গাজার পক্ষে সরব ব্যান্ডটি যেভাবে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের চক্ষুশূলে পরিণত হলো
বেলফাস্টের বিভক্ত ইতিহাস, শোষণ আর সংগ্রামের মাটি থেকে উঠে এসেছেন তিন তরুণ—মো চারা, মোগলাই ব্যাপ আর ডিজে প্রোভাই। একসঙ্গে মিলে গড়ে তুলেছেন আইরিশ হিপহপ ব্যান্ড নিক্যাপ। তাঁদের গান র্যাপ বিনোদন নয়, ইতিহাসের বিরুদ্ধে ছুড়ে দেওয়া প্রতিবাদ। গাজার আগ্রাসনের বিরুদ্ধেও শুরু থেকেই স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছেন তাঁরা। এই প্রতিবাদই তাঁদের যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র সরকারের রোষানলে ফেলেছে। যুক্তরাজ্য সরকার তাঁদের একটি শিল্প অনুদান বাতিল করে। শুধু তা–ই নয়, ব্যান্ডের এক সদস্যের বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় সন্ত্রাসবাদের মামলা। যুক্তরাষ্ট্রেও পারফরম্যান্সের সময় ইসরায়েলের নিপীড়নের বিরুদ্ধে কথা বলায় তাঁদের ভিসা বাতিলের হুমকি আসে। কিন্তু নিক্যাপ এসব পাত্তা না দিয়ে তাদের প্রতিবাদ জারি রেখেছে।
ব্যান্ডটি সম্প্রতি আবার আলোচনায় এসেছে বিশ্বের অন্যতম বড় পারফর্মিং আর্টস উৎসব ‘গ্লাস্টনবারি’কে কেন্দ্র করে। উৎসবে তাদের অংশগ্রহণের বিরোধিতা করেন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার। নিক্যাপ উৎসবে অংশগ্রহণের ‘উপযুক্ত নয়’ বলে মন্তব্য করেন তিনি। তিনি ছাড়াও বিরোধীদলীয় নেতা কেমি ব্যাডেনোচসহ আরও কয়েকজন রাজনীতিক ব্যান্ডটিকে অনুষ্ঠান থেকে বাদ দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। তবে আয়োজকেরা তা প্রত্যাখ্যান করেন। উৎসবের সহ-আয়োজক এমিলি ইভিস বিবিসিকে বলেন, ‘দর্শকদের জন্য দারুণ এক উৎসব আয়োজনের চেষ্টা করছি আমরা। এখানে সারা বিশ্বের শিল্পীরা অংশ নেন আর সবাইকে আমরা স্বাগত জানাই।’ এদিকে স্টারমারের কথার জবাবে ব্যান্ডটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছে, ‘আসলে কী “উপযুক্ত নয়” জানেন কিয়ার? গণহত্যায় অস্ত্র পাঠানো।’
যুক্তরাজ্য সরকারের সঙ্গে নিক্যাপের ঝামেলার সূত্রপাত কিন্তু এখন নয়, ২০২৪ সালে। সেবার তারা ‘ফেয়ারওয়েল টু দ্য ইউনিয়ন’ নামে একটি ট্যুরের আয়োজন করে। কিন্তু সেই ট্যুরের পর যুক্তরাজ্যের সরকার তাদের জন্য বরাদ্দ করা ১৫ হাজার পাউন্ড মূল্যের শিল্প অনুদান বাতিল করে। স্বাধীন বোর্ড সেই অনুদান অনুমোদন করার পরও সরকারের সিদ্ধান্তে তা বাতিল হয়ে যায়। যুক্তরাজ্যের ব্যবসা ও বাণিজ্যসচিব কেমি ব্যাডেনোচের দপ্তর পরে তা আটকে দেয়। এক বিবৃতিতে ব্যাডেনোচের মুখপাত্র বলেন, ‘আমরা এমন শিল্পীদের হাতে ব্রিটিশ করদাতাদের অর্থ তুলে দিতে চাই না, যাঁরা যুক্তরাজ্যের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করেন।’ তবে ব্যান্ডটি হাল ছাড়েনি, তারা আদালতে যায়। আদালত সরকারের সিদ্ধান্তকে অবৈধ ঘোষণা করে। এটি ছিল শিল্পের স্বাধীনতার এক বড় জয়।
বিতর্ক এখানেই থেমে থাকেনি। ২০২৪ সালে লন্ডনে এক কনসার্টে, নিক্যাপের সদস্য লিয়াম ওগ ও’হান্নাই, যিনি মঞ্চে মো চারা নামে পরিচিত, হিজবুল্লাহর পতাকা প্রদর্শন করেন। এ ঘটনায় তাঁর বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা হয়। গত সপ্তাহে তাঁর জামিন দেন ওয়েস্টমিনস্টার ম্যাজিস্ট্রেট আদালত, মামলার শুনানি ধার্য করা হয় ২০ আগস্টে। নিক্যাপ আগেই জানিয়েছিল, তারা এই অভিযোগকে ‘মিথ্যা ও ভিত্তিহীন’ মনে করে, তারা আদালতে জোরালোভাবে তা মোকাবিলা করবে।
১৮ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় গাজায় ইসরায়েলের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বার্তা দিয়ে বিতর্কে জড়ায় নিক্যাপ। এ ঘটনার পর মার্কিন টিভি তারকা শ্যারন অসবর্ন ক্ষোভ প্রকাশ করেন। আমেরিকাস গট ট্যালেন্টের এই বিচারক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লেখেন, ‘এই ব্যান্ড পারফরম্যান্সে রাজনৈতিক আগ্রাসী বক্তব্য ব্যবহার করেছে।’ তিনি দাবি করেন, ব্যান্ডটি ‘সন্ত্রাসী সংগঠনের প্রতি প্রকাশ্যে সমর্থন’ জানাচ্ছে এবং তাদের ভিসা বাতিল করা উচিত। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট জানিয়েছে, বিশেষ কেস নিয়ে তারা সাধারণত মন্তব্য করে না। তবে ভিসা বাতিলের ক্ষেত্রে তারা ‘জাতীয় নিরাপত্তা, জননিরাপত্তা ও ভিসার শর্ত লঙ্ঘনের’ মতো বিষয় বিবেচনা করে।
নিক্যাপকে নিয়ে নির্মিত একটি সিনেমাও বিশ্বমঞ্চে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। সিনেমাটির নাম নিক্যাপ, ছবিটির পটভূমি ২০১৯ সালের পশ্চিম বেলফাস্ট, যেখানে ভাষা অধিকারের আন্দোলনের মাঝখানে গড়ে ওঠে ব্যান্ডটি। পরিচালক রিচ পেপিয়াট একসময় ট্যাবলয়েড সাংবাদিক ছিলেন। তিনি ২০১৯ সালে এক পারফরম্যান্সে নিক্যাপ দেখে এতটাই মুগ্ধ হন যে ছবি বানানোর প্রস্তাব দেন। কিন্তু ব্যান্ড প্রথমে তাঁকে পাত্তাই দেয়নি। তিন ব্যান্ড সদস্য ছাড়াও সিনেমায় অভিনয় করেছেন অস্কার মনোনীত অভিনেতা মাইকেল ফাসবেন্ডার। ছবিটি যুক্তরাষ্ট্রের সানড্যান্স চলচ্চিত্র উৎসবে প্রথমবারের মতো প্রদর্শিত হয়।
তথ্যসূত্র: বিবিসি, ভ্যারাইটি