেংটিয়া গ্রামের একজন মুঠোফোনে বলেন, ‘খাবার নাই ঘরে খামু কি জানি না। বাইরে বের হওয়া নিষেধ। কাজ করতে পারি না। ইমন ভাই আমাদের সাহায্য করল। আল্লাহ তার ভালো করুক।’
মানুষের পাশে সব সময়ই দাঁড়াতে চান এই শিল্পী। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি গান গাই, গানের শিল্পী। সংগীতের পাশাপাশি অবশ্যই এই অসহায় মানুষের পাশে সব সময়ই দাঁড়াতে চাই। এখানে যেমন একজন শিল্পী হিসেবে দায়বদ্ধতা থাকে তেমনি মানুষের ভালোবাসার প্রতিদানও দিতে হয়।’
ইমন খানের বয়স তখন ২০ বছর। প্রথমে চারটি অডিও অ্যালবাম বের করে কোনো সাফল্য আসেনি। ব্যক্তিগত উদ্যোগে ২০০৭ সালের শেষের দিকে ১২টি গান নিয়ে ইমন বের করেন ৫ নম্বর অডিও অ্যালবাম ‘কেউ বোঝে না মনের ব্যথা’। সেই অ্যালবামেই ছিল ‘আজও প্রতি রাত জেগে থাকি তোমার আশায়’ গানটি। রাতারাতি আলোচনায় উঠে আসে গানটি। শোনা যায়, ২০০৮ সালে ইমন খানের এই অ্যালবামের মোট ১৫ লাখ কপি বিক্রি হয়।