বাঘ ছিল জুবিনের, বিটিভি দেখেছেন, আরও যা যা বলেছিলেন সাক্ষাৎকারে
ভারতের জনপ্রিয় গায়ক জুবিন গার্গের জন্মদিন ছিল ১৮ নভেম্বর। দুই মাস আগে সিঙ্গাপুরে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুর কিছুদিন আগে আসামের লেখক রিতা চৌধুরীর পডকাস্টের অতিথি ছিলেন তিনি।
সেই সাক্ষাৎকারে নিজের শৈশব–কৈশোর, গানের সঙ্গে জড়িয়ে পড়া, প্রকৃতির সঙ্গে বসবাস, বলিউডের রঙিন দুনিয়া, আসামের সঙ্গে আত্মার টান, নিজের জীবন নিয়ে ভাবনা–টানাপোড়েন—সবকিছু নিয়েই কথা বলেছিলেন জুবিন গার্গ।
ছোটবেলার দিনগুলো
বাবা ছিলেন ম্যাজিস্ট্রেট। বাবার চাকরির সুবাদে শহর থেকে দূরে মফস্সলে তিনি বেড়ে উঠেছেন। জুবিনের বাবা কবিতা লিখতেন। আর তাঁর মা খুব ভালো গান গাইতেন। মায়ের কাছেই তাঁদের দুই ভাই–বোনের গানের হাতেখড়ি। জুবিনের বাবার পোস্টিং যখন আসামের তেজপুরে, তখন তিন বছর বয়সে তাঁকে প্রথম স্কুলে পাঠানো হয়। ব্রহ্মপুত্র নদের ধারের এই ছোট মফস্সল শহর তাঁর জীবনে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। প্রকৃতি ও পশুপাখির প্রতি আমৃত্যু তাঁর যে প্রেম, সেটার ভিত্তি গড়ে দিয়েছিল তেজপুরের দিনগুলো।
জুবিন বাঘ কাঁধে নিয়ে ঘুরতেন। বাঘটা দুই বছর তাঁর কাছে ছিল। এখনকার মতো মোবাইল ক্যামেরার যুগ ছিল না বলে সেটার কোনো ছবি নেই। তবে তাঁর বন্ধু–স্বজনেরা নিজের চোখে এই দৃশ্য দেখেছেন।
বাঘ কাঁধে ঘুরতেন
তেজপুর থেকে জুবিনের বাবা আসামের আরেক মফস্সল শহর করিমগঞ্জে চলে যান। সেখানে জুবিনের শৈশব–কৈশোরের একটা ভালো সময় কাটে। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত ইংরেজি মাধ্যমে পড়েছেন। চতুর্থ শ্রেণিতে পড়া হয়নি। পঞ্চম শ্রেণিতে তাঁকে বাংলা মাধ্যমে ভর্তি করে দেওয়া হয়। সপ্তম শ্রেণির মাঝামাঝি সময়ে বাবার বদলি হয়ে যায়। জুবিনদের পরিবার চলে যায় বিজনি নামের ছোট আরেক মফস্সল শহরে। সেখানে গিয়ে তাঁকে অসমীয়া ভাষায় পড়াশোনা করে বার্ষিক পরীক্ষা দিতে হয়।
এরপর জুবিনের গন্তব্য ছিল তামুলপুর। সেখানে তাঁর বাবা বেশ বড় একটা বাড়ি পেয়েছিলেন। আশপাশে নানা রকমের পশুপাখি ছিল। সেগুলোর সঙ্গে জুবিনের বন্ধুত্ব হয়ে যায়। একটি বাঘ, দুটি ময়ূর, দুটি হরিণসহ নানা ধরনের পশুপাখিকে সকালে খাবার দিয়ে তিন কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে বিদ্যালয়ে যেতেন। দুপুরে বাড়ি এসে এগুলোকে আবার খেতে দিতেন। আবার বিদ্যালয়ে যেতে যেতে দেরিই হয়ে যেত। শিক্ষকেরা শাসন করলে প্রাণীগুলোর কথা বলতেন। ভালো গান গাইতেন বলে মাফও পেয়ে যেতেন।
ওই সময়ে জুবিন বাঘ কাঁধে নিয়ে ঘুরতেন। বাঘটা দুই বছর তাঁর কাছে ছিল। এখানে থেকে বদলির সময় বাঘটি তাঁর পরিবার বন বিভাগের কাছে দিয়ে যায়। এখনকার মতো মোবাইল ক্যামেরার যুগ ছিল না বলে সেটার কোনো ছবি নেই। তবে তাঁর বন্ধু–স্বজনেরা নিজের চোখে এই দৃশ্য দেখেছেন।
যে হারমোনিয়াম দিয়ে মা প্রথম গান শিখিয়েছিলেন, জুবিন সেটা স্মৃতি হিসেবে নিজের বাড়িতে রেখে দেন।
বিটিভির অনুষ্ঠান দেখতেন
জুবিনরা যখন করিমগঞ্জে থাকতেন, তখন বাংলাদেশ টেলিভিশনে (বিটিভি) সম্প্রচারিত অনুষ্ঠান দেখতে পেতেন। তখন ‘স্পাইডারম্যান’, ‘টারজান’—এসব সিরিয়াল দেখেছেন। বাংলাদেশের সিনেমা দেখতেন।
মা বলতেন, ‘তুই বিএসসিটা দিস’
স্কুলজীবন থেকেই গান লিখে সুর করে গাইতে শুরু করেন জুবিন। দুনিয়ার অন্য বিষয়ে পড়ার প্রতি যত আগ্রহ ছিল, পড়ার বইয়ের ব্যাপারে তা ছিল না। ৭৩ শতাংশ নম্বর পেয়ে ম্যাট্রিক পাস করেছিলেন। পরে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। জুবিনের খুব ইচ্ছা ছিল, যুক্তরাজ্যে সংগীত নিয়ে পড়াশোনা করার। তবে সেটা অনেক ব্যয়বহুল ছিল। ফলে ইচ্ছাটা আর পূরণ হয়নি। তত দিনে আসামে গান নিয়ে অনেক ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন তিনি। স্নাতকের জন্য ভর্তি হন, তবে প্রতিষ্ঠানিক পড়াশোনা আর চালিয়ে যেতে পারেননি।
মা খুব আক্ষেপ করতেন। মৃত্যুর আগপর্যন্ত বারবার তাঁকে বলতেন, ‘তুই বিএসসিটা দিস।’ যতই মাকে বলতেন, গায়ক হয়ে গেছেন আর পড়াশোনা করে কী করবেন! মায়ের মন সেটা মানতে চাইত না।
যে হারমোনিয়াম দিয়ে মা প্রথম গান শিখিয়েছিলেন, জুবিন সেটা স্মৃতি হিসেবে নিজের বাড়িতে রেখে দেন।
জুবিন সব সময় বলতেন, তিনি ‘সেলফ মেইড ম্যান।’ তিনি চান, তাঁর ভেতরের সবটুকু ভালো, সৃজনশীলতা মানুষের জন্য রেখে যেতে। এরপর একদম শূন্য হয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে!
পাশে দাঁড়ালেন ভূপেন হাজারিকা
স্কুল–কলেজে গান করেছেন, এখানে–সেখানে অনুষ্ঠান করতেন। ইচ্ছা হলো, ভালোভাবে অ্যালবাম করার। গান–সুর সব তৈরি। শুধু টাকা নেই। মা ফিক্সড ডিপোজিট ভাঙতে বললেন।
জুবিন স্বনামধন্য গায়ক ভূপেন হাজারিকার স্টুডিওতে যেতেন, তাঁর কাজ দেখতেন। একদিন ভূপেন তাঁকে গান গাইতে বললেন। তিনি গাইলেন, কিছু একটা ভুল করেছিলেন। তখন ভূপেন তাঁকে বললেন, ‘তুমি এর চেয়ে ভালো করে গাও।’
অ্যালবাম বের করার মতো অর্থ যখন জোগাড় হলো, ভূপেন হাজারিকা বললেন, ‘রেকর্ডিং কর, মিক্সিং করার জন্য বোম্বে যা।’ কবিতা কৃষ্ণমূর্তি তখন জনপ্রিয় গায়িকা। তিনি খুব কম টাকায় তাঁর অ্যালবামের জন্য গাইলেন। সুন্দর একটা সম্পর্ক হলো তাঁদের। কবিতা তাঁকে খুব স্নেহ করতেন। বললেন, বোম্বেতে (এখন মুম্বাই) প্রতিষ্ঠা না পাওয়া পর্যন্ত যত দিন ইচ্ছা, তত দিন তাঁর বাড়িতে যেন জুবিন থাকেন।
জুবিন স্বনামধন্য গায়ক ভূপেন হাজারিকার স্টুডিওতে যেতেন, তাঁর কাজ দেখতেন। একদিন ভূপেন তাঁকে গান গাইতে বললেন। তিনি গাইলেন, কিছু একটা ভুল করেছিলেন। তখন ভূপেন তাঁকে বললেন, ‘তুমি এর চেয়ে ভালো করে গাও।’
বলিউড ইন্ডাস্ট্রি ‘বিরক্তিকর’
জুবিন ১২ বছর মুম্বাইতে কাজ করেছেন। তবে কখনোই সেখানে থেকে যাওয়ার কথা ভাবেননি। মুম্বাই তাঁর কাছে ‘বিরক্তিকর’ লাগত। জায়গাটাকে কখনো আপন মনে হয়নি। তিনি মনে করতেন, তিনি আসামের রাজা। তাঁর রাজ্যে তিনিই সবকিছু। এখানের মানুষ তাঁকে ভালোবাসে, আপন ভাবে।
সেই রাজ্য ছেড়ে জুবিন মুম্বাইয়ে থাকতে চাননি। সেখানে অনেক রাজা, আবার কেউই রাজা নন। বড় বড় তারকার মৃত্যুতে সেখানে হাজার হাজার মানুষের শোকযাত্রা হয়নি, হবেও না। অথচ তিনি মারা গেলে আসাম শোকের সাগরে ভেসে যাবে (তাঁর মৃত্যুর পর হয়েছিলও তা–ই)।
জুবিন ১২ বছর মুম্বাইতে কাজ করেছেন। তবে কখনোই সেখানে থেকে যাওয়ার কথা ভাবেননি। মুম্বাই তাঁর কাছে ‘বিরক্তিকর’ লাগত। জায়গাটাকে কখনো আপন মনে হয়নি। তিনি মনে করতেন, তিনি আসামের রাজা। তাঁর রাজ্যে তিনিই সবকিছু। এখানের মানুষ তাঁকে ভালোবাসে, আপন ভাবে।
‘আমি সোশ্যালিস্ট’
জুবিন গার্গ রাজনীতিসচেতন মানুষ ছিলেন। তিনি মানুষের কথা বলতেন, মানুষের ভালোর পক্ষে নিজের অবস্থান জানাতে কখনো দ্বিধা করেননি। তাঁর স্পষ্ট কথা ছিল, ‘আমি একদম নন-পলিটিক্যাল সোশ্যালিস্ট। আমি সোশ্যালিস্ট।’
জুবিন নিজের মতো চলতেন, তাঁর কথা–কাজ নিয়ে নানা আলোচনা–সমালোচনা হতো। তবে এগুলোকে খুব বেশি পাত্তা দেওয়ার মানুষ তিনি ছিলেন না। তিনি নিজের কাজটা করে যেতেন। দিন–রাত কাজ করতেন। তাঁর ভাষ্যে, তিনি একা নন। এর সঙ্গে বহুজনের জীবিকা জড়িয়ে আছে। ফলে তাঁর নিজেকে জাহাজের ক্যাপ্টেন মনে হয়। অনুকূল–প্রতিকূল যে পরিস্থিতিই হোক না কেন, তাঁকে জাহাজ চালিয়ে নিতে হবে। কাজ করতে হবে।
কাজ করতে করতে একটা সময় নিজেকে ‘মেশিনম্যান’ মনে হতে থাকল জুবিনের। তখন গান নিয়ে ব্যবস্ততা কিছুটা কমিয়ে দিলেন। মন দিলেন সিনেমায়। সেখানে অভিনয় করতেন, গান গাইতেন। সিনেমা প্রযোজনা করতে শুরু করেন। সিনেমাগুলো হিট হতো। আয় ঠিকঠাক থাকায় ‘ক্যাপ্টেন’ হিসেবে নিজের কর্মীদের নিয়ে জাহাজটা চালিয়ে যেতে পারতেন।
জুবিন সব সময় বলতেন, তিনি ‘সেলফ মেইড ম্যান।’ তিনি চান, তাঁর ভেতরের সবটুকু ভালো, সৃজনশীলতা মানুষের জন্য রেখে যেতে। এরপর একদম শূন্য হয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে!