সংগীতে শরীরী প্রেমের স্বরূপ সন্ধান

১৩ বছর ধরে দক্ষিণ এশীয় এই সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ব্রিটেনের সংস্কৃতিতে জায়গা করে নিয়েছে সৌধসৌধের সৌজন্যে

প্রেম ও সম্ভোগের রস আস্বাদনের প্রকৃতি মানবসমাজের সবখানেই এক। সম্ভবত সব যুগেও এক। কিন্তু এই সাযুজ্য সম্বন্ধে অসচেতনতা ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন মানবগোষ্ঠীর মধ্যে বিভেদ জিইয়ে রেখেছে। তার ওপর সম্ভোগ বা যৌন মিলনে আনন্দ ও সেই আনন্দের পরপরই বেদনা মানুষকে আপ্লুত করে। তা কেন মানুষকে অশরীরী প্রেমে ডুবিয়ে দেয়, সেটাও গভীর উপলব্ধির ব্যাপার। শরীর ও মনের সম্পর্ক বিশ্বের প্রথম সংগীত থেকেই তাতে প্রভাব রেখেছে। শৃঙ্গার ও পার্থিব প্রণয়ের গান ঠুমরি থেকে ট্রুবাডোর পরিবেশনা বিভিন্ন ভৌগোলিক এলাকায় প্রাচীন সংগীতের মধ্যে সম্পর্ক তুলে ধরেছে—কথাগুলো বলছিলেন এই সংগীত প্রকল্প ও সৌধ সোসাইটি অব পোয়েট্রি অ্যান্ড ইন্ডিয়ান মিউজিকের পরিচালক টি এম আহমেদ কায়সার।
লন্ডনের বিশ্বখ্যাত রয়্যাল অ্যালবার্ট হলে এটি সৌধের দ্বিতীয় পরিবেশনা। ১৩ বছর ধরে দক্ষিণ এশীয় এই সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ব্রিটেনের সংস্কৃতিতে জায়গা করে নিয়েছে। আলোচ্য পরিবেশনায় বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের প্রাচীন ও শাস্ত্রীয় সংগীত ও কবিতার মধ্যকার সাযুজ্য তুলে ধরা হয়েছে পরিচালকের ব্যাখ্যা ও ইংরেজি কবিতাগুলোয়।

আহমেদ কায়সারের প্রবেশিকার সঙ্গে গং ও ২০০০ বছরের পুরোনো তারযন্ত্র গুজেংয়ে সংগীত আবহ রচনা করেন চীনা শিল্পী ইজিয়া তু। তারপরই সদ্য প্রয়াত ওস্তাদ রশিদ খানের সুযোগ্য শিষ্য কোয়েল ভট্টাচার্য বৈদিক স্তব ও সপ্তম শতকের সংস্কৃত কবি অমরুর অমরু শতক ও চতুর্থ শতকের কবি কালিদাসের মেঘদূত থেকে স্তব পরিবেশন করেন।

প্রকল্পটি প্রযোজনা করেছে যুক্তরাজ্যে দক্ষিণ এশীয় শিল্পের সাংস্কৃতিক সংস্থা সৌধ
সৌধের সৌজন্যে

তার সঙ্গে খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০ শতাব্দীতে রচিত সিকিলোর এপিটাফের মেলবন্ধন করেন লারা ইদি। এটাই বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন পূর্ণাঙ্গ সংগীত। লারার পরিবেশনার পাশাপাশি চলে বিশ্বের প্রথম (মেসোপটেমীয়) নারী কবি এনহেদুয়ানার কবিতা।
লারা আরবি মধ্যযুগীয় সংগীত পরিবেশন করেন। সেই সঙ্গে গাঁথা হয় পঞ্চম শতাব্দীতে ইসলামপূর্ব আরবের কবি ইমরুল কায়েসের কবিতা।

সপ্তদশ শতকে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত রচয়িতা সাদারং রচিত ভীমপলশ্রী রাগে কোয়েলের পরিবেশনার সঙ্গে মিশ্রণ করা হয় রোসেলা পরিবেশিত রাইম্বো দো ভাকিরা (১১৮০-১২০৭) ও বেখনাখ দো ভেন্তাদোখের (১১৩০-১১৯০) ট্রুবাডোর, দক্ষিণ ফ্রান্সের অক্সিটান ভাষার গান।
চতুর্দশ শতকের বাঙালি কবি চণ্ডীদাসের কবিতা থেকে পড়েন তাঞ্জিনা নুর–ই-সিদ্দিক। সঙ্গে পরিবেশন করা হয় দেশ রাগে চণ্ডীদাসের রচনা।

লন্ডনের বিশ্বখ্যাত রয়্যাল অ্যালবার্ট হলে এটি সৌধের দ্বিতীয় পরিবেশনা
সৌধের সৌজন্যে

ষোড়শ শতকের অন্ধ কবি সুরদাসের গান পরিবেশন করেন অমিত দে। পরে তিনি লালনগীতিও পরিবেশন করেন।
ফারজানা সিফাত গেয়েছেন হোলি উৎসবের বিখ্যাত ঠুমরি রাঙ্গি দারুঙ্গি। সঙ্গে ছিল তাং বংশের রাজত্বকালে চীনা কবি দু চিয়াংইয়াংয়ের কবিতা। ইজিয়া তু গিজেং বাজিয়ে চতুর্দশ শতকের একটি চীনা লোকগীতি গেয়ে শোনান।

নিধি বাবুর (রামনিধি গুপ্ত) টপ্পা না হলে এমন একটি আসর জমার কথা নয়। তা পরিবেশন করেন গৌরী চৌধুরী ও ফারজানা সিফাত। সঙ্গে ছিল ইতালীয় রাজা ফ্রেদরিগোর (১১৯২-১২৫০) কবিতা।

আলোচ্য পরিবেশনায় বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের প্রাচীন ও শাস্ত্রীয় সংগীত ও কবিতার মধ্যকার সাযুজ্য তুলে ধরা হয়েছে পরিচালকের ব্যাখ্যা ও ইংরেজি কবিতাগুলোয়
সৌধের সৌজন্যে

শুরু থেকে শেষ কবিতা পাঠের সুন্দর কাজটি করেছেন শ্রী গাঙ্গুলী।
যন্ত্র অনুষঙ্গে ছিলেন পশ্চিম বাংলার খ্যাতনামা তবলচি কুন্তল দাস ও কি–বোর্ডে সুনীল যাদব। মা গৌরী চৌধুরীর সঙ্গে তবলা বাজান সৌমেন দত্ত।
এই সংগীত-শৃঙ্গার অত্যন্ত উপভোগ্য ছিল।