গান আমার কাছে একটা থালার মতো
সকাল থেকে ইমন চৌধুরীকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি মাথায় নিয়ে তাঁর নিকেতন স্টুডিওতে যখন পৌঁছাই, তখন দুপুর ১২টা। পাঁচ মিনিটের অপেক্ষায় রেখে কফি হাতে ফেরেন। তিনি বলেন, গানের সঙ্গে কফিও খারাপ বানাই না। শুরু হয় আমাদের আড্ডা। নতুন এই গান তৈরির গল্প ধরে তিনি আমাদের সমতল থেকে নিয়ে যান বান্দরবানের ঝিরিপথ থেকে রাঙামাটির গহিন অরণ্যে।
এক সুরে বাংলাদেশ
বাংলাদেশের নানা অঞ্চলের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে একসুতায় বাঁধার স্বপ্ন দেখতেন ইমন চৌধুরী। এর আগে কোক স্টুডিও বাংলায় হাশিম মাহমুদের ‘কথা কইয়ো না’র সঙ্গে ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’র ‘বারো মাসে বারো ফুল রে’ যুক্ত করে প্রশংসিত হয়েছিলেন। তবে তাঁর স্বপ্নটা ছিল আরও বৃহৎ। তিনি চেয়েছিলেন, বাংলাদেশের সমতল, পাহাড় ও সাগরের বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতিকে একসঙ্গে তুলে ধরবেন। কোক স্টুডিও বাংলাকে নিজের স্বপ্নের কথা জানান, তারাও রাজি হয় একবাক্যে। এভাবেই শুরু হয় ‘বাজি’ গানের পরিকল্পনা। শনিবার রাতে এ গান দিয়েই এক বছরের বিরতি শেষে ফিরেছে কোক স্টুডিও বাংলা। গানটিতে ফুটে উঠেছে সাধারণ এক রমণীর প্রেমের গল্প। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে উঠে আসা কণ্ঠ ও সুরের মেলবন্ধন পাওয়া গেছে গানটিতে। ইমনের সংগীত আয়োজনে এ গানে আরও ফুটে উঠেছে বৈচিত্র্যময় লোকজ সংগীত, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর বাদ্যযন্ত্রের মাধুর্য ও লোকশিল্প। সবকিছুই একসঙ্গে গেঁথেছেন ইমন। গান নিয়ে ইমন বলেন, ‘গান আমার কাছে একটা থালার মতো। এর মধ্যে বিভিন্ন তরকারি সাজিয়ে রাখি। প্রতিটাই আলাদা, একজন খাদক প্রতিটার স্বাদ আলাদা করেই পাবেন। ফিউশন বলতে আমার কাছে তা–ই, আমি সব মিশিয়ে খিচুড়ি বানাতে চাই না কখনো। “বাজি” গানটিও তেমন, সবকিছুই আলাদা আলাদা রাখতে চেয়েছি।’ গানটির পেছনে নিজের পরিশ্রমের চেয়েও সহযোগীদের অবদান বেশি বলে মনে করেন ইমন। তাঁর কথায়, ‘মিথুন চক্র ভাইয়ের কথা না বললেই নয়, গানটির পুরো রিদম পার্ট উনি দেখেছেন। উনি না থাকলে এত বড় কাজ করতে পারতাম না। এর বাইরে প্রতিটি অংশে যাঁরা কাজ করেছেন, সবাই সর্বোচ্চ উজাড় করে দিয়েছেন। সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা।’
শিল্পী খোঁজার গল্প
‘কথা কইয়ো না’ গানটি করার সময় থেকেই এই গানটির পরিকল্পনা শুরু করেন ইমন। ১০০ জনের মতো শিল্পী কাজ করেছেন ‘বাজি’ গানে। সবাইকে একসঙ্গে করা সহজ কাজ ছিল না। এ গানের জন্যই সমতল থেকে পাহাড়ে তাঁরা খুঁজে বেরিয়েছেন শিল্পীদের। হাশিম মাহমুদের ‘বাজি’ গানের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শতবর্ষী ‘ধুয়া’ গান। মরমি কবি জালাল উদ্দীন খাঁর লেখা ও ইমন চৌধুরীর সুরে ‘ধুয়া’ গান নিয়ে হাজির হয়েছিল টাঙ্গাইল থেকে আসা ‘ধুয়া’ গানের দল। গানটিতে আরও উঠে এসেছে মারমা ভাষায় গান, বাওমা উপজাতির ধ্রুপদি নৃত্য ও মণিপুরি সম্প্রদায়ের পুং উপস্থাপনা। একেকজনকে পাওয়ার পেছনে রয়েছে মজার গল্প। কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে শিল্পী খোঁজার গল্প শুরু করেন ইমন। তিনি বলেন, ‘গানটিতে মারমা ভাষায় কণ্ঠ দিয়েছেন ম্রাকোই চিং মারমা, যাঁকে আমরা সবাই নানি ডাকি। বান্দরবান শহরে আসতে তাঁর বাড়ি থেকে সময় লাগে এক দিনের বেশি। ঢাকায় কখনো আসেননি। প্রস্তাব পেয়ে প্রথমে উনি বিশ্বাস করেননি। তাঁকে বুঝিয়ে রাজি করালাম। তাঁকে আনার দায়িত্ব দেওয়া হয় তাঁর মেয়েকে। কিন্তু তিনিও এর আগে ঢাকায় আসেননি। ঢাকায় পৌঁছানোর পর কয়েক দিন আমাদের সঙ্গে ছিলেন। তাঁদের সরলতা আমাদের এতটাই মুগ্ধ করে, যা বলে প্রকাশ করা যাবে না। জুমের ফল থেকে সবজি, সঙ্গে আমার মেয়ের জন্য মাথার ব্যান্ড নিয়ে এসেছিলেন তাঁরা। তখন মনে হয়েছিল, আমার পরম আত্মীয় আমাকে দেখতে এসেছেন।’
‘ধুয়া’ গানের দলকে খুঁজে পাওয়ার গল্প আরও মজার। ইমন চৌধুরীকে হঠাৎ একদিন তাঁর বাবা শত বছরের পুরোনো ‘ধুয়া’ গানের একটা পারফরম্যান্সের ভিডিও পাঠান। যা দেখে অবাক হন ইমন, এভাবেও মজা করে গান করা যায়! দলটির খোঁজ পান টাঙ্গাইলে, কিন্তু কাউকে রাজি করাতে পারেননি তিনি। কারণ, সে সময় ইটভাটার কাজে যুক্ত ছিল দলটি।
ইমনের কাছ থেকে এত বড় প্রস্তাব তাঁদের বিশ্বাস হয়নি। ইমন বলেন, ‘তাঁদের “কথা কইয়ো না” থেকে আমাদের অন্যান্য কাজের ভিডিও পাঠাই, কিন্তু তাঁরা বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। একদিন সবাইকে ঢাকায় দাওয়াত দিই। সবাই আসার পর একসঙ্গে সারা দিন আড্ডা ও খাওয়াদাওয়া করে সখ্য তৈরি করি। দিন শেষে রাতে গানটি নিয়ে আমরা বসি। জালাল উদ্দীন খাঁর লেখা ও আমার সুরের “আসমানে তোর ছায়ারে কন্যা” গানটি শুনিয়ে বলি, এটাকে ‘ধুয়া’ গানের মতো গাইতে হবে। কতক্ষণের ভেতর তাঁরা গানটি তুলে ফেলেন। কিন্তু সেবার রেকর্ড না করে তাঁদের বাড়ি পাঠাই আমরা। এরপর তাঁদের জানাই, তাঁরা যেন কয়েক দিনের সময় নিয়ে ঢাকায় আসেন। পরেরবার আসার পর রেকর্ড করি আমরা, এত দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করেছেন তাঁরা!’
একজন হাশিম মাহমুদ
হাশিম মাহমুদ অসুস্থ থাকায় আগের গানগুলোয় তাঁকে পাওয়া যায়নি। তবে ইমনের মনের ভেতর একটা সুপ্ত বাসনা ছিল, হাশিম মাহমুদকে কয়েক সেকেন্ডের জন্য হলেও কোনো গানে তিনি পেতে চান। কোক স্টুডিও বাংলাকে বলার পর তারা দায়িত্ব দেয় ইমনের ওপর। হাশিম মাহমুদের দেখভাল থেকে পুরো প্রক্রিয়ার দায়িত্ব ইমন নেবেন শর্তেই রাজি হয় তারা। ইমনের কথায়, ‘হাশিম ভাইকে নিয়ে একটা শঙ্কা ছিল, যেহেতু তিনি শারীরিকভাবে অসুস্থ। তবে আমার মনে একটা বিশ্বাস ছিল, আমরা পারব। যতটা ধারণা করেছিলাম, হাশিম ভাই এর চেয়ে বেশি দিয়েছেন। আর ওনার মতো একজন গুণী মানুষকে কাজটিতে রাখতে পারা একজন সংগীত আয়োজকের জন্য অনেক বড় কিছু।’
বেঙ্গল সিম্ফনি
ইমন ও তাঁর বন্ধুদের গানের দল বেঙ্গল সিম্ফনি। বলা যায়, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় গানের দলের একটি এটি। ২০ জনের সমন্বয়ে গড়ে তোলা হয়েছে এটি। বিভিন্ন সময়ে এই সদস্যসংখ্যা কমবেশি হয়। তাঁদের ‘ফুল নেয়া ভালো নয়’ প্রশংসা কুড়িয়েছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সঙ্গে পারফর্ম করেছে জাপানে। চলতি বছর আসছে ব্যান্ডটির প্রথম অ্যালবাম। এর সঙ্গে দেশের বাইরের বেশ কিছু আয়োজনে অংশ নেবেন তাঁরা। ইমন বলেন, ‘অ্যালবাম নিয়েই ব্যস্ততা আমাদের। ছয়টি গান নিয়ে একটা অ্যালবাম আসবে। চলতি বছরই এর কয়েকটা গান প্রকাশ পাবে। এর বাইরে আরও কিছু পরিকল্পনা রয়েছে, সেগুলো সময় হলেই শ্রোতাদের জানাতে চাই।’
জাতীয় পুরস্কার
বিজ্ঞাপনচিত্র থেকে চলচ্চিত্র ও নাটক, ইমনের ব্যস্ততা সারা বছর। প্রতিটি ক্ষেত্রেই মেধার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন তিনি। শ্রোতৃপ্রিয়তার সঙ্গে তাঁর কাজগুলো সমালোচকদের কাছ থেকে প্রশংসা পেয়েছে। ২০২২ সালে মায়া: দ্য লস্ট মাদার চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালক হিসেবে পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। এ ছাড়া কাঠবিড়ালী, রাত জাগা ফুল, গুণিন, পরাণ, সুড়ঙ্গ, অন্তর্জাল থেকে দেয়ালের দেশ সিনেমায় পাওয়া গেছে তাঁকে। ইমন বলেন, ‘আমি সংগীতের তেমন কিছুই জানি না। তবে শেখার চেষ্টা করি। আমার কিছু কাজ মানুষের পছন্দের তালিকায় আছে, এটা আমার জন্য অনেক। এর ফলে দায়িত্ব আরও বেড়ে গেছে। এরই মধ্যে কয়েকটি সিনেমার কাজ শেষ করেছি, আরও কিছু কথা চলছে, সবকিছু মিলিয়ে চলতি বছর চলচ্চিত্রেও শ্রোতারা আমাকে পাবেন।’