লতা মঙ্গেশকর বলেছিলেন, ‘আমার দেখা সেরা শিক্ষিত কম্পোজার’

আমরা চার বন্ধু—তাপস, টিপু, বিপুল আর আমি; কলকাতা শহরের হৃদয়ের দিকে হাঁটছিলাম। বছর তখন ১৯৮৯। আমরা তখন ২৩–২৪ বছরের তরুণ, স্বপ্নের উত্তাপে টগবগে। জীবনের প্রথম বিদেশযাত্রা, প্রথম কলকাতা সফর, আবার প্রথমবার দেখা হতে চলেছে এমন এক কিংবদন্তির সঙ্গে, যাঁর নাম শুনলেই এক সংগীত মহাবিশ্বের দরজা খুলে যায়।
অসংখ্য পরিকল্পনার মধ্যে অন্যতম ছিল—পূর্ববর্তী বছর (১৯৮৮) সপরিবার বাংলাদেশে আসা অন্তরা চৌধুরী আর তাঁর পরিবারের সঙ্গে দেখা করা। তাপসের এক অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল—যাকে সে চাইত, তাকেই মন দিয়ে ফেলতে পারত। অন্তরাও বাংলাদেশ সফরের দিনগুলোতে আমাদের বন্ধু হয়ে গিয়েছিল।
গান, গণসংগীত, আইপিটিএ, আন্দোলনের সুর—এসব শুনতে শুনতেই আমাদের কৈশোর-যৌবন কেটেছে। আর সেই সুরের কারিগরকে সামনে থেকে দেখা, এ যেন জীবনের অমোঘ এক মহালগ্ন।

প্রথম বিদেশযাত্রার উত্তেজনা আর সেই মাহেন্দ্রক্ষণ
সেবার কলকাতায় পৌঁছে আমরা থেমে থাকিনি। প্রথমেই ফোন করলাম সলিল চৌধুরীর বাসায়। অন্তরা চৌধুরী ছিলেন সেতুবন্ধ। সময় নির্ধারিত হলো। এরপরই শুরু হলো দুরু দুরু বুকের কাঁপন।

কলকাতার এক অভিজাত এলাকা ‘আকাশ দ্বীপ’-এর লিফট বেয়ে আমরা উঠে গেলাম ১০/১২ তলার দিকে। শব্দহীন লিফটও যেন কাঁপছিল আমাদের হৃৎস্পন্দনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। কলিং বেল টিপতেই দরজা খুলে গেল। সামনে দাঁড়িয়ে অন্তরা আর সঞ্চারী। যেন বহুদিনের চেনা কেউ।
মুহূর্তেই ঢুকে এলেন সংগীতের বরপুত্র—সলিল চৌধুরী। আমরা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে। তাঁর হাসিমুখ, কোমল চোখের দৃষ্টি, অথচ গভীরে এক বুদ্ধিজ্যোতির দীপ্তি। আমাদের অভ্যর্থনা করে তিনি নিয়ে গেলেন ড্রয়িংরুমে, যেখানে নরম উঁচু ফরাশ পাতা, ছোট গোল বালিশ, যেন শিল্পীর গানের মতোই পরিচ্ছন্ন, পরিমিতি।
আমাদের বলা হয়েছিল—তিনি এক থেকে দেড় ঘণ্টা সময় দেবেন। এই দেড় ঘণ্টা পরিণত হলো জীবনের সেরা কিছু মুহূর্তে।

বাংলাদেশের কথা তুলতেই তাঁর চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। আফসোস করলেন, বাংলাদেশের নদী, ধানের খেত, কৃষকদের জীবন—সব ঠিকমতো দেখার সুযোগ পাননি।
সলিল চৌধুরী
ফেসবুক

আড্ডা আর তাঁর আন্তরিকতা
নাশতা এল—কাটলেট, চানাচুর, মুরগির বিশেষ কোনো আইটেম, সঙ্গে মিষ্টি। তিনি হেসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোলা খাবে?’ তখনো বুঝিনি, কোলা মানেই কোক-পেপসি। পরে বুঝে একটু লজ্জাই পেয়েছিলাম।
আলোচনার গভীরতা এমন যে আমরা তখন ভুলেও ভাবিনি, এ মানুষটি ভারতীয় উপমহাদেশের সংগীত ইতিহাসের প্রধানতম স্তম্ভদের একজন। মনে হচ্ছিল, এক বেনিফিশিয়াল গাইডের কাছে গল্প শুনছি।
বাংলাদেশের কথা তুলতেই তাঁর চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। আফসোস করলেন, বাংলাদেশের নদী, ধানের খেত, কৃষকদের জীবন—সব ঠিকমতো দেখার সুযোগ পাননি। বললেন, ‘ডাকলে আবার যাব।’
উদীচীর গণসংগীত নিয়ে তাঁর মধুর পরামর্শ ছিল, ‘আরও লোকসুরের সহজিয়া রূপ আনো।’ বাংলাদেশের শিল্পীদের মধ্যে তিনি স্মরণ করলেন কলিম শরাফীকে। পান্না কায়সারের কাছে শুভেচ্ছা পাঠাতে বললেন।

আড্ডা জমে উঠতেই মনে হলো, আমরা যেন কোনো মহাতারকার কাছে নই; বরং এক অমায়িক, প্রাণখোলা দাদার কাছে। তাপস শেষমেশ সলিল চৌধুরীর কণ্ঠে রেকর্ড করা ‘ঘুম ভাঙার গান’-এর ক্যাসেটে তাঁর স্বাক্ষর নিল।
মানুষটিকে যতটা দেখেছি, ততটাই বিস্মিত হয়েছি—সখ্যে, হৃদ্যতায়, বোঝাপড়ায়। সেদিন মনে হয়েছিল, একমাত্র সত্যিকারের শিল্পীরাই এমন বিস্তার নিয়ে একজন তরুণের সঙ্গে কথা বলতে পারেন।

মানুষটিকে যতটা দেখেছি, ততটাই বিস্মিত হয়েছি—সখ্যে, হৃদ্যতায়, বোঝাপড়ায়। সেদিন মনে হয়েছিল, একমাত্র সত্যিকারের শিল্পীরাই এমন বিস্তার নিয়ে একজন তরুণের সঙ্গে কথা বলতে পারেন।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গে সলিল চৌধুরীর জন্ম। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

যেখানে শুরু এক বিস্ময়ের
১৯২৫ সালের ১৯ নভেম্বর দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার সোনারপুর থানার রাজাপুরের গাজীপুর গ্রামে জন্ম নেন সলিল চৌধুরী। আট ভাইবোনের মধ্যে দ্বিতীয় সন্তান। শৈশব কেটেছে কোদালিয়ার মামাবাড়িতে। প্রথম পড়াশোনা সেখানেই। পরে হরিণাভি বিদ্যালয়ে ম্যাট্রিক পাস। চা-বাগানের চিকিৎসক বাবা জ্ঞানেন্দ্রময় চৌধুরী, যিনি ছিলেন সংগীতজ্ঞ, ব্রিটিশবিরোধী এক দৃঢ়চেতা মানুষ। সেই বিখ্যাত ঘটনার কথা অনেকেই জানেন—এক ব্রিটিশ ম্যানেজার তাঁকে ‘ইউ ডার্টি নিগার’ বলে অপমান করায় তিনি ঘুষিতে তাঁর দাঁত ফেলে দেন।
চা-বাগানের সেই সবুজে ঘেরা পরিবেশ, পশ্চিমা সংগীতের বিশাল সংগ্রহ, গ্রামোফোন—এসবই সলিলের শিশুমনকে গড়ে তুলেছিল অনন্যভাবে। মোজার্ট, বিটোফেন, পাশ্চাত্য সিম্ফনি, আবার অন্যদিকে অসমিয়া লোকসংগীত, বাংলার গানের সুর—এখান থেকেই জন্ম নেয় তাঁর বহুত্ববাদী সংগীতদর্শন। পরে পিতৃব্য নিকি চৌধুরী ও জ্যাঠতুতো ভাই নিখিল চৌধুরীর কাছ থেকেও পেলেন হাতে-কলমে সুরের দীক্ষা।

যেখানে গান হয় সংগ্রাম
কলকাতায় বঙ্গবাসী কলেজে স্নাতক পড়াকালেই সলিল চৌধুরী যুক্ত হন কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে। তাঁর মধ্যে তখনই ফুটে ওঠে এক সমাজসচেতন শিল্পীর স্বপ্ন। আইপিটিএর সঙ্গে যুক্ত হয়ে বিভিন্ন অঞ্চলে সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে তিনি গড়ে তুলেছিলেন বৃহত্তর গণমানুষের সংগ্রামের মঞ্চ। মাত্র ২২ বছর বয়সে তিনি লেখেন ও সুর দেন ‘গাঁয়ের বধূ’, যা আজও গণসংগীতের ইতিহাসে এক জাজ্বল্যমান মাইলফলক।

সলিল চৌধুরীর সুরে সুকান্ত ভট্টাচার্যের বিখ্যাত কবিতা ‘রানার’-এ কন্ঠ দিয়েছিলেন লতা মঙ্গেশকর
সংগৃহীত
তিনি অনায়াসে বাজাতে পারতেন—বাঁশি, অ্যাকর্ডিয়ান, পিয়ানো, এসরাজ, গিটার, ম্যান্ডোলিন। কাউকে গুরু মানেননি, তবু তিনি সৃষ্টি করেছেন এক নতুন সংগীত বিদ্যালয়। তাঁকে নিয়ে লতা মঙ্গেশকর বলেছিলেন, ‘আমার দেখা সেরা শিক্ষিত কম্পোজার।’ বাংলা গানের মাইল ফলকে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে সলিলের সুরে লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া ‘সাত ভাই চম্পা’ , ‘না যেওনা, ওগো আর কিছু তো নাই, ‘ও মোর ময়না গো গান’ গানগুলো ।

চলচ্চিত্রে প্রবেশ: এক গল্প বদলে দিল তাঁর জীবন

হিন্দি ও বাংলা সহ ভারতের ১৪ টি ভাষায় গান বেঁধেছিলেন সলিল। তাঁর লেখা ছোটগল্প ‘রিক্সাওয়ালা’ পড়ে বিমল রায় এতই মুগ্ধ হন যে সেটিকে অবলম্বন করে নির্মাণ করেন অমর চলচ্চিত্র ‘দো বিঘা জমিন’ (১৯৫৩)। সংগীত পরিচালনার দায়িত্ব দেন সলিলকে। এই ছবি আন্তর্জাতিক সাফল্য পায়, কান চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কৃত হয়। এখান থেকেই শুরু হয় সলিল চৌধুরীর বিশাল চলচ্চিত্রজীবন।
এরপর আসতে থাকে—
‘মধুমতি’ (১৯৫৮)—ফিল্মফেয়ার সেরা সংগীত পরিচালক
‘চেম্মীন’ (১৯৬৫)—রাষ্ট্রপতির স্বর্ণপদক
‘আনন্দ’ (১৯৭১)—‘কাঁহি দূর যব দিন ঢল যায়ে’
‘রজনীগন্ধা’, ‘ছোটি সি বাত’
‘কানুন’, ‘ইত্তেফাক’ (অমোঘ ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর)
লোকসুর ও পাশ্চাত্য অর্কেস্ট্রেশনের এমন দক্ষ মেলবন্ধন ভারতীয় সংগীতে আগে দেখা যায়নি। তিনি ছিলেন সত্যিকারের পথিকৃৎ।

বহু বাদ্যযন্ত্রে পারদর্শিতা: স্বশিক্ষিত এক সুরপ্রতিভা
তিনি অনায়াসে বাজাতে পারতেন—বাঁশি, অ্যাকর্ডিয়ান, পিয়ানো, এসরাজ, গিটার, ম্যান্ডোলিন। কাউকে গুরু মানেননি, তবু তিনি সৃষ্টি করেছেন এক নতুন সংগীত বিদ্যালয়। তাঁকে নিয়ে লতা মঙ্গেশকর বলেছিলেন, ‘আমার দেখা সেরা শিক্ষিত কম্পোজার।’

তাঁকে নিয়ে নিজের অনুভূতি জানাতে গিয়ে আরেক কিংবদন্তি শচীন দেববর্মনের আক্ষেপ, ‘পঞ্চম (শচীনের ছেলে রাহুল দেববর্মন) সারা দিন তোমার গান শোনে, আমারটা না।’

সলিল চৌধুরী
ফেসবুক থেকে

সুরে সুরে অমর কণ্ঠ
তাঁর সুরে গেয়েছের লতা, রফি, মান্না দে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মুকেশ থেকে শুরু করে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, কিশোর কুমার, শ্যামল মিত্র,সবিতা চৌধুরী, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, প্রতিমা বন্দোপাধ্যায়, জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়, সুবীর সেন, পিন্টু ভট্টাচার্য, অনুপ ঘোষাল, সাগর সেন, অরুন্ধতী হোম চৌধুরী প্রমুখ প্রথিতযশা সংগীত শিল্পী। ইলাইয়ারাজা এমনকি এ আর রাহমান—অনেকেই তাঁকে অনুপ্রেরণা হিসেবে মেনেছেন। তাঁর বাংলার গানের অমর সৃষ্টিগুলো হলো ‘উজ্জ্বল একঝাঁক পায়রা’, ‘আয় বৃষ্টি ঝেঁপে’, ‘মনের বসন্ত এসো’, ‘সাত ভাই চম্পা জাগো’, ‘ধিতাং ধিতাং বোলে’, ‘পথ হারাব বলেই পথে নেমেছি’, ‘ঝড়ের কাছে রেখে গেলাম আমার ঠিকানা’। সবই সুরের ইতিহাসে উত্তীর্ণ। বাঙালির শৈশব মানে সলিল চৌধুরীর ছোটদের গান; অন্তরা চৌধুরীর ‘বুলবুল পাখি ময়না টিয়ে’, ‘সোনা ব্যাঙ ও কোলা ব্যাঙ’, ‘এক যে ছিল মাছি’, ‘হবু চন্দ্র গোবু চন্দ্র’, ‘পুজোর গন্ধ এসেছে’, ‘ইস্কাবনের দেশে’, ‘খুকুমণি গো সোনা’, ‘ও মাগো মা’ ইত্যাদি গান।
কয়্যার, অর্কেস্ট্রেশন, পলিফোনি—তিনি এক নতুন সংগীতধারা তৈরি করেছিলেন। বম্বে ইয়ুথ কয়্যার, কলকাতা ইয়ুথ কয়্যার—তাঁর সৃষ্টি। দুই শতাধিক শিল্পীকে একসঙ্গে সমবেত করে গান গাইয়েছেন এবং একটুও বেসুরো হয়নি।
ব্যক্তিগত জীবন ও বাংলাদেশের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক
তিনি প্রথমে বিয়ে করেন চিত্রশিল্পী জ্যোতি চৌধুরীকে; পরে তাঁর ছাত্রী-গায়িকা সবিতা চৌধুরীকে। সন্তান—দুই কন্যা, এক পুত্র। তাঁদের মধ্যে অন্তরা চৌধুরী আজও বাংলা গানের উজ্জ্বল নক্ষত্র।
১৯৮৮ সালে উদীচীর আমন্ত্রণে তিনি পরিবারসহ বাংলাদেশ সফর করেন। ঢাকা, ময়মনসিংহ, যশোরে অংশ নেন অনুষ্ঠানে। ২০১২ সালে বাংলাদেশ তাঁকে মরণোত্তর মুক্তিযোদ্ধা মৈত্রী সম্মান দেয়।

সলিল চৌধুরীর সুরে সুকান্ত ভট্টাচার্যের বিখ্যাত কবিতা ‘অবাক পৃথিবী’-তে কন্ঠ দিয়েছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়
সংগৃহীত

আকাশ দ্বীপের সেই রাত: স্মৃতিতে অমর
১৯৯৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর তিনি প্রয়াত হন। কিন্তু তাঁর রেখে যাওয়া সুর-ধর্ম, শব্দ-মহাবিশ্ব, সংগীত-রাজনীতি—সবই আজও সমান শক্তিতে বেঁচে আছে।

সেদিন ‘আকাশ দ্বীপ’-এর সেই উঁচু ফরাশে বসে আমরা শুনেছিলাম একজন শিল্পীর নয়, এক মহাবিশ্বের গল্প। তাঁর কথায় ছিল মানুষের প্রতি বিশ্বাস, দেশের প্রতি মমতা, তরুণদের প্রতি অদ্ভুত টান। লিফট দিয়ে নিচে নামার সময় মনে হয়েছিল, জীবনের এক মহাপর্ব শেষ হলো। আজও মনে পড়ে তাঁর চোখের উজ্জ্বলতা, প্রাণখোলা হাসি, অজস্র গল্প।
তাঁর জন্মদিনে তাঁকে স্মরণ করতে গিয়ে মনে হয়, তিনি ছিলেন তাঁর সুরের মতোই—গভীর, পরিশীলিত, সহজ, বিশাল; যাঁর স্মৃতি, যাঁর গান, যাঁর সুর—যুগের পর যুগ বয়ে যাবে নদীর জলের মতো।

মানজার চৌধুরী সুইট,সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠীর সাধারণ সম্পাদক।