তিনিই শুধু নেই

গাজী মাজহারুল আনোয়ার

ব্যবহারের সেই চশমাটা পড়ে আছে। শোবার ঘরে ছোট্ট ওয়ার্ডরোবের ওপর কলমদানিতে থরে থরে সাজানো কয়েকটি কলম। আছে একাধিক ডায়েরিও, যেখানে তিনি লেখালেখি করতেন। পছন্দের সব সুগন্ধির বোতলও এদিক–ওদিক ছড়িয়ে আছে। গতকাল রোববার বেলা দেড়টায় বারিধারা পার্ক রোডে গাজী মাজহারুল আনোয়ারের বাড়ির চিত্র এটি। আমন্ত্রণ ছাড়াই এই বাড়িতে গতকাল ছুটে এসেছিলেন সবাই। ঘরভর্তি মানুষের আনাগোনায় কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি বাড়ির প্রধান মানুষটিকে। সবাই যখন এঘর–ওঘর করছেন, তখন গুলশানের একটি হাসপাতালের হিমঘরে নিথর শুয়ে ছিলেন তিনি। বাড়িতে আসা চোখগুলো তাই খুঁজে পাচ্ছিল না তাঁকে। ঘরের দেয়ালে দেয়ালে টাঙানো নানান সময়ের স্থিরচিত্র দেখে সবারই চোখের কোণে জল, কেউ চোখ মুছছিলেন আঁচলে, কেউবা রুমালে। শোবার ঘরের এক কোণে চিৎকার করে কাঁদছিলেন বয়োজ্যেষ্ঠ এক নারী। মেয়ে জোহরা গাজীর স্বামী দেশবরেণ্য গীতিকবি গাজী মাজহারুল আনোয়ারকে হারিয়ে শোকাতুর তিনি।

গাজী মাজহারুল আনোয়ার

৭৯ বছর বয়সে রোববার সকালে মারা যান গাজী মাজহারুল আনোয়ার। সকালে বাসা থেকে হাসপাতালে নেওয়ার কিছুক্ষণ পরই চিকিৎসকেরা জানান, তিনি মারা গেছেন। হাসপাতালে ছোটাছুটি করে বাবাকে হিমঘরে রেখে দুপুরে বাসায় এসেছিলেন ছেলে সরফরাজ আনোয়ার উপল। পার্ক রোডের বাড়িতে বাবার শোবার ঘরে ঢুকেই তাঁর চোখে পড়ল সেই চশমা। হাতে নিয়েই চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করেন। নানিসহ অন্য সবাইকে দেখিয়ে বলছিলেন, ‘আব্বুকে এই চশমাটা দেশের বাইরে থেকে এনে দিয়েছিলাম। আমার আব্বু চশমাটা রেখে চলে গেছে...আব্বু আমার পারফিউম কী যে পছন্দ করত। সবগুলোই আব্বুর পারফিউম। পৃথিবীর যেখানেই যেতাম, তার একটাই আবদার, আমার জন্য পারফিউম নিয়ে আসবে। আমার আব্বুর আর কোনো চাওয়া ছিল না।’

গাজী মাজহারুল আনোয়ারের শোবার ঘরে দেয়ালে একটি স্থিরচিত্র ঝুলছিল। সেটি দেখিয়ে উপল জানালেন, এটি তাঁর মা–বাবার বিয়ের ২৫ বছর পূর্তির সময় তোলা। ২৪ সেপ্টেম্বর মা–বাবার বিয়ের ৫০ বছর পূর্তি হবে। অনেক পরিকল্পনা করে রেখেছিলেন উপল ও তাঁর বোন দিঠি আনোয়ার। কিন্তু সব পরিকল্পনা পরিকল্পনাই রইল, সবাইকে কাঁদিয়ে তিনি পাড়ি জমালেন অনন্তের পথে।

গাজী মাজহারুল আনোয়ার
ছবি : সংগৃহীত

সারা দিনই গাজী মাজহারুল আনোয়ারের পরিবারকে সান্ত্বনা দিতে এসেছিলেন চলচ্চিত্র ও সংগীতাঙ্গনের অনেকে। ছিলেন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, ঢাকা উত্তরের মেয়রসহ আরও অনেকে। ছিলেন আবিদা সুলতানা, রফিকুল আলম, সুচরিতা, উজ্জ্বল, শাকিব খান, মনির খান, অপু বিশ্বাসসহ আরও অনেকে।

কেউবা সরাসরি যান হাসপাতালে, কেউ গিয়েছিলেন হাসপাতাল, বাসা—দুই জায়গাতেই। সবারই চোখে ছিল জল, কণ্ঠ ছিল কান্নাজড়ানো, দৃষ্টিতে ছিল শূন্যতা। ইন্ডাস্ট্রির অভিভাবকসম গাজী মাজহারুল আনোয়ারকে আকস্মিকভাবে হারিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন সংগীতশিল্পী আবিদা সুলতানা, অভিনেত্রী সুচরিতা ও সংগীতশিল্পী মনির খান। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী রফিকুল আলম তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘গাজী ভাইয়ের তো অনেকগুলো পরিচয়। কিন্তু তিনি আমাদেরই মানুষ, গানের মানুষ। তাঁর অবদান সম্পর্কে অনেক দীর্ঘ কথা বলতে হবে, সেটা এখন বলতে চাই না। বাংলাদেশ তথা তৎকালীন পূর্ববঙ্গে কবিতা ও আধুনিক গীতিকবিতা লেখার মানুষ খুব কম ছিলেন। তিনি একজীবনে যত গান লিখেছেন, তার একটিও বিফলে যায়নি। এটা খুব বিরল। বাংলা সাহিত্য ও গানে কোথাও এত বড় গীতিকবি নেই, যার প্রতিটা গান মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছে। তাঁর লেখা ও সুরে আমি অনেক গান গেয়েছি। ফলে তাঁর চলে যাওয়ার ব্যথা নিয়েই পথ চলতে হবে, কাজ করতে হবে।’

গাজী মাজহারুল আনোয়ার

আবিদা সুলতানাকে সন্তানের মতো স্নেহ করতেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার। তাই গানের গণ্ডি ছাড়িয়ে আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তাঁদের মধ্যে। তিনি বললেন, ‘এক এক করে ওনারা সবাই চলে যাচ্ছেন। অনেক বড় অভিভাবককে হারালাম। গাজী ভাই প্রচণ্ড সফল একজন মানুষ ছিলেন। যেদিকে তিনি হাত দিয়েছেন, সেদিকে সোনা ফলেছে। আসলে গাজী ভাই চলে যাওয়াতে মনে হচ্ছে, মাথার ওপরে আর কেউ নেই! খালি খালি লাগছে! গাজী ভাই আদর করতেন, ভালোবাসতেন। তাঁকে ভাই বলতাম। কিন্তু বাবার মতো ভালোবাসতেন। কাছে ডেকে বসাতেন, কথা বলতেন।’ বাসায় কাঁদতে কাঁদতে সুচরিতা বলেন, ‘আজ আমার নাম সুচরিতা। এটা গাজী মাজহারুল আনোয়ার আমাকে দিয়েছেন। তাঁকে হারিয়ে ফেলা মানে অভিভাবক হারিয়ে ফেলা।’ বাসা থেকে বের হওয়ার সময় সংবাদমাধ্যমকে শাকিব খান বলেন, ‘বাংলাদেশ যত দিন থাকবে, তত দিন যে মানুষগুলোর নাম উচ্চারিত হবে, তার মধ্যে একজন গাজী মাজহারুল আনোয়ার চাচা। মুক্তিযুদ্ধ, দেশপ্রেম বা চলচ্চিত্র—সব ঘরানার গান তিনি রচনা করেছেন। কোন অঙ্গনে তাঁর পদচারণ নেই, কোন অঙ্গনে সফলতা পাননি তিনি? আমার খুব শ্রদ্ধাভাজন একজন মানুষ ছিলেন তিনি। তাঁকে সব সময় পাশে পেয়েছি। তাঁর বিদায়ে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে, তা অপূরণীয়। তিনি এমন একজন ব্যক্তিত্ব, কিংবদন্তি, যাঁর সিনেমায় অভিনয় করার সুযোগ পাওয়া সত্যি খুব আনন্দের। কিন্তু আমি আর সেই সুযোগ পেলাম না। এই আফসোসটা আমার রয়েই গেল।’

বাসায় ঢুকে কাঁদতে কাঁদতে মনির খান বললেন, ‘এই জাতি হারাল তার অমূল্য সম্পদ, আমি হারালাম আমার গানের এক অভিভাবক শ্রদ্ধেয় কাকাকে। কাকার সঙ্গে দেখা হলে বা ফোন করে বলবে না মনির চলে আসো, বসব নতুন গান নিয়ে। কাকা আপনি বেঁচে থাকবেন সবার মাঝে আপনার গান এবং চলচ্চিত্রের মাধ্যমে।’ একজীবনে গাজী মাজহারুল আনোয়ার ২০ হাজারের অধিক গান লিখেছেন। তাঁর লেখা গানে কণ্ঠ দিয়েছেন সব বয়সী শিল্পীরা। মৃত্যুর এক দিন আগপর্যন্ত তিনি গান লেখার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, যেটা তিনি সব সময় চেয়েছিলেন।’