শৈশবে বিড়ির ঠোঙা বানানো ছেলেটি এখন জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত গীতিকার

এই সময়ের আলোচিত গীতিকার রবিউল ইসলাম, জীবন নামেই  তাঁকে চেনেন সবাই। এবারের ঈদে মুক্তি পাওয়া ছয় সিনেমার পাঁচটিতেই রয়েছে তাঁর লেখা গান। তবে আজকের এই অবস্থানে আসতে তাঁকে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। রবিউল ইসলামের গল্প শুনেছেন নাজমুল হক

গীতিকার রবিউল ইসলাম জীবনছবি: ফেসবুক

বাবার রেডিও আর টেপরেকর্ডার ছিল শিশু জীবনের বিনোদন সঙ্গী। মাও ছড়ার মতো মিল করে কথা বলতেন। বাড়িতে কারও বিয়ে হলে অন্যদের সঙ্গে গীত গান গাইতেন। শৈশবের আর সব স্মৃতি মনে না পড়লেও রেডিও-টেপরেকর্ডারের কথা মনে আছে।
তবে সব সুখস্মৃতিকেই তছনছ করে দেয় বাবার মৃত্যু। শৈশবেই মায়ের সঙ্গে সংসারের হাল ধরেন জীবন। পড়াশোনার পাশাপাশি বিড়ির ঠোঙা বানাতেন। টিউশনিও করতেন। তৃতীয় শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় প্রথম শ্রেণির এক ছাত্রকে পড়াতেন। মাইনে ছিল ত্রিশ টাকা। সে সময়ের স্মৃতি হাতড়ে বলেন, ‘মায়ের চেষ্টা আর মামাদের ভালোবাসায় স্কুলের গণ্ডি পার করি।’

রবিউল ইসলাম জীবন
ছবি: ফেসবুক

নোয়াখালীর প্রত্যন্ত গ্রামের স্কুল থেকে মাধ্যমিক করে চট্টগ্রামের সরকারি কমার্স কলেজে উচ্চমাধ্যমিক পড়তে যান। এই সময়ই তাঁর মাথায় ঢোকে গানের পোকা। সময়টা ২০০২ সাল। একদিন কলেজ থেকে বাসায় ফিরতে ফিরতে মাথায় হঠাৎ কয়েকটি লাইন ঘুরপাক খেতে থাকে। বাসায় গিয়ে লাইনগুলো কাগজে লিখে ফেলেন। লাইনগুলো মিলিয়ে গানের সাধারণ আঙ্গিকে তিনটি অংশ পূরণ করেন। এভাবে একে একে লিখে ফেলেন ৫০টি গান। তখন আসিফ আকবরের ‘ও প্রিয়া, তুমি কোথায়’ অ্যালবাম সুপারহিট। আসিফ আকবরের কণ্ঠে নিজের একটা গান গাওয়ানোর স্বপ্ন দেখতে থাকেন। মাথায় ঘুরতে থাকে, ঢাকা গেলে একটা না একটা গতি হবে।
৫০টি গান আর সামান্য কিছু টাকা নিয়ে ২০০৪ সালে ঢাকায় পাড়ি জমান। তিতুমীর কলেজে পড়াশোনার পাশাপাশি টিউশন করতে থাকেন। দিনের পর দিন চলে যায়, স্বপ্ন আর হাতে ধরা দেয় না। বাকি গল্প জীবনের কাছ থেকেই শোনা যাক, ‘এক বন্ধুর মাধ্যমে (ওয়ারফেজ ব্যান্ডের প্রধান ভোকাল) পলাশের সঙ্গে পরিচয়। পলাশও তখন নতুন। ও আমার একটা গান সুর করে। আমার গান প্রথম সুর পেল, কী যে আনন্দ। যদিও শেষ পর্যন্ত এটি প্রকাশিত হয়নি। তখন প্রায় প্রতিদিনই কারও না কারও স্টুডিওতে যেতাম। তবে কিছুই হচ্ছিল না, তিন বছর পেরিয়ে গেল। খুব কষ্ট পেতাম। তখন মা অনেক মানসিক সমর্থন দিয়েছেন।’

২০০৩ সালেও কয়েকটি গান নিয়ে একবার ঢাকায় এসেছিলেন জীবন। সেবারই বেইলি রোডের একটি স্টুডিওতে সুরকার রাজেশ ঘোষের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। তাঁর মাধ্যমেই ২০০৬ সালে আসিফ আকবরের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ আসে। তখন রোজার ঈদের অ্যালবামের প্রস্তুতি চলছে। জীবন জানতে পারেন, তাঁর একটা লেখায় ভালো সুর হয়েছে, আসিফ আকবর ভয়েস দিলেই হয়ে যাবে। বন্ধুবান্ধব থেকে অনেককে সুখবরটি দেন। তবে সেই অ্যালবামে শেষ পর্যন্ত তাঁর গান যায়নি! সেই স্মৃতি মনে করে জীবন বলেন, ‘মনে আছে সাত-আট দিন ঠিকমতো ঘুমাতে পারিনি, খেতে পারিনি। সেসময় একসঙ্গে অনেক অ্যালবামের কাজ চলত, ফলে এক ঈদের কাজ অন্য ঈদেও চলে যেত।’
দেখতে দেখতে কোরবানির ঈদও চলে এল। কয়েক দিনের জ্বর নিয়ে গ্রামে চলে যান রবিউল ইসলাম। ঈদের তখন দুই সপ্তাহ বাকি। এলাকার চা–দোকানের সামনে আড্ডা দিচ্ছেন। রাজেশের ফোন। জানতে পারেন, আসিফ আকবর তাঁর গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। ফোনের ওই প্রান্ত থেকে আসিফও তাঁকে শুভেচ্ছা জানান। উত্তেজনায় ঠিকঠাক ঘুম হলো না, পরদিন সকাল হতেই ঢাকায় চলে আসেন। ওই রোজার ঈদের পর সুরকার পল্লব স্যান্নালকেও চারটি গান দিয়েছিলেন জীবন। পল্লবও জানান, আসিফ আকবর তাঁর গানে কণ্ঠ দেবেন!

মায়ের সঙ্গে রবিউল ইসলাম জীবন
ছবি: গীতিকারের সৌজন্যে

২০০৭ সালের প্রথম দিন ছিল কোরবানির ঈদ। সেই ঈদকে সামনে রেখে আসিফ আকবরের ‘হৃদয়ে রক্তক্ষরণ’ অ্যালবামে স্থান পায় রবিউল ইসলামের লেখা ‘ভাড়াটিয়া চাই’ ও ‘ভালোবাসি বলে’। তাঁর ক্যারিয়ারের গতিপথ বদলে দেয় এই দুই গান। তাঁকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। রাজেশ ও পল্লব স্যান্নালের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে রবিউল ইসলাম বলেন, ‘এ দুজন না থাকলে হয়তো আজকের এ অবস্থান আমার হতো না। তাঁদের এই ঋণ কখনো শোধ হওয়ার নয়।’
২০০৮ সালে কিশোর দাশের ‘নিখোঁজ সংবাদ’ অ্যালবামের টাইটেল গানটি লেখেন। সুর করেন কুমার বিশ্বজিৎ। গানটির জন্য ভালো প্রশংসা পান জীবন। ২০০৮ থেকে টানা ২০১০ সাল পর্যন্ত পলাশের সুর ও সংগীতে কয়েকটি অ্যালবাম প্রকাশ পায়। এর মাঝে ‘ক্যানভাস’ অ্যালবামে জায়গা পায় চারটি গান। একটি গানে কণ্ঠ দেন ফাহমিদা নবী। এরপর পলাশের ‘প্রাচীর’ অ্যালবামে ৭টি গান জায়গা পায়। সাতটি গানে কণ্ঠ দেন শাফিন আহমেদ, পার্থ বড়ুয়া, মাহমুদুজ্জামান বাবু, ফাহমিদা নবী, রাফিয়াত রশিদ মিথিলা। জীবনে নতুন পালক যোগ করে ২০০৮ সালের ক্লোজআপ ওয়ানের মৌলিক রাউন্ডে গান ‘আজ বৃষ্টির দিন’। শওকত আলী ইমনের সংগীতায়োজনে অপুর কণ্ঠে গানটি দেশব্যাপী সাড়া ফেলে। অনুষ্ঠানের মঞ্চে রবিউল ইসলামও নিমন্ত্রণ পান। প্রথমবারের মতো টেলিভিশনে নিজেকে দেখতে পাওয়া। রবিউল ইসলাম বলেন, ‘ইমন ভাইয়ের কাছে আমি অনেক কৃতজ্ঞ। ক্লোজআপ ওয়ানের মতো মঞ্চে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল স্যারসহ সবাই গানটির অনেক প্রশংসা করেছিলেন।’

২০২২ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান জীবন
ছবি: গীতিকারের সৌজন্যে

২০০৯ সালে প্রকাশ পায় তাঁর লেখা গানে বেশ কয়েকটি অ্যালবাম, কাজের জন্য সম্মাননাও পান। এর মাঝে আসে বালাম ও জুলির অ্যালবাম ‘স্বপ্নের পৃথিবী’, আসিফ আকবর-দিনাত জাহান মুন্নীর ‘ফিরব না আজ বাড়ি’। ‘বালাম ফিচারিং জুলি টু’ অ্যালবামের একটি গানের জন্য সিটিসেল–চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ডে শ্রেষ্ঠ গীতিকবির পুরস্কার জেতেন। পরের বছরও আরেকটি গানের জন্য একই অনুষ্ঠানে শ্রেষ্ঠ গীতিকবির পুরস্কার জেতেন।
২০১১ সালে দেশব্যাপী পরিচিতি এনে দেয় বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে নিয়ে লেখা গান ‘জ্বলে ওঠো বাংলাদেশ’। দূরবীন ব্যান্ডের গাওয়া গানটি এখনো জনপ্রিয়। দেশের বিভিন্ন শিল্পী ছাড়াও ভারতের জুবিন নটিয়াল, পাপন, শুভমিতা, রূপঙ্কর বাগচী, রূপম ইসলাম, আকাশ সেন, ইমন চক্রবর্তীরা গেয়েছেন জীবনের লেখা গান।
জীবনের ত্রিশটি গান ইউটিউবে পার করছে কোটি ভিউর মাইলফলক। এর মধ্যে তাহসানের ‘কেউ না জানুক’, মিনারের ‘দেয়ালে দেয়ালে’, ইমরান ও পড়শীর ‘কথা একটাই’, ইমন খানের ‘ভুল মানুষের ঘর’, কাজী শুভর ‘বউ এনে দে’, ইলিয়াস ও অরিনের ‘না বলা কথা’, ইমরানের ‘নিশিরাতে চান্দের আলো’, ইমরান ও পড়শীর ‘জনম জনম’, রিজভী ওয়াহিদ ও শুভমিতার ‘চোখেরই পলকে’ উল্লেখযোগ্য। আর সিনেমার গানের মধ্যে কোটি পেরিয়েছে ইমরান ও কনার কণ্ঠে ‘কন্যা’, আকাশ সেনের ‘তোমাকে আপন করে’, ইমরানের ‘রাতভর’, আকাশ সেনের ‘আমার মতন কে আছে বলো’ ইত্যাদি।

চলতি বছর ‘তাণ্ডব’সহ সাতটি সিনেমায় আটটি গান লিখেছেন জীবন
ছবি: ফেসবুক

চলতি বছর সাতটি সিনেমায় আটটি গান লিখেছেন জীবন। এর মাঝে ‘জ্বীন ৩’ সিনেমার ‘কন্যা’ গানটি বছরের অন্যতম জনপ্রিয় গান। চলতি ঈদুল আজহায় মুক্তি পাওয়া ছয়টি সিনেমার পাঁচটিতেই রয়েছে তাঁর গান। ‘তাণ্ডব’-এ লিখেছেন ‘খবর দে’, ‘ইনসাফ’-এর টাইটেল গান ছাড়াও লিখেছেন ‘টগর’-এর ‘ও সুন্দরী’, ‘এশা মার্ডার: কর্মফল’–এর ‘তোমাকে চাই’, ‘নীলচক্র’র ‘ধোকা’ গানগুলো।
সংগীতে স্বীকৃতি হিসেবে ২০২২ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান জীবন। রায়হান রাফী পরিচালিত ‘পরাণ’ সিনেমার ‘ধীরে ধীরে তোর স্বপ্নে’ গানটির জন্য এ পুরস্কার পান তিনি। জীবন বলেন, ‘মাকে নিয়ে পুরস্কারটি গ্রহণ করেছি। দিনটি এত আনন্দের, বর্ণনা করা যাবে না।’

আরও পড়ুন

মায়ের পাশাপাশি জীবনের চলার পথে ভরসার আলো ছড়িয়ে গেছেন বড় বোন মমতাজ ও ছোট ভাই সুজন। স্ত্রী তাসনিমা আকতাব ও মেয়ে মাইজাহ ইসলাম রিদা পূর্ণতা এনেছেন জীবনের জীবনে।

গান লেখার পাশাপাশি সাংবাদিকতা করেন রবিউল ইসলাম। বর্তমানে একটি অনলাইন গণমাধ্যমের সহকারী বার্তা সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন।