সংগীতে ‘কমল’ স্পর্শ

আট হাজার গানের সুর করেছেন কমল দাশগুপ্ত

উপমহাদেশের অন্যতম গুণী সুরকার ও সংগীতজ্ঞ কমল দাশগুপ্ত। বহু কালজয়ী গানসহ প্রায় আট হাজার গানের সুর করেছেন তিনি। আধুনিক, নজরুলসংগীত থেকে শুরু করে ইসলামি গান, ভজন, কীর্তন, গীত-গজল ইত্যাদি। আজ তাঁর ১১০ তম জন্মবার্ষিকী। কমল দাশগুপ্তর জন্ম হয় ১৯১২ সালের ২৮ জুলাই, যশোর জেলার দকালিয়া গ্রামে। এই তো কিছুদিন আগে, অর্থাৎ ২০ জুলাই ছিল তাঁর ৪৮ তম প্রয়াণদিবস। তিনি আমার বাবা, আমি তাঁর গর্বিত সন্তান।

বাবা তখনকার কলকাতায় ঠুমরির রাজা ওস্তাদ জামির উদ্দিন খাঁর কাছে ওস্তাদের মৃত্যু অবধি ঠুমরি ও কৃষ্ণচন্দ্র দের কাছে সরগামের তালিম নিয়েছিলেন। শুরুর দিকে তিনি অনেক গান একক ও দ্বৈত কণ্ঠে রেকর্ড করেছেন ‘মাস্টার কমল’ নামে। বয়স কম থাকার কারণে নামের আগে ‘মাস্টার’ উল্লেখ করা হতো। এগুলোর মধ্যে বেশ কটি গান ওনার নিজের লেখা ও সুর করা।

১৯৩২ সালে মাত্র ২০ বছর বয়সে কমল দাশগুপ্ত গ্রামোফোন কোম্পানির টুইন রেকর্ড বিভাগের ট্রেইনার ও কম্পোজার পদে যোগ দেন। পরের ৩০ বছর তিনি গ্রামাফোন কোম্পানিতে প্রধান সংগীত পরিচালক ও ট্রেইনার হিসেবে কাজ করে গেছেন।

১৯৩৪ সালে কমল দাশগুপ্তর সুরে, প্রণব রায়ের কথায় ও যুথিকা রায়ের কণ্ঠে কালজয়ী দুটি গান ‘আমি ভোরের যুথিকা’ ও ‘সাঁঝের তারকা আমি’ প্রকাশিত হয়। ওই সময়ের বিক্রির সব রেকর্ড ভেঙেছিল গান দুটি। বলা যায়, এই দুই গানের মাধ্যমে আধুনিক বাংলা গানের জন্ম হয়।

কমল দাশগুপ্ত (২৮ জুলাই ১৯১২-২০ জুলাই ১৯৭৪)

গ্রামোফোন কোম্পানিতে কাজ করতে এসেই কমল দাশগুপ্তর সংযোগ ঘটল কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে। দুজনের মধ্যে মানসিক বন্ধন গড়ে উঠল। কাজী নজরুল ইসলাম স্বচ্ছন্দে ওনার লেখা গান তুলে দিতেন কমল দাশগুপ্তর হাতে, সুর করার জন্য। অন্যান্য গুণীজন নজরুলের গানে সুর করলেও কমল দাশগুপ্তর সুরারোপিত গানের সংখ্যাই বেশি, প্রায় ৪০০!

কমল দাশগুপ্তর সুরারোপিত প্রথম বাংলা চলচ্চিত্র পণ্ডিতমশাই ১৯৩৬ সালে মুক্তি পায়। ১৯৬৭ সালে মুক্তি পায় তাঁর শেষ চলচ্চিত্র বধূবরণ। এর মধ্যে ৮০টি বাংলা ও হিন্দি চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালনা করেছেন তিনি, যার মধ্যে ৫টি ছবিতে শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালকের পুরস্কার পেয়েছিলেন।

বাবা কমল দাশগুপ্ত ও মা ফিরোজা বেগম

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ভারতে নির্মিত মার্কিন চলচ্চিত্র ওয়ার প্রপাগান্ডার ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকও করেছিলেন কমল দাশগুপ্ত। প্রতি মাসে গড়ে ৪৫টি গান সুর করে, শিল্পীকে শিখিয়ে রেকর্ড করার অনন্য কৃতিত্ব তাঁর। ইস্টার্ন ও ওয়েস্টার্ন সংগীতের স্বরলিপি ও নোটেশনের সমন্বয়ে কমল দাশগুপ্ত উদ্ভাবন করেছিলেন এক নতুন পদ্ধতির স্বরলিপি ‘শর্টহ্যান্ড নোটেশন’। শুনেছি, ১৯৪৩ সালে চরম দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষদের পাশে থেকে, গ্রামোফোন কোম্পানির মহল্লায় প্রতিদিন শত শত মানুষকে খাওয়াতেন ও কাপড়চোপড় দান করতেন বাবা। সেই মানুষটিকে নিত্যসঙ্গী কাজী নজরুলের অসুস্থতা, গানের প্রেরণা দাদা বিমল দাশগুপ্ত ও অনুজ সুবল দাশগুপ্তর অকালমৃত্যু, পাইওনিয়ার ব্যাংক দেউলিয়ার কারণে সঞ্চিত অর্থনাশ আর্থিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে দেয় একসময়। এসব কারণে ১৯৬৭ সালে বাংলাদেশে (তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান) সপরিবার চলে আসেন তিনি। ছেড়ে আসেন তাঁর প্রিয় সংগীতময় লীলাক্ষেত্র প্রিয় কলকাতাকে।

১৯৫৫ সালে কমল দাশগুপ্ত বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী ফিরোজা বেগমের সঙ্গে, যিনি তাঁরই শিষ্য হয়ে নজরুলসংগীতের সম্রাজ্ঞী হয়ে উঠেছিলেন একনিষ্ঠ সাধনার ফলে। আমরা মা–বাবার তিন সন্তান তাহসিন, হামিন ও শাফিন আহমেদ। আমার শৈশবকালে বাবা কমল দাশগুপ্তর কাছ থেকে সংগীত বিষয়ে অল্প কিছু শিক্ষা নেওয়ার সুযোগ হয়েছিল। বাবা খুব ভালো তবলাবাদক ছিলেন। আমাকে তবলা বাজানো শিখিয়েছিলেন। মায়ের কাছে শিখেছিলাম কিছু নজরুলসংগীত ও বাবার সুর করা কিছু আধুনিক গান। এই অল্প কিছু শিক্ষা আমি কতটা কাজে লাগাতে পেরেছি জানি না, তবে যখন সংগীতে প্রবেশ করি এবং কিছু গান সুর করতে শুরু করি, তখন থেকেই মনে হয়েছে, বাবা পাশে থাকলে কত কিছু শিখতে পারতাম! সংগীত নিয়ে যতই কাজ করেছি, ততই মনে হয়েছে, বাবার সান্নিধ্য খুব দরকার ছিল। চলতে চলতে বাবার গানগুলো অন্যভাবে উপলব্ধি করতে শুরু করলাম।

বিয়ের পর সংগীতশিল্পী ফিরোজা বেগমের সঙ্গে কমল দাশগুপ্ত

ওনার প্রতি ট্রিবিউট হিসেবে ‘কত দিন দেখিনি তোমায়’ শিরোনামে ১১টি আধুনিক গানের সংকলনে অ্যালবামের কাজ শুরু করলাম। তখন প্রায় তিন মাস অন্য কোনো গান শুনিনি, শুনতে ইচ্ছাও করেনি। বাবার সুরে এমন জাদু রয়েছে, যার মধ্যে শ্রোতাকে আকৃষ্ট করার একটা মোহ রয়েছে। সেই সুরের জাদুতে একবার প্রবেশ করলে সেখান থেকে আর বের হতে ইচ্ছা করে না। প্রতিটি গানে এমন বৈচিত্র্যময় সুর, অথচ পুরো গান শুনে মনে হবে একসুতায় গাঁথা। এ কীভাবে সম্ভব, আমার জানা নেই।

রাগাশ্রয়ী গানের সুরগুলোকে দক্ষতার সঙ্গে কত আধুনিক করে তিনি তুলে ধরেছিলেন শ্রোতাদের কাছে! রাগাশ্রয়ী গান মানেই যে ভারী গান নয়। সেগুলো শ্রোতৃপ্রিয়তা পাওয়ার জন্য যা যা প্রয়োজন, সবই ছিল ওনার সুরের মধ্যে। বাবার সঙ্গে কিছু আনন্দঘেরা স্মৃতি রয়েছে। বাবা ক্রিকেট খেলা খুব পছন্দ করতেন।

বাবার গান করছেন শাফিন আহমেদ

তখন আমাদের বাসায় টেলিভিশন আসেনি, তবে শীতের সকালে বাসার ছাদে আমরা তিন ভাই বাবার সঙ্গে অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, ইন্ডিয়া টিমগুলোর খেলার কমেন্ট্রি শুনতাম রেডিওতে অ্যানটেনা উঁচু করে। বক্সিং নিয়েও গল্প হতো অনেক। বাবা ঢাকায় আসার পর আমাদের পড়াতেন প্রতিদিন। সব সাবজেক্টই পড়াতেন। কোনো কোনো সময় খুব কড়া হতেন। রাগ করেছেন অনেক সময়। পালিয়ে গিয়ে পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলতাম যখন, তিনি মাঝেমধ্যে গিয়ে মাঠ থেকে আমাদের ধরে নিয়ে আসতেন। কিশোর বয়সে কিছু না বুঝেই যখন ড্রাম পেটাচ্ছি, গিটার হাতে নিয়ে বাজানোর চেষ্টা করছি, তখন বাবা দূর থেকে খেয়াল করেছেন সবই। আমাদের এই আগ্রহ দেখে বাবা একটা নোট লিখে দিয়ে গিয়েছিলেন আমাদের সবার প্রিয় শ্রদ্ধেয় মুস্তাফা মনোয়ার সাহেবের কাছে, যিনি তখন বাংলাদেশ টেলিভিশনের ডিজি ছিলেন। সেখানে তিনি লিখেছিলেন, ‘ওদের একটু দেখে রাখিস, মনে হয় কিছু হবে।’ আজকের এই দিনে মা–বাবা দুজনেরই আত্মার শান্তি কামনা করি। শাফিন আহমেদ, সংগীতশিল্পী