জাদু সৃষ্টিকারী ‘দেওরা’র গল্প
‘আমি এক নৌকাবাইচে প্রথম শুনি “দেওরা” গানটি। বইঠা বাইতে বাইতে সবাই মিলে এই গানটি গাচ্ছিলেন। নৌকার ওপর দাঁড়িয়ে মাঝি বোতল দিয়ে তালে তালে বাড়ি দিচ্ছিলেন সবাইকে উৎসাহ দেওয়ার জন্য। এই গান এবং বৈঠার গতি একসঙ্গে চলছিল। বিষয়টা এত ভালো লেগেছিল আমার কাছে! তখনই ভেবেছিলাম, এই সারিগান নিয়ে কিছু করার কথা।’ ‘দেওরা’ গানের আঁতুরঘরের গল্পের শুরুটা এভাবেই করলেন গানটির সংগীতায়োজক এবং গায়ক প্রীতম হাসান।
প্রীতম যে নৌকাবাইচে শুনেছিলেন গানটি, সেই নৌকার মাঝি ছিলেন ফজলুল হক। সবাই তাঁকে ‘ফজলু মাঝি’ বলে ডাকেন। এই গানে ফজলু মাঝি এবং তাঁর দলও অংশগ্রহণ করেন। ফজলু মাঝি বলেন, ‘আমরা তো শুনে শুনে এই গান মনে রাখি। আবার কাজের সময় তা সবাই মিলে গাই। এই গানের জন্য প্রীতম ভাইয়ের এমন ভালোবাসা, এত আয়োজন খুব ভালো লেগেছে।’
কোক স্টুডিও বাংলার দ্বিতীয় মৌসুমের গান ‘দেওরা’ ইউটিউবে অবমুক্ত হয় ৭ মে। তার পর থেকেই লাখ লাখ দর্শক-শ্রোতা উপভোগ করেন গানটি। গান উপভোগের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিও যেন নতুন প্রজন্ম জানতে পারে, তেমনটাই ভাবনা থাকে কোক স্টুডিও বাংলার আয়োজকদের। সেই ধারাবাহিকতায় এবার এই সারিগানের সঙ্গে যোগ করা হয় পালাগান। পালাগানের জন্য খুঁজে বের করা হয় ইসলাম উদ্দিন পালাকারকে, যিনি প্রখ্যাত কুদ্দুস বয়াতির শিষ্য। ইসলাম উদ্দিন পালাকার নিয়মিত পালাগানের আয়োজন করেন, বাংলার ঐতিহ্যকে নিজের মধ্যে ধারণ করেন।
‘দেওরা’ গান প্রসঙ্গে ইসলাম উদ্দিন পালাকার বলেন, ‘পালাগান তো আসলে মুখে মুখে প্রচলিত গান। আমরা লিখে রাখি না। যখন যেটা মনে আসে, গাই। মুখেই গান বাঁধি। এই গানকে এত বড় পরিসরে নিয়ে আসার জন্য কোক স্টুডিও বাংলাকে ধন্যবাদ। আমাদের দেশে যে এত বৈচিত্র্যের গান আছে, নতুন প্রজন্ম সেটা জানতে পারল, এত আনন্দের সঙ্গে উপভোগ করতে পারল, এ জন্য আমি ব্যাপক খুশি।’
গানটিতে ইসলাম উদ্দিন পালাকারকে দেখা যায় ভিন্ন রকম এক পোশাকে। অংশগ্রহণকারী সবার পোশাকেই ছিল বৈচিত্র্য।
‘দেওরা’ গানের পোশাক পরিকল্পক দিশা জানান, ‘এটা যেহেতু একটা লোকজ মজার গান, তাই সেই ধারা আমাদের আনতে হয়েছে। পালাকার তেমনই পোশাক পরেছেন। আর সবার পোশাকে নকশিকাঁথার একটা আমেজ ছিল। প্রীতম আমাকে জানিয়েছেন, তিনি জ্যাকেট পরবেন। আমরা তাই তাঁর বাহুতে ব্যাজ বানিয়েছি। ব্যাজগুলোয় যতটুকু পেরেছি, গ্রামীণ ঐতিহ্য তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আর তাঁর জুতায় এঁকে দিয়েছি নকশিকাঁথা।’
‘দেওরা’ গানটির ভিডিও পরিচালনা করেছেন কৃষ্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায়। তিনি জানান, ‘যেহেতু এটা লোকজ গান, আমরা প্রথমেই ঠিক করেছি, গ্রামীণ মেলার আবহ থাকবে দৃশ্যায়নে। খুব রঙিন করা হবে সবকিছু। মেলায় যে পুতুল আর আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র পাওয়া যায়, এই গানের প্রতিটি অংশে তা ব্যবহার করা হয়েছে।’
গানটির শিল্পনির্দেশকের দায়িত্বে ছিলেন রাজিম আহমেদ। রাজিম বলেন, ‘যাঁরা নৌকাবাইচ করেন, তাঁদের মাথায় সব সময় গামছা থাকে। তাই আমরা পুরো সেটে কোথায় কোথায় গামছা ব্যবহার করা যায়, সেটায় প্রাধান্য দিয়েছি। সব গামছাই ছিল রঙিন এবং এই গানে ফজলু মাঝির সঙ্গে যাঁরা অংশগ্রহণ করেছেন, তাঁদের সবার মাথায়ই ছিল গামছা। গানের দৃশ্যায়নে বৈচিত্র্য আনার জন্য আমরা নিয়নের বৈঠা ব্যবহার করেছি।’
দর্শক-শ্রোতার মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টিকারী ‘দেওরা’ গানটিতে পশ্চিমা সংগীতের গসপল ব্যবহার করা হয়েছে। গসপলের সঙ্গে কিছুটা রক। আর সেই গসপলের ধারা অনুযায়ী নাচে অংশ নেয় ‘ঘাসফড়িং কয়ার’। এই দলের পরিচালক আরমিন মূসা জানান, ‘আমরা আগে গসপল করিনি। তবে প্রীতমের নির্দেশনায় এটি করতে গিয়ে মনে হলো, অনবদ্য কিছু একটা হয়েছে।’