সন্ধ্যা প্রদীপ হয়ে জ্বলবেন

সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়
ছবি: সংগৃহীত

বাংলা গানের দুই দিকপাল—হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও মান্না দে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম বাংলা গান শোনার কান তৈরি করেছিলেন এই দুই পুরুষ। দুই পুরুষের মধ্যেই সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় এসেছিলেন ঠিক যেন সন্ধ্যাপ্রদীপ হয়ে। পর্দায় যেমন উত্তম–সুচিত্রা হয়ে উঠেছিলেন আধুনিকতার প্রতীক, কণ্ঠে তেমনই হেমন্ত–সন্ধ্যা কিংবা মান্না–সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও মান্না দে চলে গেছেন। গতকাল নিভে গেল গানের সন্ধ্যাপ্রদীপও, ৯০ বছরে।

১৯৩১ সালের ৪ অক্টোবর। দক্ষিণ কলকাতার ঢাকুরিয়ায় জন্ম সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের। হেমপ্রভা দেবী আর নরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের ছয় ছেলেমেয়ের মধ্যে একেবারে ছোট ছিলেন সন্ধ্যা। পারিবারিকভাবে ছিল সংগীতযোগ। তাই সংগীতটা রক্তে ছিল বহমান। সন্ধ্যা নিজে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তাঁদের বংশের আদি পুরুষ রামগতি মুখোপাধ্যায় ছিলেন সংগীতজ্ঞ। তাঁর ছেলে সারদাপ্রসাদও সংগীতের চর্চা করতেন। সারদাপ্রসাদের ছেলে সন্ধ্যার ঠাকুরদা। কৃষ্ণভক্ত বাবা নরেন্দ্রনাথের কাছেই ভক্তিমূলক গান শেখার মধ্য দিয়ে গানে পথচলা শুরু সন্ধ্যার।

সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়

১৯৪৩ সালে ১২ বছর বয়সে অল বেঙ্গল মিউজিক কনফারেন্স আয়োজিত সংগীত প্রতিযোগিতায় ভজন বিভাগে প্রথম হয়েছিলেন সন্ধ্যা। ‘গীতশ্রী’ পরীক্ষাতেও প্রথম। চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি পরীক্ষাটি হয়েছিল। ‘ভজন’ ও ‘গীতশ্রী’ দুটি পরীক্ষায় প্রথম হওয়ার পরে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় গাইলেন। তারপর রচনা করলেন সংগীতের এক অনন্য ইতিহাস। একাধারে খেয়াল, ঠুমরি, ভজন, গজল, কীর্তন, ভাটিয়ালি, বাউল, রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলসংগীত, পুরাতনী। বাংলা গানের এমন কোনো ধারা নেই, যেখানে সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালেননি। পাশাপাশি চালিয়ে নিয়েছিলেন শাস্ত্রীয় সংগীতচর্চা। ওস্তাদ বড়ে গুলাম আলী খানের কাছে শিখেছিলেন তালিম। তাঁর ছেলে ওস্তাদ মুনাওয়ার আলী খানকে ডাকতেন ভাইয়া বলে, এক স্মৃতিচারণায় জানিয়েছিলেন সন্ধ্যা। এ ছাড়া পণ্ডিত সন্তোষ কুমার বসু, এ টি ক্যানন এবং চিন্ময় লাহিড়ীর কাছে দীর্ঘদিন সংগীতচর্চা করেছিলেন তিনি।

১৯৫০ সালে মুম্বাইতে পাড়ি দেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। দুই বছরের মধ্যে মোট ১৭টি হিন্দি ছবিতে গেয়ে সাড়া ফেলেছিলেন। ১৯৫২ সালে কলকাতায় ফিরে আসেন। ১৯৬৬ সালে বাঙালি কবি শ্যামল গুপ্তকে বিয়ে করেন। এই সময়ে সন্ধ্যার জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একের পর এক আধুনিক গানের রেকর্ড প্রকাশিত হয়েছে। সলিল চৌধুরী, নচিকেতা ঘোষ, রবিন চট্টোপাধ্যায় কিংবা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মতো সুরকারের সুরে একাধিক গান রেকর্ড করেছেন তিনি। সেই সঙ্গে চলে প্লেব্যাকে। অগ্নিপরীক্ষা ছবিতে সুচিত্রার ঠোঁটে প্রথম সন্ধ্যার কণ্ঠ শোনা যায়। প্রথম থেকেই সুচিত্রা-সন্ধ্যা জুটি সুপারহিট। সন্ধ্যার উচ্চারণ, অভিব্যক্তি, কণ্ঠের মডিউলেশন—সব মিলিয়ে বাংলা ছবির গানের উপস্থাপন ভিন্ন মাত্রা পেতে থাকে।

সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়

মহানায়ক উত্তমকুমার ও সুচিত্রা সেন অভিনীত সিনেমায় নেপথ্য গায়িকা হিসেবে সংগীত পরিচালকদের পছন্দ ছিলেন সন্ধ্যা। ১৯৭১ সালে জয় জয়ন্তী ও নিশিপদ্ম ছবির গান দিয়ে শ্রেষ্ঠ গায়িকা হিসেবে জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন তিনি। তবে মানুষের হৃদয়ে ঠাঁই পাওয়াই সম্ভবত তাঁর সবচেয়ে বড় পুরস্কার। কারণ, কিছু দিন আগেই ভারত সরকারের পদ্মশ্রী খেতাব গ্রহণ করেননি তিনি। আজীবন যুক্ত ছিলেন গণ–আন্দোলনে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি উপলক্ষে গেয়েছিলেন ‘বঙ্গবন্ধু ফিরে এলে’। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানে প্রথম বিদেশি শিল্পী হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সন্ধ্যা।

সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় চলে গেছেন কিন্তু ‘মধু মালতী’, ‘এ শুধু গানের দিন’, ‘হয়তো কিছুই নাহি পাব’, ‘আমি তার ছলনায় ভুলব না’, ‘খোলা আকাশ কি’–এর মতো গানগুলো বাঙালির মনের মণিকোঠায় সন্ধ্যাপ্রদীপের মতো জ্বলবেন।