আলাউদ্দিন আলী বেঁচে থাকবেন তাঁর সুরের মায়াজালে সংগীতপ্রেমীর অন্তরে

সংগীত ব্যক্তিত্ব আলাউদ্দিন আলী। ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশি সংগীতের কিংবদন্তি সুরকার ও সংগীত পরিচালক আলাউদ্দিন আলীর জন্মদিন আজ। গুণী এই মানুষের জন্ম ১৯৫২ সালের ২৪ ডিসেম্বর মুন্সিগঞ্জের টঙ্গিবাড়ী উপজেলার বাঁশবাড়ি গ্রামে। তাঁর বাবা ওস্তাদ জাদব আলী। মায়ের নাম জোহরা খাতুন।

পুরো সত্তর দশক তিনি মাতিয়ে রেখেছিলেন তাঁর সম্মোহনী সুরের মায়াজালে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কাজ করেছেন, সেই মায়াজালে শ্রোতাদের বন্দী করে রেখেছিলেন তিনি। তাঁর এ সাফল্যের পেছনে ছিল তাঁর অধ্যবসায়, শ্রম ও মেধা। শিল্পী ও শ্রোতাদের মতে, তিনি বেঁচে থাকবেন তাঁর সুরের মায়াজালে মুগ্ধ সংগীতপ্রেমীর অন্তরে চিরকাল।
সংগীত পরিবার থেকে এসেছেন আলাউদ্দিন আলী। তাঁর আত্মীয়স্বজনও ছিলেন সংগীত পরিবারের। ফলে এক সংগীত আবহে বেড়ে উঠেছিলেন তিনি। উচ্চাঙ্গসংগীতে তালিম নিয়েছেন পরিবারেরই গুণীজনদের কাছে। সেই তালিমকে তাঁর অসাধারণ মেধা দিয়ে আত্মস্থ করেছেন। সেই সঙ্গে দেশ–বিদেশের বৃহত্তর সংগীতজগতের সঙ্গেও পরিচিত হয়েছেন, নিজেকে ঋদ্ধ করেছেন। কিশোর বয়স থেকেই বেহালা বাজাতেন ঢাকা অর্কেস্ট্রাতে। এই সুবাদেই তিনি সে সময়ের বিখ্যাত সংগীত পরিচালক সুবল দাস, আলী হোসেন, শহীদ আলতাফ মাহমুদ, খান আতাউর রহমান, খন্দকার নুরুল আলম, সত্য সাহা, আনোয়ার পারভেজের মতো গুণীদের সংস্পর্শে এসেছেন, খুব কাছ থেকে দেখেছেন, শিখেছেনও। আনোয়ার পারভেজের সঙ্গে তিনি সহকারী হিসেবেও কাজ করেছেন।

অসংখ্য জনপ্রিয় গানের স্রষ্টা আলাউদ্দিন আলী। তবে শুরুটা হয়েছিল ব্যর্থতার মধ্য দিয়ে। তিনি চলচ্চিত্রে প্রথম কাজ করেন ১৯৭৪ সালে। মীর মোহাম্মদ হালিম পরিচালিত ওই ছবির নাম ‘সন্ধিক্ষণ’, মুক্তি পায় ১৯৭৬ সালে। কিন্তু না, সাফল্যের জন্য তাঁকে দুই বছর অপেক্ষা করতে হয়। ১৯৭৮ সাল, আমজাদ হোসেন তৈরি করেন ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’। এই ছবির জন্য আলাউদ্দিন আলী তৈরি করেন ‘আছেন আমার মোক্তার’ শিরোনামে একটি গান। গানটির গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার আর কণ্ঠ দেন সৈয়দ আব্দুল হাদী। গানটি চুম্বকের মতো কাজ করে ওই সময়। শ্রোতারা অবাক হয়ে শোনেন গানটি। একই ছবির আরেকটি গান তখন দারুণ জনপ্রিয়তা পায়, ‘হায় রে কপাল মন্দ, চোখ থাকিতে অন্ধ’। এই গানের গীতিকারও আমজাদ হোসেন। দুটি গানই আলাউদ্দিন আলীকে নিয়ে যায় অন্য জায়গায়।

একই বছর মুক্তি পায় ‘ফকির মজনু শাহ’ নামের আরেকটি ছবি। এই ছবির ‘প্রেমের আগুনে’, ‘সবাই বলে বয়স বাড়ে’ আর ‘চোখের নজর এমনি কইরা’ গানগুলো আলাউদ্দিন আলীর ব্যাপারে সবাইকে আগ্রহী করে তোলে। প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আলাউদ্দিন আলী বলেছিলেন, ‘প্রথম ছবির সংগীত পরিচালনার পর দর্শকের সাড়া খুব একটা ভালো ছিল না। ছবিটি ব্যবসায়িক দিক থেকে তেমন সুবিধা করতে পারেনি। তাতে দুঃখ পাইনি। কিন্তু “গোলাপী এখন ট্রেনে” ছবির মাধ্যমেই আমি যেন সাফল্যের ট্রেনে চড়ে বসি। এরপর থেকে যা-ই করেছি, শ্রোতা-দর্শক আমাকে দুই হাত ভরে দিয়েছেন, আমাকে ভালোবেসেছেন।’

সংগীত ব্যক্তিত্ব আলাউদ্দিন আলী। ছবি: সংগৃহীত

পিতা ওস্তাদ জাভেদ আলী ও ছোট চাচা ওস্তাদ সাদেক আলীর কাছে সংগীতের হাতেখড়ি। তিনি ছেলেবেলায় বেহালা বাজানোর জন্য অল পাকিস্তান চিলড্রেনস প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পেয়েছিলেন। আলাউদ্দিন আলীর প্রয়াত স্ত্রী নজরুলসংগীতশিল্পী সালমা সুলতানা, তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী মিমি আলাউদ্দিনও একজন আধুনিক গানের শিল্পী। আলাউদ্দিন আলী প্রসঙ্গে দেশের প্রখ্যাত গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার বলেছিলেন, ‘আলাউদ্দিন আলী এত এত ভালো গান সুর করেছেন, নাম বলতে গেলেই কিছুদিন হারিয়ে যাবে। বাংলা চলচ্চিত্রের গান বলতেই একটা সময় উনি। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন সংগীত পরিচালক হিসেবে একাধিকবার। পেয়েছেন গীতিকার হয়ে। তাঁর ভাষায় বলতে গেল, আশাজি, লতাজি ছাড়া এমন কোনো শিল্পী নেই, এ উপমহাদেশে যে আমার গান গায়নি।’

আলাউদ্দিন আলী তেমনই একজন সুরশিল্পী, যিনি সুরের রং দিয়ে অন্তরের বিমূর্ত ভাবনাগুলোকে মূর্ত করে তুলতে পারতেন—এমনটা মনে করেন সৈয়দ আব্দুল হাদী। তিনি বলেছিলেন, ‘ও আমার বাংলা মা তোর আকুল করা রূপের সুধায়’ বা ‘সূর্যোদয়ে তুমি সূর্যাস্তেও তুমি’ গানের মধ্যে স্বদেশ-প্রকৃতির প্রতি যে বিমুগ্ধতা-তন্ময়তা অথবা ‘আমায় গেঁথে দাও না মাগো’ গানের মধ্যে যে স্বজন হারানোর বেদনাবোধ, তা যেন সুরের রংতুলিতে আঁকা একেকটি ছবি। বাংলা দেশপ্রেমের গানের ভান্ডারে এসব গান ভাস্বর হয়ে থাকবে। সাবিনা ইয়াসমীনের মতে, ‘ভারতীয় উপমহাদেশের একজন শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালক আলাউদ্দিন আলী। তাঁরা যুগে যুগে আসেন না। এলে হয়তো এত দিনে চোখে পড়ত, জানতে পারতাম।’
চলচ্চিত্রের গান সাধারণভাবে চলচ্চিত্রের কোনো বিশেষ দৃশ্যের অনুগামী বা সহায়ক, কিন্তু আলাউদ্দিন আলী চলচ্চিত্রের গানকেও মৌলিক গানের মতোই স্বতন্ত্র শিল্প–সুষমামণ্ডিত করে তুলেছেন, এক ভিন্ন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। উচ্চাঙ্গসংগীত ও লোকসংগীতের বিভিন্ন উপাদানের সঙ্গে আধুনিক আঙ্গিকের এক সূক্ষ্ম সংমিশ্রণে তিনি বাংলা গানে, বিশেষ করে চলচ্চিত্রের গানে এক নতুন ধারার সৃষ্টি করে গেছেন; যা সম্পূর্ণভাবেই তাঁর নিজস্ব ঘরানা। অনেক শিল্পী নিয়মিত গাইলেও আলাউদ্দিন আলীর সুরে চলচ্চিত্রের গানে যাত্রা হয়েছিল কনকচাঁপা, মাকসুদ, মিতালী মুখার্জী, কুমার বিশ্বজিৎ, সামিনা চৌধুরী, তপন চৌধুরী, আইয়ুব বাচ্চু ও হাসানের মতো শিল্পীদের।
আলাউদ্দিন আলী মূলত বেহালাবাদক ছিলেন। তিনি ষাটের দশকে বেহালাবাদক হিসেবে চলচ্চিত্রে কাজ শুরু করেন। এ ছাড়া টেলিভিশন ও বেতারে সুরকার হিসেবে নিয়মিত ছিলেন। ‘ও আমার বাংলা মা তোর’, সাবিনা ইয়াসমীনের গাওয়া গানটি তাঁর টেলিভিশনের জন্য প্রথম সুর করা গান। চলচ্চিত্র, বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ টেলিভিশন মিলে প্রায় পাঁচ হাজার গানের সুর সৃষ্টি করেছেন।

‘এই দুনিয়া এখন তো আর সেই দুনিয়া নাই’, ‘আছেন আমার মোক্তার আছেন আমার ব্যারিস্টার’, ‘আমায় গেঁথে দাও না মাগো একটা পলাশ ফুলের মালা’, ‘শত জনমের স্বপ্ন তুমি আমার জীবনে এলে’, ‘কী করে বলিব আমি আমার মনে বড় জ্বালা’, ‘ভালোবাসা যত বড় জীবন তত বড় নয়’, ‘চোখের নজর এমনি কইরা’, ‘যেটুকু সময় তুমি থাকো কাছে মনে হয় এ দেহে প্রাণ আছে’, ‘যে ছিল দৃষ্টির সীমানায়’, ‘একবার যদি কেউ ভালোবাসত’, ‘সূর্যোদয়ে তুমি সূর্যাস্তেও তুমি’, ‘বন্ধু তিন দিন তোর বাড়িত গেলাম’, ‘জন্ম থেকে জ্বলছি মাগো’, ‘সুখে থাকো ও আমার নন্দিনী হয়ে কারও ঘরনি’, ‘একা একা কেন ভালো লাগে না’-এই গানগুলো সুরস্রষ্টা আলাউদ্দিন আলীকে অনন্য উচ্চতায় আসীন করেছে।

আলাউদ্দিন আলী
ছবি: সংগৃহীত

কিংবদন্তি এই সুরকার দীর্ঘদিন ধরে ফুসফুসের প্রদাহ ও রক্তে সংক্রমণের সমস্যায় ভুগছিলেন। প্রথমে ২০১৫ সালের ৩ জুলাই তাঁকে ব্যাংকক নেওয়া হয়েছিল। সেখানে পরীক্ষার পর জানা যায়, তাঁর ফুসফুসে টিউমার রয়েছে। এরপর অন্যান্য শারীরিক সমস্যার পাশাপাশি ক্যানসারের চিকিৎসাও চলছিল। এর আগে বেশ কয়েক দফায় তাঁকে মহাখালীর একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। দীর্ঘদিন ধরে তিনি শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায় ভুগছিলেন। বাংলাদেশ ও ব্যাংককে তাঁর চিকিৎসা হয়। সাভারে সেন্টার ফর রিহ্যাবিলিটেশন অব প্যারালাইজড কেন্দ্রেও চিকিৎসা নিয়েছেন দীর্ঘদিন। মৃত্যুর আগে বাসায় চিকিৎসা চলছিল আলাউদ্দিন আলীর। শারীরিক অবস্থা খারাপের দিকে গেলে ২০২০ সালের ৮ আগস্ট ভোর পৌনে পাঁচটায় তাঁকে মহাখালীর একটি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। অবস্থা বিবেচনা করে তাঁকে দেওয়া হয় লাইফ সাপোর্টে। কিন্তু সব চেষ্টা ব্যর্থ করে ৯ আগস্ট তিনি মারা যান।