নিকেতন থেকে শান্তিনিকেতন, ‘আটটা বাজে দেরি করিস না’ গানের গল্পটা শুনুন

‘আটটা বাজে দেরি করিস না’ গানের মিউজিক অ্যারেঞ্জমেন্ট ও সংগীত পরিচালনা করেছেন ইমন চৌধুরী, গেয়েছেন ভারতীয় লোকগানের শিল্পী বাসু দেব বাউলকোলাজ : প্রথম আলো

‘হাওয়া’ সিনেমার গান ‘আটটা বাজে দেরি করিস না’ ইউটিউবে মুক্তি পেয়েছে ছয় দিন আগে। আজ শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত গানটি ইউটিউবে ৩১ লাখ ৪০ হাজারের বেশি ভিউ হয়েছে এ গানের ভিডিও। ৬২ হাজারের বেশি লাইক পড়েছে, নেই কোনো ডিজলাইক। আর মন্তব্য জমা হয়েছে দেড় হাজারের কাছাকাছি। নানান বয়সী শ্রোতাদের কাছে গানটি পছন্দের তালিকায় আছে। কলকাতার বাসু দেব বাউলের গাওয়া এই গানের মিউজিক অ্যারেঞ্জমেন্ট ও সংগীত পরিচালনা করেছেন ইমন চৌধুরী।

‘আটটা বাজে দেরি করিস না’ গানটি সংগৃহীত। বাসু দেব বাউল ছোটবেলা থেকেই শুনেছেন। তিনিও দীর্ঘদিন নানা জায়গায় গানটি পরিবেশন করেছেন। বাসু দেব বাউলের কণ্ঠে গানটি শুনেছিলেন পরিচালক মেজবাউর রহমান সুমন। এরপর তিনি সিদ্ধান্ত নেন গানটি তাঁর প্রথম চলচ্চিত্রে রাখবেন। সুরকার ও সংগীত পরিচালক ইমন চৌধুরীকে এই গান নিয়ে ভাবার অনুরোধও করেন। ইমন চৌধুরীও লেগে পড়েন, কীভাবে গানটিকে নতুন সংগীতায়োজনে শ্রোতাদের সামনে উপস্থাপন করা যায়।

‘হাওয়া’ চলচ্চিত্রের দৃশ্যে নাজিফা তুষি
ছবি : সংগৃহীত

‘আটটা বাজে দেরি করিস না’ গানটি তৈরির পেছনের গল্প জানতে কথা হয় সংগীত পরিচালক ইমন চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘গানটা প্রথম শুনেছিলেন সুমন ভাই, তিনি আমাকে গানটার খোঁজ দেন। আমি এমনিতে বাসু দেব বাউলের গান শুনতাম। কিন্তু এই গানটা শোনা হয়নি। “হাওয়া” ছবিতে “সাদা সাদা কালা কালা” গানটি তৈরির পর আমরা সবাই ছবির দ্বিতীয় গানটি নিয়ে টেনশনে ছিলাম। ছবির পুরো শুটিং শেষে এই গানের পরিকল্পনা করি। সুমন ভাই আমাকে গানটা শোনানোর পরও বললাম, এইটা সেরা গান। পরে বাসুদেব বাউলের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। পাওয়া গেল তাঁকে। তারপর ভয়েস নিলাম।’

‘আটটা বাজে দেরি করিস না’ গানের মিউজিক অ্যারেঞ্জমেন্ট ও সংগীত পরিচালনা করেছেন ইমন চৌধুরী
ছবি: প্রথম আলো

পাঁচ মাস আগে ‘আটটা বাজে দেরি করিস না’ গানটির রেকর্ডিং করা শান্তিনিকেতনের একটি একটি স্টুডিওতে। আর ঢাকার নিকেতনের স্টুডিও থেকে সার্বক্ষণিক ভিডিওকলে ছিলেন ইমন চৌধুরী। ‘করোনার কারণে আমি শান্তিনিকেতন যেতে পারিনি। কিন্তু গানের সব ট্র্যাক তৈরি করে পাঠিয়ে দিই। গানটার ভয়েস দিয়েছেন তিনি শান্তিনিকেতনে। ওই জায়গায় ছিল বগা তালেব, তারে ফোনে বললাম, আমার কাজটা করে দিতে হবে। সে তো আমার কলিজার ভাই, বলছে, ভাই আপনি একদম টেনশন নেবেন না। আমিই ব্যবস্থা করছি। তারপর বগা তালেব নিজে গিয়ে বাসু দেব বাউলের ভয়েসটা নিয়েছে। আমি নিকেতনের স্টুডিওতে থেকে সারাক্ষণ ভিডিওকলে ছিলাম।’ বললেন ইমন চৌধুরী।

বাসু দেব বাউল, ‘হাওয়া’ চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত ‘আটটা বাজে দেরি করিস না’ গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছেন ভারতীয় লোকগানের এই শিল্পী
ছবি : সংগৃৃহীত

‘আটটা বাজে দেরি করিস না’ গানটি “হাওয়া” ছবির আরেকটি গান বাদ দিয়ে রাখা হয়েছে বলে জানালেন ইমন চৌধুরী। আর গানটি একদম শেষ মুহূর্তে ছবিতে যুক্ত করা হয়েছে বলেও জানালেন তিনি। ইমন চৌধুরী বললেন, ‘বাসু দেব বাউল সব সময় যেভাবে গানটা গেয়েছেন, তিনি যে টাইপের ইনস্ট্রুমেন্ট ব্যবহার করতেন, নতুন করে গানটি তৈরির সময় ওই বিষয়টা মাথায় রেখেছিলাম। কথা ও সুর সংগৃহীত, তাই মিউজিক অ্যারেঞ্জমেন্ট ও সংগীত পরিচালনায় বর্তমান সময়ের তরুণদের আকৃষ্ট করা যায় কীভাবে, তা–ও ভাবছিলাম। একই সঙ্গে মূল জায়গা যেন ঠিক থাকে, তা–ও মাথায় ছিল। আট বছর আগের একটা ভিডিও পেয়েছিলাম, যেখানে বাসু দেব বাউলের ঢংটা ছিল। চেয়েছি ওইটার কাছাকাছি রাখতে। আমি সবকিছু তৈরির পর বাসু দেব বাউলকে শোনালাম। জানতে চাইলাম যে গানটা কি এখন ঠিকঠাক আছে?

‘হাওয়া’ চলচ্চিত্রের দৃশ্যে নাজিফা তুষি
ছবি : সংগৃহীত

তিনি বললেন, গানটা ভাবে আছে। আমি এমনিতে কোনো গান তৈরির পর যখন শিল্পী গাইবার জন্য তৈরি হন, জিজ্ঞেস করি, স্কেল ঠিক আছে কি না। কোনো পর্যবেক্ষণ আছে কি না। কারণ, আমি যতই কিছু করি না কেন, শিল্পী যদি আনন্দ নিয়ে আরাম করে গানটি গাইতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ না করেন, তাহলে তো হবে না। তিনি যখন হ্যাঁ বললেন, আমি রেকর্ডিংয়ের প্রস্তুতি নিই। ঢাকার নিকেতনে আমি আর শান্তিনিকেতনে বগা তালেব ছিল। রেকর্ডিং হয় গানটি। এটাও ঠিক, গানটিতে এক্সপেরিমেন্ট করেছি। একটা ফিউশন করছি। কারণ, সময় এখন ২০২২ সাল। তরুণদেরও শোনাতে হবে গানটি। তবে ট্র্যাকটা এমনভাবে বানিয়েছি, সব বয়সীরা শুনে যেন একটা সুন্দর অনুভূতি হয়। গ্রামীণ মনে হলেও গানটিতে শহুরে ব্যাপারও আছে। ইচ্ছা করেই এমনটা করেছি।’

‘আটটা বাজে দেরি করিস না’ গানটি যে শ্রোতারা পছন্দ করা শুরু করেছে, তা ইউটিউবে মন্তব্যের ঘরে ঢুঁ মারলেই বোঝা যায়। কেউ কেউ গানটি নিজেদের ফেসবুক ওয়ালে শেয়ার করেও অনুভূতি ব্যক্ত করছেন।

আবু সাইয়িদ নামের একজন লিখেছেন, ‘বারবার গানটা শুনছি, অনেক সুন্দর গান।’ খন্দকার তালহা নামের একজন আবার ‘আটটা বাজে দেরি করিস না’ গানটি তাঁর কাছে ‘সাদা সাদা কালা কালা’ গানের চেয়ে ভালো লেগেছে বলেও মন্তব্য করেছেন। আলামিন নামের একজন লিখেছেন, ‘আহা কি মজার সুর গো, প্রাণটা জুড়িয়ে গেল।’

‘হাওয়া’ চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্য
ছবি : সংগৃহীত

মান্নাফ আহমেদ লিখেছেন, ‘হাওয়া ছবির গানগুলো শুনে বুঝতে পারছি যে আমাদের সংস্কৃতির ভান্ডারেও কিছু সম্পদ আছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে আমরা এই সম্পদগুলোকে (গানগুলোকে) ভালোভাবে উপস্থাপন করতে পারি না।’ অমৃতা ইসলাম লিখেছেন, ‘গানটা শোনার পর থেকে মাথায় সুরটা ঘুরছে, মন উদাস করা সেই সঙ্গে মায়ায় আচ্ছন্ন করা সুর। খুব ভালো লাগল। ব্যতিক্রমী একটি গান আর জেলেজীবনের ছবি।’

আসাদ রিপন লিখেছেন, ‘কী বলব, ছবিটা এক সপ্তাহ আগে দেখেছি, কিন্তু সাদা কালা গানটার থেকেও এই গানটা কেন জানি মনে ধরে গেছে বেশি, ইমোশনাল একটা টাচ আছে। এই গান কোত্থেকে কীভাবে ইমোশনাল করে ফেলে জানি না।’

২৯ জুলাই মুক্তি পেয়েছে মেজবাউর রহমান সুমন পরিচালিত ‘হাওয়া’ ছবিটি। সান মিউজিক অ্যান্ড মোশন পিকচার্স লিমিটেড প্রযোজিত ছবিটি এখন দেশের ৪৬টি প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শিত হচ্ছে। এই ছবিতে অভিনয় করেছেন চঞ্চল চৌধুরী, নাজিফা তুষি, শরীফুল রাজ, সোহেল মণ্ডল, সুমন আনোয়ার, নাসির উদ্দিন খান, এরফান মৃধা শিবলু, রিজভী রিজু, মাহমুদ হাসান, বাবলু বোস প্রমুখ।