গারো গান: মায়ের ভাষায় গান করেন অন্টু রিছিল

মায়ের ভাষায় গান পরিবেশন করে প্রশংসা কুড়িয়েছেন নেত্রকোনার গারো সংগীতশিল্পী অন্টু রিছিল মারাক; দেশের গণ্ডি পেরিয়ে ভারতের মেঘালয়, আসামেও পরিচিতি পেয়েছেন তিনি। এ সময়ে গারো সম্প্রদায়ের শীর্ষ শিল্পীদের একজন হিসেবে বিবেচনা করা হয় তাঁকে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে তাঁকে নিয়ে এই প্রতিবেদন।

গারো সংগীতশিল্পী অন্টু রিছিল মারাকশিল্পীর সৌজন্যে

গারো ভাষায় বেড়ে উঠেছেন তিনি। শৈশবে অন্টু রিছিলের শেখা প্রথম বুলি ছিল ‘আ’মা’; মানে ‘মা’। মায়ের ভাষাকে পরের প্রজন্মের কাছে ছড়িয়ে দিতে গান করছেন তিনি। নিজের লেখা গানে নিজেই সুর তোলেন। অন্টু গারোদের আচিক ভাষায় গান করেন তি‌নি, এটিই গারো ভাষা বলে পরিচিত।

নেত্রকোনার দুর্গাপুর উপজেলার বিরিশিরি ইউনিয়নের সোমেশ্বরী নদীর কোলে তেলুঞ্জিয়া গ্রামে অন্টুর জন্ম। এখানেই পরিবার নিয়ে বাস করছেন ৩৭ বছর বয়সী এই শিল্পী, সুরকার ও গীতিকার।

১০ বছর বয়সে গ্রামে কীর্তন শিখেছেন; টুকটাক কবিতাও লিখতেন। বছর দুয়েক ধরে পেশাদারভাবে গান করছেন তিনি। অল্প সময়ের মধ্যেই গারো সম্প্রদায়ের শ্রোতাদের মধ্যে আলোড়ন তুলেছেন। তাতে ইউটিউবে কিংবা কনসার্টে হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন শ্রোতারা।

শুধু গারো ভাষায় গান করেন অন্টু রিছিল
ছবি: শিল্পীর সৌজন্যে

গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অন্টু রিছিল জানান, ২০২২ সালের ১০ মার্চ তাঁর প্রথম গান ‘না আংনি’ (তুমি আমার) প্রকাশিত হয়। সেই বছরের জানুয়ারিতে তিনি গানটি লিখেছেন, ফেব্রুয়ারির দিকে নেত্রকোনায় রেকর্ড করেছেন।

২০২২ সালের ২৮ জুলাই অন্টুর দ্বিতীয় গান ‘আরারা’ প্রকাশের পর গানটি মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়েছে। গারো সম্প্রদায়ের বাইরের শ্রোতারাও এই গানে মজেছেন। গানের ভিডিওটি ৬৭ লাখের বেশি বার দেখা হয়েছে।

গান প্রকাশের জন্য কোনো রেকর্ড লেবেলের পেছনে ধরনা দেননি অন্টু রিছিল; নিজের নামে খোলা ইউটিউব চ্যানেলেই প্রকাশ করেছেন। ২০২০ সালের দিকে খোলা ইউটিউব চ্যানেলে কোনো সাবস্ক্রাইবারই ছিল না; গান প্রকাশের পর হু হু করে সাবস্ক্রাইবার বাড়তে থাকে। গানের ভিডিও চিত্রটি এখন পর্যন্ত ইউটিউবে ৪৭ লাখ বার দেখা হয়েছে।

তখনো তাঁর পরিচিতি গারো সম্প্রদায়ের গণ্ডির মধ্যেই ছিল। ২০২২ সালের ২৮ জুলাই দ্বিতীয় গান ‘আরারা’ প্রকাশের পর গানটি মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়েছে। গারো সম্প্রদায়ের বাইরের শ্রোতারাও এই গানে মজেছেন। গানের ভিডিওটি ৬৭ লাখের বেশি বার দেখা হয়েছে।

দেশের গণ্ডি পেরিয়ে ভারতের মেঘালয়, আসাম, ত্রিপুরা ও নাগাল্যান্ডের বসবাসকারী গারো সম্প্রদায়ের মধ্যেও গ্রহণযোগ্য পেয়েছেন তিনি। গারো ছাড়াও বাঙালি, রাভা জনগোষ্ঠীর শ্রোতারাও তাঁর গানে মজেছেন। তিনি শুধু গারো ভাষায় (আচিক) গান করেন; দুই বছরে এক ডজনেরও বেশি মৌলিক গান প্রকাশ করেছেন।

ভারতেও সমানে শো করছেন তিনি। গত তিন মাসে দেশটির মেঘালয়ের খাসি হিলস, গারো হিলস ও আসামের বিভিন্ন এলাকায় ১০টির মতো শো করেছেন অন্টু রিছিল। গত শনিবারও মেঘালয়ের ডালু থেকে গান করে নেত্রকোনায় ফিরেছেন তিনি।

গারো–অধ্যুষিত ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট, ধোবাউড়া; নেত্রকোনার কলমাকান্দা; শেরপুরের নালিতাবাড়ী, ঝিনাইগাতী; টাঙ্গাইলের মধুপুরের নিয়মিত শো করেন অন্টু রিছিল। ঢাকার বারিধারায় গারোদের ওয়ানগালা উৎসবেও গান করেছেন তিনি।

ভারতেও সমানে শো করছেন তিনি। গত তিন মাসে দেশটির মেঘালয়ের খাসি হিলস, গারো হিলস ও আসামের বিভিন্ন এলাকায় ১০টির মতো শো করেছেন অন্টু রিছিল। গত শনিবারও মেঘালয়ের ডালু থেকে গান করে নেত্রকোনায় ফিরেছেন তিনি। মেঘালয়ের তুরাতে এই সপ্তাহে আরও দুটি শো ছিল, ভিসার মেয়ার শেষ হওয়ায় বাতিল করতে হয়েছে তাঁকে।

ভারতেও তুমুল জনপ্রিয় এই শিল্পী; আসাম, মেঘালয়ে নিয়মিত শো করেন
ছবি: শিল্পীর সৌজন্যে

অন্টুর গান আলাদা কোথায়
বাংলাদেশ ও ভারতে গারো ভাষায় বহু শিল্পী গান করেছেন। গারো সম্প্রদায়ের মাঝে লোকসংগীত ‘রে রে’-এর বেশ চল রয়েছে। পাশাপাশি মেলোডি গানেরও চর্চা হয়। এর মধ্যে অল্প সময়ের মধ্যেই অন্টু কীভাবে শ্রোতাদের হৃদয়ে জায়গা করে নিলেন? গারো গানে পপ ধারাকে তুলে ধরেছেন তিনি; এটিই মূলত অন্টুকে আলাদা করেছে।

শ্রোতাদের অনেকে ইউটিউবের মন্তব্যের ঘরে লিখেছেন, অন্টুর গলায় পপ গানটা ভালো যায়; ভিন্নমাত্রা যোগ করে। গারো সম্প্রদায়ে পপ গানের চল না থাকায় অনেকে সমালোচনা করেছেন; তবে গানের কথা-সুরের স্রোতে হালে পানি পায়নি।

সঙ্গে আরেকটা কারণ বললেন অন্টু, ‘নিজের লেখা গানে নিজে সুর করি বলে সুরের সঙ্গে কথাগুলো হয়তো শ্রোতাদের কাছে জুতসই লাগে।’
একসময় গারো সম্প্রদায়ের বিয়েতে হিন্দি ও ইংরেজি গান বাজানো হতো। এখন অনেক বিয়েতেই অন্টুর গান বাজানো হয়।

ওয়ানগালা উৎসবে গাইছেন অন্টু
ছবি: শিল্পীর সৌজন্যে
গানের মাধ্যমে আমি গারো ভাষাকে ছড়িয়ে দিতে চাই। গান শুনে ভাষার প্রতি শ্রোতাদের ভালো লাগা তৈরি হতে পারে।
অন্টু রিছিল মারাক

মায়ের ভাষাকে ছড়িয়ে দিতে চান

‘আমাদের মধ্যে যাঁরা শহরে পড়াশোনা করেন, গারো ভাষায় অনেক শব্দ বলতে পারেন না। গানের মাধ্যমে আমি গারো ভাষাকে ছড়িয়ে দিতে চাই। গান শুনে ভাষার প্রতি শ্রোতাদের ভালো লাগা তৈরি হতে পারে।’ বলেন অন্টু রিছিল মারাক।

গারো সম্প্রদায়ের শিশুরা জন্মের পর পাঁচ বছর পর্যন্ত শুধু গারো ভাষায় কথা বলে। তবে গারো ভাষায় পাঠক্রম না থাকায় স্কুলে ভর্তির পর শিশুদের বাংলা ভাষা শিখতে হয়।

দুই বছরের ক্যারিয়ারে এক ডজনের বেশি গান করেছেন তিনি
ছবি: শিল্পীর সৌজন্যে

অন্টুর ভাষ্যে, ‘স্কুলে ভর্তির পর গারো শিশুদের বাংলা ভাষা অ্যাডাপ্ট করছে। ফলে আমাদের ভাষা স্বয়ংক্রিয়ভাবে চাপে পড়ে যায়। গারো ভাষায় পড়ার কোনো সুযোগ নেই। ফলে ঘরে বাইরে গারো ভাষায় কথার মাধ্যমে শিশুরা ভাষাটি চর্চা করছে।’
প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ভাষাটিকে টিকিয়ে রাখতে গান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করেন অন্টু রিছিল। তিনি বলেন, ‘দেশে গারো ভাষা নিয়ে তেমন গবেষণা। গানের মাধ্যমে হলেও যেন নিজস্ব ভাষাকে লালন করতে পারি, টিকিয়ে রাখতে পারি।’

৯ বছর বয়সী মেয়ে, ১৫ মাসের ছেলে আর স্ত্রীকে নিয়ে অন্টুর সংসার। তিনি গানের পাশাপাশি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। আগামী মার্চে ‘খাসারা’ শিরোনামে নতুন গান প্রকাশ করবেন তিনি।

কনসার্টে অন্টু রিছিল ও তাঁর দলের সদস্যেরা
ছবি: শিল্পীর সৌজন্যে
আরও পড়ুন