সেই মানুষেরাই আর খবর নেন না, রিংকুর আক্ষেপ

গায়ক রিংকু। ছবি: সংগৃহীত

‘ভুল বুঝে চলে যাও, যত খুশি ব্যথা দাও, সব ব্যথা নীরবে সইব বন্ধুরে তোমার লেখা গান আমি গাইব’, গানটির কথা উঠলেই সংগীতশিল্পী মশিউর রহমান রিংকুর কথা মনে পড়ে যায়। রিংকু টেলিভিশন লাইভ বা মঞ্চে দরদ দিয়ে গানটি গাইতেন। এমন যত্ন নিয়েই আরও অনেক গান রিংকুর দখলে ছিল। গানটির কথা বলার বিশেষ কারণ, গানটি গাওয়ার সময় হঠাৎ করেই থেমে যেতে দেখা যেত রিংকুকে।

এরপর বলতেন, গানটির সঙ্গে তাঁর ‘আত্মীয়তা’র কথা। ভক্তদের শোনাতেন নাটোরের চলনবিল এলাকার কথা। সেখানে শৈশবে অনেক যাত্রা দেখেছেন। শীতের মধ্যে চাদর গায়ে দিয়ে সেই যাত্রা দেখতে যেতেন রিংকু। যাত্রায় অবধারিত ছিল গানটি। এমন অনেক গান শুনে সংগীতশিল্পী হওয়ার প্রেরণা পেয়েছিলেন সেই শৈশবে। গান দিয়ে শ্রোতাদের আনন্দ দেওয়া এই সংগীতশিল্পী এখন ভালো নেই। অল্প বয়সেই ক্যারিয়ারের শেষ প্রান্তে তিনি। তাঁর কথায়, হয়তো গেয়ে ফেলেছেন জীবনের শেষ গান।

চার বছর আগে অসুস্থ শরীর নিয়েই একটি গান করেছিলেন। সেই গানের শিরোনাম ছিল ‘জোসনাবিলাস’। পছন্দের সেই গান নিয়ে দীর্ঘদিন পর তিনি ঢাকায় এলেন সংবাদ সম্মেলনে। এমন চেনা সংবাদ সম্মেলনে যেন অচেনা মনে হয় এই গায়কের কাছে। গানটি নিয়ে সংগীতজীবনের নানা অধ্যায়ের মুখোমুখি হলেন রিংকু।

গায়ক রিংকু। ছবি: সংগৃহীত

কথার শুরুতেই এই গায়ক বলেন, ‘অসুস্থতা নিয়ে এই সময়ে কোনো অনুষ্ঠানে আসব, এটা আমি ভাবতেই পারিনি। আমাকে কেউ আর এখন ডাকে না। আমাকে নিয়ে এমন আয়োজনের জন্য ধন্যবাদ রাজকে।’ জানা যায়, রাজের কাছে গানটির কথা শুনেই অসুস্থ অবস্থায় গাইতে রাজি হয়েছিলেন।

রিংকুর কথায়, বোঝা যায়, তিনি রোগের সঙ্গে নিত্যদিন যুদ্ধ করছেন। ইতিমধ্যে তিনি চারবার স্ট্রোক করেছেন। যে কারণে কথায় কিছুটা জড়তা। সেভাবেই মনে করিয়ে দিলেন অতীতের সুসময়ের কথা। যখন দর্শকেরা তাঁর গান শোনার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়তেন। কখনো গান শুনে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়তেন। সেই সব স্মৃতি স্মরণ করে রিংকু বলেন, ‘আগে আমি সুন্দর করে গান গাইতাম। কিন্তু এখন গান গাইতে পারি না। আমি গানের মানুষ। এখনো চেষ্টা করি গান করে যেতে। এখনো কথা বলতে কিছুটা সমস্যা হয়। একটা সময় আমি অনেক সুন্দর করে কথা বলতে পারতাম। এখন চেষ্টা করি, কিন্তু পারি না। আমার জন্য দোয়া করবেন, যেন গান গাইতে পারি। একসময় আমার গান শুনে যেমন দর্শকেরা আনন্দ পেয়েছেন, আবেগাপ্লুত হয়েছেন; সেই সময় যেন আবার ফিরে আসে। যত দিন পারব, গান করে যাব।’

অসুস্থতা নিয়েই ঢাকায় আসেন গায়ক রিংকু
ছবি: ফেসবুক

এমন অসুস্থতার কথা কখনোই ভাবেননি রিংকু। এখন নিয়মিত চিকিৎসা নিচ্ছেন। ভক্তদের আশার কথা শুনিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি আগের চেয়ে কিছুটা ভালো। হয়তো আরও ভালো চিকিৎসা পেলে সুস্থ হয়ে গানে ফিরতে পারব। একটা সময় আমি সারা দিন গান নিয়ে থাকতাম। গুনগুন করে গান গান গাইতাম। গানের মধ্যেই থাকা হতো। কিন্তু এখন শারীরিক অসুস্থতার জন্য কোনো গানই করা হয় না। গান নিয়ে থাকব, ভাবব, এটা মানসিকভাবে পারি না।’
উঠে এল কষ্টের কথা। উঠে এল ঢাকার কথা। এই ঢাকাতেই একসময় রাতদিন কেটেছে গান নিয়ে। গান নিয়ে আড্ডায়। ছুটেছেন এক টেলিভিশন থেকে আরেক টেলিভিশনের লাইভে, স্টেজ শো নিয়ে ব্যস্ত থেকেছেন। সেই ঢাকা এখন যেন রিংকুর চোখে নতুন।
রিংকু জানান, একটু আড়াল হলেই বন্ধু, সহকর্মীরা কাজের জন্য খোঁজ খবর নিতেন। কিন্তু অসুস্থ হয়ে নওগাঁর আত্রাই উপজেলার গ্রামের বাড়িতে থাকার পর সেই প্রিয় মানুষেরা যেন অচেনা হয়ে যান। সেই মানুষেরাই আর খবর নেন না।

গায়ক রিংকু। ছবি: ফেসবুক

সেই কষ্টের কথা বলতে গিয়ে রিংকু বলেন, ‘এখন আমার খবর আর কে নেবে। আমি আর কোনো কাজেও লাগি না। কেউ আমার খবরও নেয় না। ইন্ডাস্ট্রির মানুষেরা স্বার্থপর। আমি অসুস্থ হওয়ার পর কারও কাছ থেকে তেমন সহায়তা পাইনি। ক্লোজ-আপ ওয়ানের বন্ধুরাও খবর নেয় না।’

লোকগানের গায়ক রিংকুর দিন কাটে এখন গ্রামের বাড়িতে। দীর্ঘ কয়েক বছর ধরেই তিনি গ্রামেই রয়েছেন। ২০১৬ সালে হঠাৎ করেই মারা যান রিংকুর বাবা। তখন অস্ট্রেলিয়ার মঞ্চে ছিলেন এই গায়ক। এর মধ্যেই বাবার মৃত্যুর খবর শোনেন এই গায়ক। শোকে তিনি স্ট্রোক করেন।

স্ট্রোক হওয়ার পর গানের জগৎ থেকে একরকম দূরেই চলে গিয়েছিলেন রিংকু। আস্তে আস্তে আবার সুস্থ হয়ে উঠছেন। টুকটাক গানও শুরু করেছেন। তবে সেই গান হয়তো নিয়মিত আর গাওয়া হবে না।