যেভাবে তৈরি হলো ‘মুড়ির টিন’

‘চুইঝাল খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তোলার একটা অংশ আছে গানে। এই ঢেকুর নিয়ে সে কী টেনশন। ঠিক সময়ে আসবে তো? মানে একটা ঢেকুর পুরো একটা সেটের এতগুলো মানুষের চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়াবে—তা ভাবলে এখন মজাই লাগে। এমন টুকরা টুকরা অনেক ঘটনা আছে মুড়ির টিন গান তৈরির পেছনে।’ বললেন গানটির সংগীত পরিচালক শুভেন্দু দাস।
কোক স্টুডিও বাংলা সিজন টুর প্রথম গান ‘মুড়ির টিন’। ১৪ ফেব্রুয়ারি ইউটিউব চ্যানেল গানটি প্রকাশ হওয়ার পর থেকেই বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় লেখা হয়েছে গানের মূল অংশ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সিলেট ও খুলনার ভাষায় র‌্যাপ। এ কয় দিনেই গানটির ইউটিউবে দর্শক কয়েক লাখ। বাস, বাসযাত্রী, ড্রাইভার, হেল্পার মিলিয়ে বাসযাত্রার একটা চিত্র উঠে এসেছে এ গানে। পাশাপাশি চমৎকার সংগীতায়োজন, নানা ধরনের সংগীতযন্ত্র যুক্ত করায় এটি হয়ে উঠেছে বেশ উপভোগ্য। গানটির ভিডিও নির্মাণের পেছনে রয়েছে চমৎকার সব গল্প।

সংগীত পরিচালক শুভেন্দু দাসের মুখেই শোনা যাক মজার গল্পগুলো—‘কোনো কাজ যে এত আনন্দ নিয়ে করা সম্ভব, তা কোক স্টুডিও বাংলার কাজ দেখেই বোঝা যায়। আমাদের কিউরেটর অর্ণব একজন চমৎকার মিউজিশিয়ান, চমৎকার মানুষ। তাঁর হাত ধরে আমরা আমাদের কাজটুকু স্বাধীনভাবে করেছি। কোনো বাধা–ধরা বিষয় ছিল না। সেই ধারাবাহিকতায় প্রতিটি মানুষ তাঁর সর্বোচ্চটুকু দিয়ে চেষ্টা করেছেন। আমাদের টিমের যে মাইশা মরিয়াম আছেন, তিনি বড় পরিসরে আগে হারমোনিকা বাজাননি। কিন্তু কোক স্টুডিও বাংলার জন্য তিনি রাজশাহী থেকে ঢাকায় এসে চমৎকারভাবে কাজ করেছেন। জার্মানি থেকে এসেছেন অপূর্ব, তিনি হর্ন সেকশনে কাজ করেছেন। ট্রাম্প প্যাডে ছিলেন কাবিল ভাই। গানের দৃশ্যায়নের জন্য মিথুন চাচার একের পর এক পান খেয়ে যাওয়া—সবকিছু মিলিয়ে চমৎকার একটা অভিজ্ঞতা ছিল।’

বাদ্যযন্ত্র ও বাদ্যকারদের যুক্ত করা সম্পর্কে গানটির শিল্পী রিয়াদ হাসান বলেন, ‘বাংলাদেশে সংগীতশিল্পীরা তাঁদের মনের খোরাক মেটানোর জন্য গান করবেন—এমন প্ল্যাটফর্ম খুব কম। কোক স্টুডিও বাংলা সেটা করেছে। আমরা মনের আনন্দে প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করে এ গানের দৃশ্যায়ন সম্পন্ন করেছি।’
দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে এসে শিল্পীরা এই আয়োজনে যুক্ত হয়েছেন। মুড়ির টিনে হারমোনিকা বাজিয়েছেন মাইশা মারিয়াম। মুড়ির টিনের দৃশ্যায়ন এবং এতে কাজ করার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমি এমনিতেই হারমোনিকা বাজাতাম। শুভেন্দুদার মাধ্যমে গানটিতে যুক্ত হই। গানের দৃশ্যধারণের প্রতিটি দিন, প্রতিটি ক্ষণ আমার সারাজীবনে স্মরণ করার মতো চমৎকার স্মৃতি হয়ে রইল। মুড়ির টিনে অসাধারণ শিল্পীদের সঙ্গে কাজ করেছি। কোক স্টুডিও বাংলা সবার কাজকে গুরুত্ব দেয় বলেই গানটি এত ভালো হয়েছে।’

একটা আস্ত বাস সংগ্রহ করা, সেটাতে রিকশাচিত্র আঁকার পরিকল্পনা থাকলেও শেষমুহূর্তে অন্য ধাঁচে করা হয়। মুড়ির টিন গানের সঙ্গে মিল রেখে স্টুডিওতে বেশ কয়েকটি সত্যিকারের মুড়ির টিন এনে রাখা।

একটা আস্ত বাস সংগ্রহ করা, সেটাতে রিকশাচিত্র আঁকার পরিকল্পনা থাকলেও শেষমুহূর্তে অন্য ধাঁচে করা হয়। মুড়ির টিন গানের সঙ্গে মিল রেখে স্টুডিওতে বেশ কয়েকটি সত্যিকারের মুড়ির টিন এনে রাখা। লোকাল বাসে যাত্রী ওঠানোর সময় বাসের গায়ে থাপ্পড় দিলে যে রকম শব্দ হয়, তার মূল ভাব ফুটিয়ে তোলার জন্য টিনের ট্রাংক ব্যবহার করা হয়। বাস থামার লাল-সবুজ-হলুদ সংকেত কিংবা ‘হর্ন নিষেধ’—সব ধরনের সাইনবোর্ড ছিল গানের দৃশ্যায়নে।

‘আমি প্রতিদিন অবাক হতাম স্পটে নানা ধরনের বস্তু দেখে। মুড়িসহ মুড়ির টিন, বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র, বাস স্টপেজ এবং জেব্রা ক্রসিং আইডিয়াসহ নানা কিছু আমার শিল্পনির্দেশক রাজিম আহমেদ করে ফেলতেন। দিনের শুরুতেই রাজিমের একটা সারপ্রাইজের ব্যাপার থাকত। এত ব্রিলিয়ান্ট শিল্পনির্দেশনাও গানটিকে দর্শকের হৃদয়ে স্থান করে নেওয়ায় ভূমিকা রেখেছে।’ বললেন গানটির ভিডিও পরিচালক কৃষ্ণেন্দু  চট্টোপাধ্যায়।
মুড়ির টিন গানের সহশিল্পীরা প্রতি মুহূর্তে আঞ্চলিক ভাষার অনুশীলন করেছেন। এটা সবার জন্য চমৎকার এবং অনন্য অভিজ্ঞতা বলেই তাঁরা মনে করেন। কোক স্টুডিও বাংলার কল্যাণে এমন চমকপ্রদ গানে অংশগ্রহণের মাধ্যমে দর্শক–শ্রোতার মনে ঠাঁই করে নেওয়ার সুযোগ পেয়ে নিজেদের সৌভাগ্যবান মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।