টপ চার্টে এআই ব্যান্ড! শিল্পীদের সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ

এআই ব্যান্ড দ্য ভেলভেট সানডাউনের সদস্যরাছবি: ব্যান্ডের ইনস্টাগ্রাম থেকে

মাস দুই আগে যাত্রা শুরু করে দ্য ভেলভেট সানডাউন। দ্রুতই ইউটিউব, স্পটিফাইসহ একাধিক স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মের টপ চার্টে উঠে আসে রক ব্যান্ডটির গান। শ্রোতারা প্রথমে ভেবেছিলেন, এটি হয়তো নতুন কোনো ব্যান্ড। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের ছবি নিয়ে শুরু হয় সন্দেহ। পরে জানা যায়, পুরো ব্যান্ডটিই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) দিয়ে তৈরি!

ব্যান্ডটির প্রথম অ্যালবাম ‘ফ্লোটিং অন ইকোজ’ প্রকাশ পায় গত ৫ জুন। অ্যালবামের গান ‘ডাস্ট অন দ্য উইন্ড’ গত ২৯ জুন থেকে ১ জুলাই পর্যন্ত যুক্তরাজ্য, নরওয়ে ও সুইডেনে স্পটিফাইয়ের দৈনিক ‘ভাইরাল ৫০’ চার্টে শীর্ষে ছিল। দ্য ভেলভেট সানডাউন স্পটিফাইয়ে নিজেদের পরিচিতিতে লিখেছে, ‘ব্যান্ডের সব চরিত্র, গল্প, গান, কণ্ঠ ও কথা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তৈরি। আমরা প্রযুক্তিকে একটি সৃজনশীল যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছি।’

বিশ্বসংগীতে শিল্পীদের সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ

সংগীতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার যে গতিতে বাড়ছে, ভবিষ্যতের জন্য তা অশনিসংকেত, বলছে ইন্টারন্যাশনাল কনফেডারেশন অব সোসাইটিজ অব অথরস অ্যান্ড কম্পোজার্স (সিআইএসএসি)। লেখক ও সুরকারদের অধিকার রক্ষার জন্য কাজ করা আন্তর্জাতিক এ সংস্থার সর্বশেষ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যদি এই গতিতে সংগীত তৈরিতে ব্যবহৃত হতে থাকে, তবে চার বছরের মধ্যে বিশ্বজুড়ে গান রচয়িতা ও সুরকারদের আয় ২০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে। বিশ্বজুড়ে প্রায় ৫০ লাখ সংগীত কারিগরের প্রতিনিধিত্বকারী এ সংস্থা মনে করছে, এআই যদি শিল্পীর জায়গা দখল করে নেয়, তাহলে মূল শিল্পীর স্বত্ব, রয়্যালটি ও কর্মসংস্থানের ওপর সরাসরি প্রভাব পড়বে।

রেকর্ড লেবেলগুলোর প্রতিনিধিত্বকারী প্রধান সংগঠন আন্তর্জাতিক ফোনোগ্রাফিক ইন্ডাস্ট্রি ফেডারেশন (আইএফপিআই)। চলতি বছরের ২৩ এপ্রিল আইএফপিআইয়ের প্রধান আইন কর্মকর্তা লরি রিচার্ড একটি নিবন্ধে বলেন, কোনো ধরনের অনুমতি বা লাইসেন্স ছাড়া এআই মডেলকে সাউন্ড রেকর্ডিং দিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া অন্যায় ও অনৈতিক।

লরি রিচার্ড মনে করেন, মানব শিল্পীরাই নতুন সংগীত তৈরির চাহিদা পূরণে যথেষ্ট দক্ষ। তবে প্রযুক্তিকে উপেক্ষা করাও বাস্তবসম্মত হবে না। তাই সংগীতে এআই ব্যবহারের আগে সঠিক লাইসেন্সিং ব্যবস্থা ও স্বচ্ছ নীতিমালা নিশ্চিত করাই জরুরি।

এআই ব্যান্ড দ্য ভেলভেট সানডাউনের সদস্যরা
ছবি: ব্যান্ডের ইনস্টাগ্রাম থেকে

প্ল্যাটফর্মগুলোর দোটানা

এআইনির্ভর গান নিয়ে জনপ্রিয়তা যেমন বাড়ছে, তেমনি স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মগুলো এখনো দ্বিধায় ভুগছে। স্পটিফাইয়ের মুখপাত্র জেরাল্ডিন ইগু এএফপিকে জানিয়েছেন, স্পটিফাই এআই দিয়ে তৈরি গানকে অগ্রাধিকার দেয় না বা মুনাফাও করে না। প্ল্যাটফর্মে থাকা প্রতিটি গানই লাইসেন্সপ্রাপ্ত তৃতীয় পক্ষের মালিকানাধীন, তাদের মাধ্যমেই আপলোড হয়।

অন্যদিকে স্পটিফাইয়ের প্রতিদ্বন্দ্বী স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম ডিজার বেশ সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছে। দ্য ভেলভেট সানডাউন ব্যান্ডের গানের পাশে প্ল্যাটফর্মটি একটি সতর্কবার্তা জুড়ে দিয়েছে। যেখানে লেখা হয়েছে, ‘এই অ্যালবামের কিছু গান কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে তৈরি হতে পারে’। ডিজার জানিয়েছে, ২০২৫ সালের এপ্রিলেই প্ল্যাটফর্মটিতে প্রতিদিন প্রায় ২০ হাজার এআইনির্ভর গান আপলোড হয়েছে, যা পুরো প্ল্যাটফর্মের ১৮ শতাংশ। জানুয়ারিতে এই হার ছিল মাত্র ১০ শতাংশ।
১৫ জুলাই থেকে ইউটিউব ঘোষণা দিয়েছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) দিয়ে তৈরি যেকোনো কনটেন্ট থেকে সব ধরনের আয়, যেমন বিজ্ঞাপনসহ মনিটাইজেশন সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়া হবে।

কী ভাবছেন শিল্পী ও শ্রোতারা

বাংলাদেশের সংগীতশিল্পী থেকে শ্রোতারাও এ পরিবর্তন নিয়ে চিন্তিত। ওয়ারফেজ ব্যান্ডের দলপ্রধান ও ড্রামার শেখ মনিরুল টিপু বলেন, যেসব তথ্য সামনে এসেছে, তা যদি সত্যি হয়, তবে বলব, এটা বেশ অ্যালার্মিং (আশঙ্কাজনক)। সৃজনশীল কাজগুলোও যদি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার হাতে চলে যায়, তবে বিশ্বব্যাপী সংগীতের একটা বড় অংশ কাজ হারাবে। তবে টিপু মনে করেন, প্রযুক্তিকে অস্বীকার করেও সামনে এগোনো যাবে না। তাই এটাকে কীভাবে কাজে লাগিয়ে সংগীতশিল্পীরা উপকৃত হবেন, সেদিকে কাজ করতে হবে।

গীতিকার রবিউল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা অশনিসংকেত। এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে এ খাতের মানুষদের কাজ হারাতে হবে। আইডিয়ার জন্য এআই ব্যবহার করা যেতে পারে। কিন্তু পুরো গান যদি সফটওয়্যার বানিয়ে ফেলে, তাহলে আমাদের প্রয়োজনই কী থাকবে?’

দ্য ভেলভেট সানডাউন ব্যান্ডের গান শুনিয়ে কয়েকজন তরুণ সংগীতপ্রেমীর কাছে মতামত চায় প্রথম আলো। তাঁদের বেশির ভাগের মন্তব্য, না জানালে তাঁরা বুঝতেই পারতেন না যে এটা মানবসৃষ্ট নয়।

শিল্পের জন্য হুমকি, নাকি নতুন অধ্যায়

প্রযুক্তিবিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটা একদিকে যেমন হুমকি, অন্যদিকে সুযোগও। অনেক শিল্পী এআই দিয়ে দ্রুত গান লেখা বা কম্পোজ করার সুযোগ পাচ্ছেন। অল্প বাজেটে বড় প্রজেক্ট তৈরি করাও সম্ভব হচ্ছে। তবে এআইকে কেবল সহকারী হিসেবে ব্যবহার করলেই সেটা ইতিবাচক হবে। সম্পূর্ণ গান বানিয়ে, কণ্ঠ নকল করে, পুরোনো শিল্পীদের নাম বা কণ্ঠ চুরি করে যদি কনটেন্ট তৈরি হয়, তাহলে সেটা ভবিষ্যতের জন্য বিপজ্জনক।

এআই আর্টিস্ট ও ট্রেইনার আবদুর রউফ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার মতো অনেকেই সংগীতের কিছু না জেনেও এআইয়ের সহায়তা নিয়ে গান বানাতে পারছি। সেখানে সংগীতশিল্পীরা একটা গান তৈরির অনেক খুঁটিনাটি জানেন, তাঁরা কমান্ড দিলে আমাদের চেয়ে কয়েক গুণ ভালো আউটপুট আসত। দেখুন, যে সেক্টরেই আপনি কাজ করেন না কেন, এআই সম্পর্কে না জানলে পিছিয়ে যাবেন।’

তবে আবদুর রউফ মনে করেন, শিল্পীদের মেধাস্বত্বের বিষয়গুলো আরও আধুনিক ও যুগপোযোগী করার সময় এসেছে।