পাকিস্তানে নষ্ট হচ্ছে আবদুল আলীমের গান

আবদুল আলীমপরিবারের সৌজন্যে।

‘বছরের পর বছর পাকিস্তানে বাবার গানগুলো পড়ে আছে, নষ্ট হচ্ছে। ব্যক্তিগতভাবে অনেক চেষ্টা করেও গানগুলো উদ্ধার করতে পারছি না,’ আক্ষেপ নিয়ে বলছিলেন আবদুল আলীমের মেয়ে নূরজাহান আলীম।

ষাটের দশকে করাচি রেডিও ও পাকিস্তান টেলিভিশনে (পিটিভি) নিয়মিত গান করতেন লোকসংগীতশিল্পী আবদুল আলীম। বাংলাদেশের পাশাপাশি পশ্চিম পাকিস্তানেও জনপ্রিয় ছিলেন তিনি। তাঁর বেশ কিছু বাংলা গান পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে করাচি রেডিওর আর্কাইভে পড়ে রয়েছে। স্বাধীনতার পর কূটনৈতিক জটিলতায় গানগুলো আর দেশে ফেরত আনা যায়নি।

৫ সেপ্টেম্বর ছিল আবদুল আলীমের ৪৮তম প্রয়াণবার্ষিকী। এদিন তাঁর মেয়ে নূরজাহান আলীম প্রথম আলোকে বলেন, ‘গানগুলো অনেক পুরোনো। করাচি রেডিওতে এখনো ২০ থেকে ২৫টি গান আছে। এর মধ্যে কিছু নষ্ট হয়ে গেছে। আবদুল আলীমের গান বাংলাদেশের সম্পদ। দেশের সম্পদ আমরা অন্য দেশে ফেলে রেখেছি! তাঁর গানগুলো ফিরিয়ে এনে সংরক্ষণ করা উচিত।’

আবদুল আলীম
পরিবারের সৌজন্যে।

বাবা আবদুল আলীমের গান ফিরিয়ে এনে সংরক্ষণের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছেও আবেদন জানালেন নূরজাহান। বছর চারেক আগে প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী ও পাকিস্তানে নিযুক্ত বাংলাদেশের তৎকালীন হাইকমিশনার সোহরাব হোসেনের সহযোগিতায় আবদুল আলীমের একটি সাক্ষাৎকার ও অল্প কয়েকটি গান দেশে আনা হয়েছিল বলে জানালেন তাঁর মেয়ে। গানগুলো বাংলাদেশ বেতারে দেওয়া হয়েছিল। তবে সেগুলো হারিয়ে গেছে বলে অভিযোগ করলেন আলীমকন্যা।
বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ বেতারের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অনুষ্ঠান) নাসরুল্লাহ মো. ইরফানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বেতারের ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিসে যোগাযোগের পরামর্শ দেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ বেতারের ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিস বিভাগের এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানান, আবদুল আলীমের বহু গান বাংলাদেশ বেতারে সংরক্ষিত আছে। তবে গানগুলো পাকিস্তান থেকে আনা হয়েছে কি না, তা তাঁর জানা নেই। পাকিস্তান থেকে আনা গান হারিয়ে যাওয়ার প্রশ্নে সেই কর্মকর্তা কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।

আবদুল আলীম
পরিবারের সৌজন্যে।

চলচ্চিত্র গবেষক শামসুল আলম প্রথম আলোকে জানান, স্বাধীনতার আগে করাচি রেডিওতে নিয়মিত বাংলা গানের অনুষ্ঠান হতো। সেই সূত্রে করাচি রেডিওতে বহু গান করেছেন আবদুল আলীম, সেই গানগুলোর স্পুল আর্কাইভে জমা আছে। বেশির ভাগ গানেরই অন্য কোনো কপি থাকার সম্ভাবনা নেই। ফলে করাচি আর্কাইভের স্পুল না পেলে গানগুলো উদ্ধার করা যাবে না। পুরোনো স্পুলকে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা না গেলে নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। করাচি আর্কাইভে আবদুল আলীমের বাংলা গান কতটা যত্নের সঙ্গে সংরক্ষণ করা হচ্ছে, তা নিয়ে শঙ্কার কথা জানালেন পরিবারের সদস্যরা। নূরজাহান আলীমের ভাষ্যে, ‘ব্যক্তিগতভাবে চেষ্টা করে আমরা আনতে পারছি না। পাকিস্তানের পারিপার্শ্বিক অবস্থাও এখন ভালো নয়, কেউই দায়িত্ব নিয়ে গানগুলো আনার ঝুঁকি নিতে চান না।’

বিষয়টি নিয়ে পাকিস্তানে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার রুহুল আলম সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিষয়টি আপনার কাছ থেকেই প্রথম শুনলাম। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে কেউ আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি।’
আবদুল আলীমের গাওয়া ‘পরের জায়গা পরের জমিন’ কয়েক বছর আগে একটি পাকিস্তানি সিরিয়ালে ব্যবহার করা হয়। গীতিকার আবদুল লতিফের কথায় আবদুল আলীমের কণ্ঠে গানটি দশকের পর দশক ধরে বাংলাদেশের পাশাপাশি পাকিস্তানের শ্রোতাদের মুখ থেকে মুখে ছড়িয়েছে।
অল্প বয়সেই গান গেয়ে নাম করেন লোকসংগীতের এই অমর শিল্পী। মাত্র ১৩ বছর বয়সে বের হয় তাঁর প্রথম রেকর্ড। তাতে ছিল দুটি গান—‘তোর মোস্তফাকে দে না মাগো’ও ‘আফতাব আলী বসল পথে’।

আবদুল আলীম
পরিবারের সৌজন্যে।

দেশভাগের পর ঢাকায় চলে আসেন মুর্শিদাবাদের আবদুল আলীম। রেডিওতে স্টাফ আর্টিস্ট হিসেবে গান গাইতে থাকেন। টেলিভিশন সেন্টার চালু হলে সেখানেও তিনি সংগীত পরিবেশন শুরু করেন। তৎকালীন বাংলাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’সহ বিভিন্ন বাংলা চলচ্চিত্রে আবদুল আলীম গান করেছেন। শিল্পীর ৫০০ গান রেকর্ড হয়েছে, স্টুডিও রেকর্ডেও রয়েছে অনেক গান। তাঁর স্মরণীয় গানগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘যার আপন খবর আপনার হয় না’, ‘নাইয়ারে নায়ের বাদাম তুইলা’, ‘সর্বনাশা পদ্মা নদী’, ‘হলুদিয়া পাখি’, ‘মেঘনার কূলে ঘর বাঁধিলাম’, ‘এই যে দুনিয়া’, ‘দোল দোল দুলুনি’, ‘দুয়ারে আইসাছে পালকি’, ‘কেনবা তারে সঁপে দিলাম দেহ মন প্রাণ’, ‘মনে বড় আশা ছিল যাব মদিনায়’, ‘কেহ করে বেচাকেনা কেহ কান্দে’, ‘সব সখীরে পার করিতে নেব আনা আনা’ ইত্যাদি।
১৯৭৪ সালের ৫ সেপ্টেম্বর মারা যান আবদুল আলীম। বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৭ সালে তাঁকে মরণোত্তর একুশে পদক প্রদান করে।