তাহলে এটা হাসন রাজার ছবি নয়?

হাসন রাজার স্বজনেরা বলছেন, বহুল ব্যবহৃত এই ছবিটি হাসন রাজার নয়, এটি মূলত প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা শুনে আঁকা কল্পিত একটি ছবি।
ছবি : সংগৃহীত
পাকা গোঁফ, চওড়া নাক আর মাথায় পাগড়ি—মরমি কবি হাসন রাজার এ ছবিই সবচেয়ে বেশি প্রচার পেয়েছে। মুক্ত বিশ্বকোষ উইকিপিডিয়া তো বটেই, যুগের পর যুগ ধরে বেশির ভাগ গণমাধ্যমেও ব্যবহৃত হয়েছে ছবিটি। তবে হাসন রাজার স্বজনেরা বলছেন, বহুল ব্যবহৃত ছবিটি হাসন রাজার নয়, এটি মূলত প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা শুনে আঁকা কল্পিত একটি ছবি।

ছবিটি তাহলে কোথা থেকে এল
হাসন রাজার প্রপৌত্র ও গবেষক সামারীন দেওয়ান প্রথম আলোকে বললেন, ২০০২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘হাসন রাজা’ সিনেমায় ব্যবহারের জন্য ছবিটি আঁকিয়ে নিয়েছিলেন তাছাওয়ার রাজা। সম্পর্কে তিনিও হাসন রাজার প্রপৌত্র এবং সিনেমাটির অন্যতম পৃষ্ঠপোষক। হাসন রাজার জীবনী অবলম্বনে ছবিটি নির্মাণ করেন প্রয়াত পরিচালক চাষী নজরুল ইসলাম। নামভূমিকায় অভিনয় করেন হেলাল খান, সিনেমার প্রযোজকও তিনি।

হেলাল খান প্রথম আলোকে জানান, সে সময় তিনবার হাসন রাজার জন্মস্থানে গিয়েছিলেন তাঁরা, এক শতবর্ষী নারীসহ বেশ কয়েকজন প্রবীণের কাছে হাসন রাজার চেহারার বর্ণনা শুনেছিলেন। শুনে শুনে হাসন রাজার একটি কল্পিত মুখাবয়ব পেয়েছিলেন তাঁরা। সেই কল্পনা থেকেই হাসন রাজার তরুণ বয়সের কয়েকটি ছবি আঁকা হয়েছিল।

গবেষক সামারীন বলেন, সিনেমাটি মুক্তির পর সবার নজরে আসে সেই ছবি। ফলে দ্রুততম সময়ে বই, পত্রপত্রিকাসহ বিভিন্ন মাধ্যমে ছবিটি ছড়িয়ে পড়ে। ফলে অনেকে ভাবেন, এটিই বোধ হয় হাসন রাজার আসল চেহারা। তবে এ ছবির সঙ্গে হাসন রাজার মূল চেহারার কোনো মিল নেই। অথচ গত দুই দশকে সেই ছবিকে অনুসরণ করে ভূরি ভূরি ছবি আঁকা হয়েছে। এক ছবি থেকে আরেক ছবিতে গিয়ে হাসন রাজার চেহারাও বদলে গেছে। কল্পনার আশ্রয়ে আঁকা এসব ছবিকে স্বাভাবিকভাবেই হাসন রাজার ছবি বলতে তাঁরা নারাজ।

হাসন রাজার আসল ছবি তাহলে কোনটা
গবেষক সামারীন দেওয়ান জানান, জীবদ্দশায় ক্যামেরায় তোলা হাসন রাজার একটিমাত্র ছবি তাঁদের সংগ্রহে আছে। তবে ছবিটি সেভাবে প্রচারের আলোয় আসেনি, এত দিন তাঁদের পরিবারের মধ্যেই এটি সীমাবদ্ধ ছিল। এর বাইরে হাসন রাজার আর কোনো ছবির সন্ধান পাওয়া যায়নি।

জীবদ্দশায় ক্যামেরায় তোলা হাসন রাজা একমাত্র ছবিটি কলকাতার একটি স্টুডিওতে তোলা হয়েছিল।
ছবি: হাসন রাজার পরিবারের সৌজন্যে।

১৯১৪ সালের নভেম্বরে কলকাতার একটি স্টুডিওতে ছবিটি তোলা হয়েছিল, জানান সামারীন। কলকাতায় নিয়মিত আসা-যাওয়া ছিল হাসন রাজার। সেবারই শেষবারের মতো কলকাতায় গিয়েছিলেন তিনি। সামারীন বলেন, ছবিটি তুলে বেশ কয়েকটা কপি এনে বাড়িতে গানের আসরের সঙ্গী, প্রতিবেশী ও নিজের বংশধরদের কাছে বিলি করেছিলেন। বংশপরম্পরায় দাদা থেকে বাবা, বাবা থেকে নিজের হাতে ছবিটি পেয়েছেন বলে জানান সামারীন। তাঁর ভাষ্য, ছবিটি সংরক্ষণ করা না গেলে হাসন রাজার চেহারা-স্মৃতি বিলীন হয়ে যেত। ফলে ছবিটির বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে।

ছবিটি সংরক্ষণের জন্য ২০১৮ সালে বাংলাদেশ কপিরাইট অফিসে মেধাস্বত্ব পেতে আবেদন করেন হাসন রাজার উত্তরাধিকারীরা। যাচাই-বাছাইয়ের পর তাঁদের সেই ছবির মেধাস্বত্ব সনদ দেওয়া হয়েছে বলে জানান সামারীন। এর আগে ২০১৫ সালে ঢাকার মাওলা ব্রাদার্স থেকে প্রকাশিত গবেষক সামারীন দেওয়ানের হাসন রাজা: জীবন ও কর্ম গ্রন্থেও মূল ছবিটি ব্যবহৃত হয়েছে। ২০০৬ সালে সুনামগঞ্জের সুরমা নদীর পারে হাসন রাজা জাদুঘর প্রতিষ্ঠার পর ২০০৮ সাল থেকে ছবিটি দর্শনার্থীদের জন্য প্রদর্শিত হচ্ছে।

‘নিশা লাগিল রে’, ‘লোকে বলে বলে রে’, ‘সোনা বন্ধু আমারে দেওয়ানা বানাইল’–এর মতো বহু জনপ্রিয় গানের স্রষ্টা হাসন রাজা; তিনি ১৮৫৪ সালে তৎকালীন সিলেট জেলার সুনামগঞ্জের লক্ষ্মণশ্রী পরগনার তেঘরিয়া গ্রামে জন্ম নেন। ১৯২২ সালের ৬ ডিসেম্বরে তিনি মারা যান। গতকাল তাঁর প্রয়াণের শতবর্ষ পূর্ণ হয়েছে।