জাগো পিয়া: এগিয়ে যাওয়ার বার্তা দেয় যে গান

আরমীন মুসাছবি: সংগৃহীত

‘গতকালের কথাগুলো পেছন ফেলে চলো/ রবির কিরণ চোখে মাখিয়ে নতুন আগুনে জ্বলো/ সামনে আসে/ নতুন দিনের আগমনী বলো/ জাগো পিয়া আর ঘুমাইও না হৃদয়ে সুর তোলো।’ এমন গানের কথার ইন্দ্রজাল আর সুরের মাদকতায় লীন হয়ে যান শ্রোতারা; বাংলাদেশের গানের সুরসুধা বাংলাদেশ, ভারত ছাড়িয়ে পৌঁছে গেল বিশ্বসংগীতের সবচেয়ে বড় আসর গ্র্যামিতে।
৬৫তম গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ডের সেরা গ্লোবাল মিউজিক অ্যালবাম বিভাগের জন্য মনোনীত বার্কলে ইন্ডিয়ান অনসম্বলের ‘শুরুয়াত’–এর ১০টি গানের মধ্যে এটি একটি।

নজরুলসংগীতশিল্পী অধ্যাপক ড. নাশিদ কামালের কথায় নিজের সুরে গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছেন তাঁর মেয়ে, যুক্তরাষ্ট্রের বার্কলে কলেজ অব মিউজিকের প্রাক্তন শিক্ষার্থী আরমীন মুসা।
সনি মিউজিকের পরিবেশনায় চলতি বছরের জুলাইয়ে প্রকাশিত এ অ্যালবামে ওস্তাদ জাকির হোসেন, শ্রেয়া ঘোষাল, শঙ্কর মহাদেবন, বিজয় প্রকাশের মতো নামি সুরকার–শিল্পীদের ১০টি গান রয়েছে। আরমীনের সঙ্গে বিশ্বের ১৭টি দেশের শিল্পী, যন্ত্রশিল্পী ও কলাকুশলীরা ‘জাগো পিয়া’ গানে কাজ করেছেন।

অ্যালবামটি চলতি বছর প্রকাশিত হলেও আরমীনের গানটি প্রকাশিত হয়েছে প্রায় ছয় বছর আগে, তখন বার্কলে কলেজ অব মিউজিক থেকে সবে পড়াশোনা শেষ করেছেন। সিলেবাসের অংশ হিসেবেই একটি মৌলিক গান করতে বলা হয় আরমীনকে; নিজের ভাষাকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে বাংলায় গানটি করার পরিকল্পনা করেন এই শিল্পী।
গানের গীতিকার নাশিদ কামাল প্রথম আলোকে জানান, আরমীন সেই গানের সুর তুলে তাঁর কাছে এসে একটি গান লিখে দিতে বলেন। নাশিদ কামালের ভাষ্য, ‘তখন আমি সিনেমা দেখছিলাম, সুর শুনেই আমার ভাবনায় এল, “জাগো জাগো।” আরমীনকে উৎসাহ দেওয়ার জন্য গানের কথার মাঝে বললাম, ‘গতকালের কথাগুলো ফেলে রাখো’। আড়াই মিনিটের মধ্যেই গানটা বলে দিয়েছিলাম।’

মা নাশিদ কামালের সঙ্গে আরমীন মুসা
ছবি: সংগৃহীত

২০১৬ সালের এপ্রিলে আরমীনের কণ্ঠে গানটি প্রকাশিত হয়। পরে আয়োজকেরা এ বছরে প্রকাশিত ‘শুরুয়াত’ অ্যালবামে তা যুক্ত করেন। ওস্তাদ জাকির হোসেন, শ্রেয়া ঘোষালদের মতো তবলাবাদক, সুরকার ও শিল্পীদের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পান আরমীন। এ অ্যালবামের শিল্পী–গীতিকার হিসেবে তাঁদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ডের আয়োজনে যোগ দেবেন মা ও মেয়ে।
গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ডের মনোনয়নের তালিকায় ‘শুরুয়াত’ অ্যালবামের নাম আসার পর অ্যালবামের বাকি গান ছাপিয়ে ‘জাগো পিয়া’ নিয়েই আলোচনা চলছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে; এমনটা তো হওয়ারই কথা। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোনো বাংলাদেশি শিল্পী, গীতিকারের গান গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ডের মঞ্চে গেল।
গানের ভিডিওতে দেখা গেছে, গানের কথা–সুরের সঙ্গে শিল্পী, যন্ত্রশিল্পীদের পোশাকে বাঙালি সংস্কৃতিকে তুলে ধরা হয়েছে। কাঁধে গামছা ঝুলিয়ে জর্ডানের ভায়োলিনবাদক লাইথ সাদিককে ভায়োলিনে বুঁদ হয়ে থাকতে দেখা গেছে, চেন্নাইয়ের সাঞ্জানা রাজা থেকে সুইজারল্যান্ডের রাইদিয়া রেনোল্ড, মালয়েশিয়ার জোনাথন লি থেকে ইসরায়েলের জোগেব গাবি—সবাই নিজেকে সাজিয়েছেন বাঙালির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠা গামছায়।

আরমীন মুসা l
ছবি: সংগৃহীত

এ গানে মানুষের এগিয়ে যাওয়ার বার্তা দিতে চেয়েছেন গীতিকার নাশিদ কামাল। গানটি বাংলাদেশকেও এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা দিল। বাংলাদেশে শিল্পীদের জন্য গ্র্যামির অধরা স্বপ্ন আরও খানিকটা নাগালে এল।
নাশিদ কামাল বলেন, ‘পেছনের কথা ভুলে এসে রোদের ছটা মাখার কথা আছে গানে। সঙ্গে মনের দুয়ার খোলার আহ্বানও করা হয়েছে। মনের দুয়ার খোলা না রাখলে আমরা সংকীর্ণ হয়ে যাব। সূর্যটা আমাদের একত্র করেছে, সারা পৃথিবীতে আলো দিয়েছে। রোদ ও আলো—এসব দুনিয়ার সবার জন্য। গানে জীবনের জয়গান করে এগিয়ে যাওয়ার বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করেছি।’

জাগো পিয়া গানের রেকর্ডিং
ছবি: সংগৃহীত

যুক্তরাষ্ট্রের বার্কলে কলেজ অব মিউজিকের সাবেক শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের নিয়ে ‘বার্কলে ইন্ডিয়ান অনসম্বল’–এর প্রথম অ্যালবাম ‘শুরুয়াত’। হিন্দি শব্দ শুরুয়াত অর্থ শুরু; প্রথম অ্যালবামেই বাজিমাত করল বার্কলে ইন্ডিয়ান অনসম্বল। বিশ্বের নামকরা এ সংগীত বিদ্যায়তনে বাংলাদেশের প্রথম শিক্ষার্থী ছিলেন আরমীন।
আগামী বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি গ্র্যামিতে মনোনয়ন পাওয়া শিল্পী, অ্যালবামের মধ্যে চূড়ান্তভাবে নির্বাচিতদের নাম প্রকাশ করা হবে। আরমীনদের ‘শুরুয়াত’ অ্যালবামে যে বিভাগে মনোনয়ন পেয়েছে, সেই বিভাগে আনুশকা শঙ্করসহ বিশ্বের নামকরা কয়েকজন শিল্পীর অ্যালবাম জায়গা পেয়েছে।
কয়েক বছর আগে ‘ঘাসফড়িং কয়্যার’ নামে একটি গানের দল গড়ে তোলেন আরমীন। তাঁর মা নাশিদ কামাল একজন নজরুলসংগীতশিল্পী, লেখক ও অধ্যাপক।