টিকটক-রিলস মনে করিয়ে দেয় বনি এম হারায়নি, হারায় না
জার্মান সংগীতজ্ঞ ফ্র্যাঙ্ক ফারিয়ানের হাত ধরে জন্ম নেয় বনি এম। ক্যারিবীয় চার জাদুকর—লিজ, মার্সিয়া, মেইজি ও ববি মঞ্চে ছড়ান জাদু। ‘ড্যাডি কুল’, ‘সানি’, ‘রিভারস অব ব্যাবিলন’, ‘রাসপুতিন’—বিশ্ব কাঁপানো হিট গান। টিকটক-ইউটিউবে আবার ভাইরাল ‘রাসপুতিন’, মুগ্ধ হয় নতুন প্রজন্ম। তাদের ৫০ বছরের যাত্রা ফিরে দেখেছেন মাসুম অপু
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রিলসে ঘুরেফিরে আসছে গানগুলো। ইউটিউব শর্টস ভিডিওতে অনেক ভিডিও। ইউটিউবে সার্চ করে ফিরে যাই সত্তরের দশকে। একদল ক্যারিবীয় শিল্পী গাইছেন, ‘ড্যাডি, ড্যাডি কুল’ কিংবা ‘সানি, ওয়ান সো ট্রু, আই লাভ ইউ’। মনে পড়ে আশি কিংবা নব্বইয়ের ঢাকার অলিগলি থেকে শুরু করে অভিজাত এলাকার পার্টি, বিয়েবাড়ি কিংবা অভিজাত ক্লাবের ড্যান্স ফ্লোর—সবখানে তখন অদ্ভুত সুরের সঙ্গে নাচে মাতোয়ারা। সেই সুরের উৎস ‘বনি এম’।
অধুনা রিলস ও শর্টস মনে করিয়ে দেয়, বনি এম হারায়নি, হারায় না। ফিরে আসে বারবার। আজ ২০২৫ সালে দাঁড়িয়ে সেই সুরের জাদুকরেরা পার করে ফেলেছেন অর্ধশতক—৫০ বছরের এক অবিশ্বাস্য ইনিংস। যে দল একদিন বিশ্বকে ডিস্কো-জ্বরে কাঁপিয়েছিল, তারা নতুন প্রজন্মের কাছে নতুন রূপে ফিরে আসছে।
এক জার্মান রাঁধুনির অদ্ভুত খেয়াল
শুরুটা হয়েছিল জার্মানির এক ছোট্ট শহরে, ফ্র্যাঙ্ক ফারিয়ান নামের এক তরুণের হাত ধরে। ১৯৪১ সালে জন্ম নেওয়া এ মানুষটি পেশাগত জীবনে ছিলেন রাঁধুনি; কিন্তু তাঁর রক্তে মিশে ছিল সুরের নেশা। ১৯৭৪ সালে নিজের স্টুডিওতে বসে একটি অদ্ভুত গান রেকর্ড করেন, ‘বেবি, ডু ইউ ওয়াননা বাম্প’। গানের বিশেষত্ব ছিল, এতে থাকা গম্ভীর পুরুষকণ্ঠ ও তীক্ষ্ণ নারীকণ্ঠ—দুটিই ছিল ফারিয়ানের নিজের কণ্ঠের খেলা।
গানটি ফারিয়ান নিজের নামে প্রকাশ না করে ‘বনি এম’ ছদ্মনামে প্রকাশ করেন। অস্ট্রেলিয়ার জনপ্রিয় গোয়েন্দা সিরিজ ‘বনি’র পাশে একটি ‘এম’ জুড়ে তৈরি করলেন নতুন পরিচয়।
অপ্রত্যাশিতভাবে গানটি ইউরোপের ক্লাবগুলোয় তুমুল হিট হয়ে গেল। লাইভ পারফরম্যান্সের চাহিদা বাড়তে লাগল; কিন্তু মঞ্চে ওঠার মতো কোনো শিল্পী তো নেই, সবই তো ফারিয়ানের কারসাজি! তখনই তাঁর মাথায় এল—এই ছদ্মনামের আড়ালে একটি জলজ্যান্ত ব্যান্ড তৈরি করতে হবে।
ক্যারিবীয় চার জাদুকর
যেমন ভাবা তেমন কাজ। একটি ট্যালেন্ট এজেন্সির মাধ্যমে চারজন ক্যারিবীয় শিল্পীকে খুঁজে বের করলেন ফ্র্যাঙ্ক ফারিয়ান, যাঁরা কেবল গাইবেন বা নাচবেন না; বরং মঞ্চে হয়ে উঠবেন বনি এমের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। তাঁদের মধ্যে একজন লিজ মিচেল, জ্যামাইকা থেকে আসা এই তরুণীকে বলা হতো বনি এমের আত্মা। তাঁর শক্তিশালী ও মায়াবী কণ্ঠ ছাড়া ‘রিভারস অব ব্যাবিলন’ বা ‘সানি’র মতো গানগুলো হয়তো এতটা অমরত্ব পেত না। তিনিই ছিলেন ব্যান্ডের অন্যতম কণ্ঠ। মার্সিয়া ব্যারেট জ্যামাইকার আরেক কন্যা, যাঁর কণ্ঠ লিজ মিচেলের সঙ্গে মিলে তৈরি করত এক অপূর্ব হারমোনি। অনেক গানেই তাঁর সরব উপস্থিতি ছিল। মেইজি উইলিয়ামস মন্টসেরাট দ্বীপ থেকে আসা, পেশায় মডেল। রেকর্ডিংয়ে তাঁর কণ্ঠ খুব একটা ব্যবহার করা না হলেও মঞ্চে তাঁর মোহনীয় উপস্থিতি এবং আকর্ষণীয় নাচ ছিল বনি এমের অন্যতম ট্রেডমার্ক। আরুবা থেকে আসা নৃত্যশিল্পী ববি ফারেল ছিলেন ব্যান্ডের একমাত্র পুরুষ সদস্য এবং মঞ্চের প্রাণকেন্দ্র। তাঁর ঝলমলে পোশাক, অ্যারোবেটিক নাচ এবং বুনো উচ্ছ্বাস সত্তরের দশকের ডিস্কো-সংস্কৃতির প্রতীক হয়ে ওঠে। মঞ্চজুড়ে ছোটাছুটি, নিজের মতো করে নাচ আর বিচিত্র ভঙ্গি পাগল করে তুলত দর্শক-শ্রোতাদের।
এই চারজনকে নিয়ে ফারিয়ানের সংগীতায়োজনে তৈরি হলো নতুন এক ধারা, যেখানে ডিস্কোর সঙ্গে মিশে গেল পপ, রেগে ও ইউরোপীয় সুরের এক অপূর্ব মিশেল।
‘ড্যাডি কুল’ গানটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই ইউরোপের মিউজিক চার্টগুলোয় যেন আগুন লেগে গেল। এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি। ‘সানি’, ‘মা বেকার’, ‘বেলফাস্ট’-এর মতো একের পর এক হিট গান বনি এমকে পৌঁছে দিল খ্যাতির শীর্ষে।
বিশ্বজুড়ে ডিস্কো-জ্বর
১৯৭৬ সালে মুক্তি পেল ‘ড্যাডি কুল’। গানটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই ইউরোপের মিউজিক চার্টগুলোয় যেন আগুন লেগে গেল। এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি। ‘সানি’, ‘মা বেকার’, ‘বেলফাস্ট’-এর মতো একের পর এক হিট গান বনি এমকে পৌঁছে দিল খ্যাতির শীর্ষে।
তবে বনি এমের মুকুটে শ্রেষ্ঠ পালকটি যুক্ত হয় ১৯৭৮ সালে, ‘নাইট ফ্লাইট টু ভেনাস’ মুক্তির পর। এই অ্যালবামের ‘রিভারস অব ব্যাবিলন’ কেবল একটি গান ছিল না, হয়ে উঠেছিল এক উন্মাদনা। একই অ্যালবামের ‘ব্রাউন গার্ল ইন দ্য রিং’ শিশু থেকে বৃদ্ধ-সবাইকে নাচের তালে মাতিয়েছিল। আর রাশিয়ার রহস্যময় সাধককে নিয়ে তৈরি ‘রাসপুতিন’ আজও তাদের সবচেয়ে আইকনিক গানগুলোর একটি। বনি এম তখন কেবল একটি ব্যান্ড নয়, বিশ্বজোড়া ডিস্কো-জ্বরের কাঁপন। এ প্রসঙ্গে বলে রাখি, গানটি বিভিন্ন দেশে নানাভাবে রিমিক্স হয়েছে বা এর অনুকরণে গান হয়েছে নানা ভাষায়। ঢাকাই চলচ্চিত্রে ‘আজকে না হয় ভালোবাসো আর কোনো দিন নয়’সহ বেশ কয়েকটি গানে রয়েছে এর সুরের ছায়া।
বিভেদ ও ভাঙন
সাফল্যের চূড়ায় থাকলেও ব্যান্ডের ভেতরে চলছিল টানাপোড়েন। সবচেয়ে বড় বিতর্কের জন্ম দেয় ববি ফারেলের কণ্ঠ। মঞ্চে তিনি থাকলেও রেকর্ডিংয়ে পুরুষকণ্ঠটি দিতেন স্বয়ং প্রযোজক ফ্র্যাঙ্ক ফারিয়ান। বিষয়টি নিয়ে ফারিয়ানের সঙ্গে ববির সম্পর্কের অবনতি ঘটে, যা ১৯৮১ সালের পর ব্যান্ডের স্থিতিশীলতায় বড় আঘাত হানে।
অন্যদিকে আশির দশকে বিশ্বসংগীতে নতুন ধারার আগমন ঘটে। সিন্থ-পপ, হিপহপ আর নতুন ধারার রক সংগীতের জোয়ারে ডিস্কোর আবেদন ফিকে হতে শুরু করে। বনি এম চেষ্টা করেছিল নতুন ধারার সঙ্গে তাল মেলাতে, কিন্তু ‘বুনুনুনুস’ (১৯৮১) বা ‘টেন থাউজেন্ড লাইটইয়ার্স’-এর (১৯৮৪) মতো অ্যালবামগুলো আগের মতো সাফল্য পায়নি।
টিকটকে ‘রাসপুতিন’ গানের সঙ্গে নাচের একটি চ্যালেঞ্জ অবিশ্বাস্যভাবে ভাইরাল হয়। বিশ্বের কোটি কোটি তরুণ-তরুণী, বনি এমের নামও যাঁরা শোনেননি, তাঁরা এই গানের তালে নাচতে শুরু করেন। স্পটিফাই ও ইউটিউবে তাঁদের গান শোনার হার বেড়ে যায় বহুগুণ।
নতুন রূপে ফেরা
ব্যান্ডের মূল কার্যক্রম থেমে গেলেও তাদের গান কখনো হারিয়ে যায়নি। আশি ও নব্বইয়ের দশকে একের পর এক রিমিক্স ও গ্রেটেস্ট হিটস অ্যালবাম তাদের নামকে বাঁচিয়ে রাখে। তবে বনি এমের আসল পুনর্জন্ম ঘটে ডিজিটাল যুগে। ২০২১ সালে টিকটকে ‘রাসপুতিন’ গানের সঙ্গে নাচের একটি চ্যালেঞ্জ অবিশ্বাস্যভাবে ভাইরাল হয়।
বিশ্বের কোটি কোটি তরুণ-তরুণী, বনি এমের নামও যাঁরা শোনেননি, তাঁরা এই গানের তালে নাচতে শুরু করেন। স্পটিফাই ও ইউটিউবে তাঁদের গান শোনার হার বেড়ে যায় বহুগুণ। আর তাতেই ফিরে আসে পুরোনো সুর, পুরোনো ভালোবাসা।
দুনিয়ার নানা প্রান্তে
বনি এম শুধু ইউরোপ নয়, আফ্রিকা, এশিয়া ও লাতিন আমেরিকায়ও সমান জনপ্রিয় ছিল। নাইজেরিয়া, ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো দেশগুলোতে তাঁদের কনসার্ট হতো হাজার হাজার দর্শকের সামনে। বিশেষ করে সোভিয়েত ইউনিয়নে পশ্চিমা ব্যান্ডগুলোর মধ্যে বনি এম-ই প্রথম বিশাল কনসার্ট করার অনুমতি পায়, যা তাদের জনপ্রিয়তাকে নতুন মাত্রা দেয়। ব্যান্ডটি সারা বিশ্বে আনুমানিক ১৫ কোটি রেকর্ড বিক্রি করেছে, যা এখনো ডিস্কো ও পপ ব্যান্ডের জন্য এক রেকর্ড। বাংলাদেশের বাজারেও তাদের ক্যাসেট ও ভিনাইল ব্যাপক চাহিদা পেত, অনেক ব্যান্ডশিল্পী ও ডিজে তাদের গানের কাভার বা অনুকরণে পরিবেশনা করতেন। আশির দশকের পরও টেলিভিশনের বিভিন্ন নাচের অনুষ্ঠানে বনি এমের গান ছিল অপরিহার্য।
প্রতিটি গানই একেকটি ছোট নাটকের মতো। তাদের সুর ছিল সহজ ও আকর্ষণীয়, যা সহজেই গুনগুন করা যায় এবং যার সঙ্গে অনায়াসে নাচা যায়। আর যেটা না বললেই নয়, তাদের গানে ছিল এক সর্বজনীন আনন্দের বার্তা। ভাষা বা সংস্কৃতির সীমানা পেরিয়ে তাদের গান মানুষের মনকে উৎফুল্ল করার ক্ষমতা রাখে।
বনি এমের সুবর্ণজয়ন্তী
২০২৫ বনি এমের জন্য এক বিশেষ মাইলফলক। ৫০ বছর পূর্তির বছর। চলছে নানা আয়োজন। তবে এর আগেই ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে ৮২ বছর বয়সে মারা যান ফ্র্যাঙ্ক ফারিয়ান। তবে ব্যান্ডের প্রধান কণ্ঠ লিজ মিচেল এখনো সক্রিয়। সংগীত ও দাতব্য কাজে অবদান রাখার জন্য ব্রিটিশ রাজপরিবারের পক্ষ থেকে সম্প্রতি তাঁকে সম্মানজনক ‘এমবিই’ (মেম্বার অব দ্য অর্ডার অব দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার) খেতাবে ভূষিত করা হয়েছে।
অন্যদিকে মেইজি উইলিয়ামসের নেতৃত্বে ‘বনি এম ফিফটিয়েথ অ্যানিভার্সারি ট্যুর’ বিশ্বজুড়ে সাড়া ফেলেছে। সম্প্রতি মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর ও কুচিংয়ে তাদের কনসার্টের সব টিকিট বিক্রি হয়ে গেছে। এমনকি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ডাচ ডিজে ‘আরথ্রিহাব’ তাদের ক্ল্যাসিক গান ‘সানি’র একটি নতুন রিমিক্স তৈরি করেছে, যা ইউরোপের তরুণদের মধ্যে জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
আজও প্রাসঙ্গিক
প্রশ্ন হলো, পাঁচ দশক পরও কেন আবেদন হারায়নি বনি এম? সংগীত-বিশ্লেষকদের মতে, বড় কারণ—তাদের গানে গল্প ছিল। ‘রাসপুতিন’ রাশিয়ার ইতিহাসের এক বিতর্কিত চরিত্রকে তুলে ধরে, ‘মা বেকার’ এক গ্যাংস্টারের কাহিনি বলে আর ‘রিভারস অব ব্যাবিলন’-এ রয়েছে বাইবেলের আবহ। প্রতিটি গানই একেকটি ছোট নাটকের মতো। দ্বিতীয়ত, তাদের সুর ছিল সহজ ও আকর্ষণীয়, যা সহজেই গুনগুন করা যায় এবং যার সঙ্গে অনায়াসে নাচা যায়। আর যেটা না বললেই নয়, তাদের গানে ছিল এক সর্বজনীন আনন্দের বার্তা। ভাষা বা সংস্কৃতির সীমানা পেরিয়ে তাদের গান মানুষের মনকে উৎফুল্ল করার ক্ষমতা রাখে। বাংলাদেশে সত্তর-আশির দশকে বনি এমের ক্যাসেট সংগ্রহ করা ছিল আভিজাত্যের প্রতীক।
সেই ধারা আজও বহমান, শুধু মাধ্যমটা বদলে গেছে। নইলে জেন-জিরাও কেন মুঠোফোনে শুনবে সেসব গান। এআই দিয়ে বানানো ভিডিওতে কেন ফিরবেন বনি এমের শিল্পীরা।
হয়তো সময় বদলেছে, ডিস্কো-যুগ হারিয়ে গেছে, কিন্তু বনি এমের সুর এখনো বিশ্বের পার্টি হল থেকে শুরু করে নতুন প্রজন্মের টিকটক ফিডে সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। এই দীর্ঘ পথচলাই বলে, সত্যিকারের শিল্প কখনো মরে না; বরং প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে নতুন রূপে বেঁচে থাকে।
সূত্র: রোলিং স্টোন, দ্য গার্ডিয়ান, বনি এমের পেজ