প্রথম গানেই বাজিমাত

‘সাদা সাদা কালা কালা’ ও ‘চলো নিরালায়’ গানের দুই শিল্পী এরফান মৃধা ও অয়ন চাকলাদারকোলাজ : প্রথম আলো

‘সাদা সাদা কালা কালা’ ও ‘চলো নিরালায়’ গত ঈদে মুক্তি পাওয়া দুটি গান। দুটি গান চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত হয়েছে। দ্বিতীয় গানটি ঈদে মুক্তি পাওয়া ‘পরাণ’ চলচ্চিত্রের আর প্রথম গানটি ২৯ জুলাই মুক্তি পাওয়া ‘হাওয়া’ চলচ্চিত্রের। দুটি গান এখন বাংলাদেশের আনাচকানাচে বাজছে। দুটি গানের গায়ক এরফান মৃধা ও অয়ন চাকলাদার চলচ্চিত্রে প্রথমবার গাইলেন। গেয়ে রীতিমতো বাজিমাত করেছেন। সাধারণ শ্রোতার মন জয় করার পাশাপাশি তাঁরা শিল্পীদের মনেও জায়গা করে নিয়েছেন। দুটি গান ফেসবুকে শেয়ার করে অনেক প্রতিষ্ঠিত শিল্পীও দুই গায়ককে নিয়ে ভালো লাগার অনুভূতি লিখছেন।

‘সাদা সাদা কালা কালা’ গানটির কথা ও সুর হাশিম মাহমুদের, একসময় তিনিই এই গানটি গাইতেন। চলচ্চিত্রে ইমন চৌধুরীর সংগীতায়োজনে গানটি গেয়েছেন এরফান মৃধা। ‘চলো নিরালায়’ গানটি দ্বৈত কণ্ঠের। নাভেদ পারভেজের সুর ও সংগীতে এই গানের কথা জনি হকের লেখা। অয়ন চাকলাদারের সঙ্গে গানটি গেয়েছেন আতিয়া আনিসা। এর আগে চলচ্চিত্রের গানে তাঁর অভিষেক হয়। কাছাকাছি সময়ে ঢালিউডের কোনো ছবির গান এত জনপ্রিয় হয়েছে তা কেউ মনে করতে পারছেন না। দুই চলচ্চিত্রের দুটি গানই দর্শক–শ্রোতাদের পাশাপাশি গানপ্রেমীদের মুখে মুখে।

‘সাদা সাদা কালা কালা’ গানের শিল্পী এরফান মৃধা
ছবি : সংগৃহীত

‘সাদা সাদা কালা কালা’ গানটি ৯০ দশকের শেষের দিকে শাহবাগ, টিএসসি, ছবির হাটে জড়ো হওয়া আড্ডাপ্রিয় মানুষের কাছে প্রিয় গান ছিল। হাওয়া ছবির পরিচালক মেজবাউর রহমান তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে পড়তেন। তিনিও গানটি তখন শুনতেন। আর এরফান মৃধা ১৯৯৮ সাল থেকে হাশিম মাহমুদের আড্ডা সঙ্গী হওয়াতে গানটি শুনেছেন। গলা মিলিয়েছেনও। পড়াশোনা শেষে বিজ্ঞাপনচিত্র, নাটক নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত হওয়া সুমন একটা সময়ে এসে যখন প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন, তখনই এই গানটি রাখার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু হাশিম মাহমুদকে তো আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। তাই সহকারী হিসেবে কাজ করা এরফান মৃধাকে দায়িত্ব নেন, তাঁকে খুঁজে বের করতে। অনেক চেষ্টার পর খুঁজে পেলেও গানটি গাইবার মতো অবস্থা ছিলেন না হাশিম মাহমুদের। তারপর পরিচালকের সিদ্ধান্তে গাইলেন এরফান মৃধা। প্রকাশের ১২ দিনের মধ্যে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে এ গান। শিবলু জানালেন, গাওয়ার সময়ই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, গানটি সব মানুষের প্রিয় হয়ে উঠবে।
‘পরাণ’ চলচ্চিত্রের ‘চলো নিরালায়’ গানটি অয়ন চাকলাদার গেয়েছিলেন ২০১৯ সালে। আত্মবিশ্বাসী অয়নও ভেবেছিলেন, গানের কথা–সুর ও গায়কি এমন হয়েছে, তাতে শ্রোতাদের ভালো লাগবে। কিন্তু এতটা সাড়া পাবেন, কখনো কল্পনা করেননি। তবে এই গানের অংশ করে নেওয়ার জন্য সংগীত পরিচালক ও চলচ্চিত্র পরিচালক রায়হান রাফির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন অয়ন।

‘চলো নিরালায়’ গানের শিল্পী অয়ন চাকলাদার
ছবি : সংগৃহীত

ছোটবেলা থেকেই সংগীতশিল্পী হতে চেয়েছিলেন অয়ন চাকলাদার। তাঁর বাবা শাজাহান চাকলাদারও একসময় বাংলাদেশ টেলিভিশনে গান গাইতেন। কিন্তু পেশাদার শিল্পী হতে চাননি। চাকরিজীবী বাবা ভালোবাসা থেকেই গান করতেন। তবে বাবা-মা দুজনেরই খুব ইচ্ছে ছিল দুই ছেলের মধ্যে বড় ছেলে গানে পরিচিতি পাক। তাই তো দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় বাংলাদেশ শিশু একাডেমিতে সংগীতে দুই বছরের একটি কোর্সে ভর্তি করিয়ে দেন। এরপর খোদা বক্স শানুর গানের স্কুল আনন্দম সংগীতাঙ্গনে দুই বছর গানের তালিম নেন। অয়ন জানালেন, তাঁর গানের হাতেখড়ি বাবার কাছে। বাবাই প্রথম তাঁকে হারমোনিয়াম ধরে গান গাইতে শেখান।
সংগীত নিয়ে স্বপ্ন দেখা অয়ন স্কুল–কলেজের গণ্ডি ফেরিয়ে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীতে স্নাতক করেন। নিজেকে মেলে ধরতে ২০১১ সালে পেশাদার সংগীতে যাত্রা শুরু হয়। প্রথম গান গেয়েছিলেন জেগো ওঠো অ্যালবামে ‘আমরা করব জয়’, সঙ্গে ছিলেন দুই বন্ধু ইমরান মাহমুদুল আর ইভান ইভুও। গাওয়ার পাশাপাশি অয়ন অন্যদের জন্যও গান সুর করেছেন, সংগীত পরিচালনা করেছেন। ১১ বছরে তাঁর গানের সংখ্যা তিন শতাধিক। এর মধ্যে শতাধিক গানে কণ্ঠ দিয়েছেন অয়ন। তবে দীর্ঘ সময় গানের সঙ্গে যুক্ত থাকা অয়ন ‘বহুকাল’ গানটি গেয়ে শ্রোতাদের পাশাপাশি বিনোদন অঙ্গনের সবার নজরে আসেন। আর ঈদে মুক্তি পাওয়া ‘চলো নিরালায়’ গানটি দিয়ে তো আমজনতার কাছেও পৌঁছে গেছেন।

‘পরাণ’–এর একটি দৃশ্যে মিম ও ইয়াশ রোহান
ছবি: সংগৃহীত

অয়ন বললেন, ‘এতটা বছর পর সাফল্যের দেখা পেলাম। সময় অনেকটা পার হলেও নিজের ওপর বিশ্বাস ছিল। কাজের প্রতি সৎ ছিলাম। তবে আমাকে তিরস্কারও করেছিল। বলেছিল, আমার ভাগ্যে হিট গান নেই। আমি অনলাকি। আমি কিন্তু ওসব গায়ে মাখাইনি। কাজ করে গেছি। আমি মনে মনে একটা বিষয় ভেবেছিলাম, একদিন না একদিন মানুষ আমার কণ্ঠ পছন্দ করবে। তারা আমার গান গাইবে। সেই সময়টা এখন। আমি বেশ উপভোগ করছি।’
এদিকে ‘সাদা সাদা কালা কালা’ গানটির সাফল্যে প্রশংসায় ভাসছেন এরফান মৃধা। বলছিলেন, ‘মানুষ গানটি এত পছন্দ করায় সৃষ্টিকর্তার কাছে শুকরিয়া। সুমন ভাইয়ের প্রথম ছবিতে আমার প্লেব্যাক, অনেক বড় পাওয়া। হাশিম ভাইয়ের এই গান আগে অনেকেই গাওয়ার চেষ্টা করেছেন কিন্তু বাণিজ্যিকভাবে কেউ চেষ্টা করেনি। তবে আমি আমার মতো করে গাওয়ার চেষ্টা করেছি।’
এরফান মৃধা শিবলুর বেড়ে ওঠা ঢাকায়। গায়ক হিসেবে পরিচিতি পাওয়া এই শিল্পী জানালেন, ‘ছোটবেলায় দেখেছি, মা ও মামা গুনগুন করে গাইতেন। তখনই গানের প্রতি ভালো লাগা শুরু। পরে মগবাজারে নজরুল শিক্ষালয় এবং পরে ছায়ানটে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গানের তালিম নিয়েছি। হাওয়া চলচ্চিত্রের এই গানের আগে কোনো অডিও গান বা মিউজিক ভিডিও করা হয়নি। এটা দিয়ে আমার মূল প্ল্যাটফর্ম বা প্লেব্যাকে প্রথম গান করা হলো।’

দর্শকের সঙ্গে ‘হাওয়া’ দেখার পর প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেল নাজিফা তুষি, চঞ্চল চৌধুরী ও এরফান মৃধা (সবার বামে)
ছবি: সংগৃহীত

পাশাপাশি ‘সেন্টার ফর এশিয়ান থিয়েটার’ (সিএটি) নামে একটি পেশাদার মঞ্চ নাটকের দলে ১২ বছর ধরে কাজ করছেন। দুই বছর ছিলেন সিসিমপুরে। তিনি জানালেন, সিসিমপুরের পর অনিমেষ আইচের কয়েকটি নাটকে অভিনয় করেন। তাঁর সহকারী পরিচালক হিসেবেও কাজ করেন। সেখান থেকে মেজবাউর রহমানের সঙ্গে পরিচয় ২০১২ সালে। এর মধ্যে ‘গেরিলা’, ‘অচেনা হৃদয়’, ‘না মানুষ’—এই তিনটি চলচ্চিত্রে কাজ করেছেন। আগামী দিনের জন্য তাঁর আরও নতুন গানের কাজ চলছে বলে কথা প্রসঙ্গে জানান এরফান মৃধা।
দুটি গান মুক্তির পর দুই শিল্পীর সঙ্গে নতুন চলচ্চিত্রে গাওয়ার ব্যাপারে আলাপ করেছেন কয়েকজন পরিচালক। চলচ্চিত্রের পাশাপাশি নিজেদের পছন্দের গানও ভবিষ্যতে শ্রোতাদের উপহার দিতে চান তাঁরা। দুজনের মা–বাবা এবং পরিবারের সদস্যরা তাঁদের সাফল্যে গর্বিত বলেও জানালেন এরফান মৃধা ও অয়ন।