‘আমাকে তাড়াতাড়ি ছাড়ুন’, হাসপাতালে কেন বারবার বলতেন মান্না দে

ঢাকায় একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০৯ সালে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন সংগীতশিল্পী মান্না দে। তখন প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাত্কারের সময় তোলা ছবি

১ মে বিশ্ব শ্রম দিবস। শ্রম আর সৃজনশীলতা যেখানে একসূত্রে গাঁথা, সেদিনই জন্মেছিলেন বাংলা ও ভারতীয় উপমহাদেশের সংগীতজগতের এক অনন্য সাধক-মান্না দে। যিনি কেবল গায়ক নন, ছিলেন এক জীবন্ত সংগীতশিল্পী, যাঁর প্রতিটি সুর ছিল সাধনার মতো। এই দিনেই যেন আরও একবার ফিরে দেখা দরকার তাঁর জীবন, ভালোবাসা আর অপূর্ণ থেকে যাওয়া একটি চিরকথার গল্প।

গান নয়, জীবনের সাধক ছিলেন তিনি
১৯১৯ সালের ১ মে কলকাতার একটি বাঙালি পরিবারে জন্ম নিয়েছিলেন প্রবোধ চন্দ্র দে। সংগীতানুরাগী পরিবারে বেড়ে ওঠা, কাকা কৃষ্ণচন্দ্র দে ছিলেন তাঁর জীবনের প্রথম গুরু ও অনুপ্রেরণা। ডাকনাম ছিল ‘মান্না’, আর এই নামেই একদিন গানের আকাশে অমর হয়ে উঠলেন তিনি—মান্না দে। ছেলেবেলা থেকেই গান ছিল তাঁর নেশা, অথচ একই সঙ্গে তিনি ছিলেন ক্রীড়ানুরাগীও। ফুটবল, কুস্তি, এমনকি বক্সিংয়েও ছিলেন দারুণ দক্ষ। এমনকি পরিবারে অনেকেই চেয়েছিলেন, মান্না একদিন হবেন নামকরা আইনজীবী। কিন্তু তাঁর আত্মা তখন সুরের পথেই এগিয়ে যাচ্ছে। স্কুল-কলেজে সংগীত প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়ে নজর কেড়েছেন বারবার। কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজে পড়াকালীন তিনটি ভিন্ন বিভাগে আন্তকলেজ সংগীত প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়ে চমকে দিয়েছিলেন বিচারকদের। এখান থেকেই শুরু মান্না দের দীর্ঘ সংগীতজীবনের পথচলা, যা তাঁকে নিয়ে গেছে সারা ভারতের মানুষের হৃদয়ে। বাংলা-হিন্দি ছাড়াও গেয়েছেন মারাঠি, গুজরাটি, মালয়ালম, কন্নড়সহ বহু ভাষায়। ‘সবাই তো সুখী হতে চায়’, ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা’, ‘জীবন খাতে কে পায়’ এমন গান শুধুই গান নয়, একেকটা জীবনের ভাষ্য হয়ে থেকেছে মানুষের মনে।

ভালোবাসার গল্পটাও যেন উপন্যাসের মতো
মান্না দের জীবনের সবচেয়ে মায়াময় অধ্যায় তাঁর প্রেম। ১৯৫০-এর দশকে একটি রবীন্দ্রজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে প্রথম দেখা হয় সুলোচনা কুমারনের সঙ্গে। অবাঙালি হয়েও সুলোচনার ছিল রবীন্দ্রসংগীতে গভীর অনুরাগ। সেদিন মঞ্চে একসঙ্গে গান গেয়েছিলেন মান্না দে ও সুলোচনা, ‘আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ, সুরেরও বাঁধনে।’ গান গাইতে গাইতেই গড়ে উঠেছিল সুরের সেই বন্ধন, যা পরে হয়ে ওঠে জীবনের বন্ধন। দুজনের মধ্যে তৈরি হয় ভালোবাসা, বিশ্বাস আর একে অপরের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা। তবে এই সম্পর্ক মেনে নিতে চায়নি মান্না দের পরিবারের অনেকেই। তবু পাশে ছিলেন তাঁর মা মহামায়া, যিনি পুত্রের পাশে দাঁড়িয়ে সব বাধা অতিক্রম করতে সাহস দেন। ১৯৫৩ সালে মান্না দে ও সুলোচনার বিয়ে হয়। বিয়ের পরের জীবন ছিল সংগীত ও ভালোবাসায় ভরপুর। সুলোচনার অনুপ্রেরণাই মান্না দেকে অনেক নতুন গান করতে সাহস জুগিয়েছে, জীবনের বাঁকে বাঁকে থেকেছেন ছায়ার মতো।

১৯১৯ সালের ১ মে কলকাতার একটি বাঙালি পরিবারে জন্ম নিয়েছিলেন প্রবোধ চন্দ্র দে
কোলাজ

এক ছবির দিকে তাকিয়েই কাটত দিন
এই সুখের গল্পে ছেদ পড়ে ২০১২ সালে। সুলোচনা ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। স্ত্রীকে হারিয়ে ভেঙে পড়েন মান্না দে। এরপর থেকে নিজের ঘরে স্ত্রীর একটি বড় ছবি টাঙিয়ে রেখেছিলেন তিনি। দিনের পর দিন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা, চুপ করে বসে তাকিয়ে থাকতেন ছবিটার দিকে। চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ত অশ্রু। তাঁর একটাই ইচ্ছা ছিল, সুলোচনার স্মরণে একটি অ্যালবাম করবেন। নিজেই গাইবেন সেই গানগুলো, যেগুলোর প্রতিটি লাইনে থাকবে ভালোবাসা, স্মৃতি আর শ্রদ্ধা। তিনি চাইছিলেন সেখানে থাকুক দুটি রবীন্দ্রসংগীতও, যা একসময় তাঁদের প্রেমের সাক্ষী ছিল।

আমাকে তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিন
২০১৩ সালের জুন মাসে অসুস্থ হয়ে ভর্তি হন বেঙ্গালুরুর নারায়ণ হৃদয়ালয়ে। তখনো বারবার বলতেন চিকিৎসকদের, ‘আমাকে একটু তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিন, স্ত্রীর স্মরণে একটা অ্যালবাম করছি।’ চিকিৎসক দেবী শেঠি বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর আবেগ। সুলোচনার একটি ছবি এনে মান্না দের কেবিনে লাগিয়ে দেন তিনি। কিন্তু সময় আর শরীর তখন আর সায় দেয় না। ধীরে ধীরে অবনতির দিকে যেতে থাকে তাঁর শারীরিক অবস্থা। শেষ পর্যন্ত ২০১৩ সালের ২৪ অক্টোবর, ৯৪ বছর বয়সে না-ফেরার দেশে চলে যান মান্না দে।

স্ত্রী আর দুই মেয়ের সঙ্গে মান্না দে। ছবি: ফেসবুক

শেষ গানটা আর গাওয়া হলো না
সেই অ্যালবাম, সেই গান, যেটা তিনি গাইতে চেয়েছিলেন শুধু একজন মানুষকে মনে রেখে, সেটাই আর গাওয়া হলো না। তাঁর সুরেলা জীবনের গল্পে থেকে গেল একটি অপূর্ণ অধ্যায়, একটি অসমাপ্ত অ্যালবাম, একটিমাত্র না পাওয়া ইচ্ছা। আর ঠিক এখানেই মান্না দে হয়ে ওঠেন আরও মানবিক, আরও মায়াময়। কারণ, শিল্পীর জীবনের সবচেয়ে সত্যিকারের গানটি ছিল ভালোবাসা, যার সুর রেকর্ড না হলেও রয়ে গেছে তাঁর চোখের জলে, অগণিত মানুষের হৃদয়ে।

মান্না দে ও রুনা লায়লা
সংগৃহীত

মান্না দে আমাদের রেখে গেছেন যা...
তিনি গেছেন, কিন্তু রেখে গেছেন হাজারো গান, কোটি মানুষের স্মৃতি আর এক অনন্য শিল্পীসত্তা। তাঁর গান শুধু বিনোদন নয়, সময়ের দলিল, জীবনের গল্প। তাঁর শেষ ইচ্ছাটা অপূর্ণ রয়ে গেলেও, তাঁর সৃষ্টিগুলো আজও আমাদের জীবনে পূর্ণতা আনে। প্রতিদিন, প্রতিক্ষণে।