উদীচীর জাতীয় গণসংগীত প্রতিযোগিতায় বিজয়ী যাঁরা

বাংলা একাডেমির নজরুল মঞ্চে গণসংগীত উৎসবের উদ্বোধনী দিনের দলীয় পরিবেশনাছবি: উদীচীর সৌজন্যে

কণ্ঠ ছেড়ে গান গেয়ে, কণ্ঠরোধের সব কালাকানুন ভেঙে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়ে শুরু হলো বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী আয়োজিত দ্বাদশ সত্যেন সেন গণসংগীত উৎসব ও জাতীয় গণসংগীত প্রতিযোগিতা। শুক্রবার সকাল ১০টায় শুরু হয় জাতীয় পর্যায়ের গণসংগীত প্রতিযোগিতা। জেলা পর্যায় শেষে বিভাগীয় পর্যায়ে প্রতিযোগিতা করে বিজয়ী হয়ে সারা দেশ থেকে আসা প্রায় ৩০০ শিল্পী দিনভর প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন। তিনটি একক ও একটি দলীয়—মোট চারটি বিভাগে বিভক্ত হয়ে প্রতিযোগীরা এ প্রতিযোগিতায় অংশ নেন।
বিকেল সাড়ে পাঁচটায় বাংলা একাডেমির নজরুল মঞ্চে উৎসবের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কণ্ঠসৈনিক, বীর মুক্তিযোদ্ধা রথীন্দ্রনাথ রায়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের শুরুতেই জাতীয় সংগীতের সঙ্গে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন রথীন্দ্রনাথ রায়। সংগঠনের পতাকা উত্তোলন করেন উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি অধ্যাপক বদিউর রহমান। এ সময় জাতীয় সংগীত ও সংগঠন সংগীত পরিবেশন করেন উদীচীর শিল্পীরা। এরপর রথীন্দ্রনাথ রায় উৎসবের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকঢোলের বাদনে নৃত্যের তালে তালে উল্লাসে মাতেন সারা দেশ থেকে আসা উদীচীর শিল্পী-কর্মীসহ সাধারণ মানুষ। সন্ধ্যা পৌনে ছয়টার দিকে মঞ্চে আসন গ্রহণ করেন উদ্বোধক ও আমন্ত্রিত অতিথিরা। তাঁদের ফুল দিয়ে অভ্যর্থনা জানান উদীচী কেন্দ্রীয় সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যরা। ফুল, উপহার ও উত্তরীয় পরিয়ে বরণ করে নেন উদীচীর শিল্পী-কর্মীরা।

উদীচীর সহসভাপতি এবং দ্বাদশ সত্যেন সেন গণসংগীত উৎসব ও জাতীয় গণসংগীত প্রতিযোগিতা প্রস্তুতি পরিষদের আহ্বায়ক মাহমুদ সেলিমের স্বাগত বক্তব্যের মধ্য দিয়ে শুরু হয় উদ্বোধনী আলোচনা পর্ব। উদীচীর সভাপতি অধ্যাপক বদিউর রহমানের সভাপতিত্বে এ পর্বে আরও বক্তব্য দেন উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সাধারণ সম্পাদক অমিত রঞ্জন দে; শিক্ষক, গবেষক ও প্রাবন্ধিক সায়েম রানা এবং উৎসবের উদ্বোধক রথীন্দ্রনাথ রায়।

বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর আয়োজনে শুক্রবার শুরু হয়েছে দ্বাদশ সত্যেন সেন গণসংগীত উৎসব ও জাতীয় গণসংগীত প্রতিযোগিতা
ছবি: উদীচীর সৌজন্যে

স্বাগত বক্তব্যে মাহমুদ সেলিম বলেন, গণসংগীতের প্রচার, প্রসার এবং সংগীতের একটি স্বতন্ত্র ধারা হিসেবে গণসংগীতকে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে ২০০৯ সাল থেকে প্রতিবছর উদীচীর প্রতিষ্ঠাতা শিল্পী সংগ্রামী সত্যেন সেনের জন্মদিন ২৮ মার্চকে কেন্দ্র করে সত্যেন সেন গণসংগীত উৎসব ও জাতীয় গণসংগীত প্রতিযোগিতা আয়োজন করছে উদীচী। সব জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে গণসংগীত প্রতিযোগিতার বিজয়ীরা জাতীয় গণসংগীত প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন। তিনটি একক ও একটি দলীয়—মোট চারটি বিভাগে বিভক্ত হয়ে প্রতিযোগীরা এ প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। এবার ৫০টি জেলা ও ৮টি বিভাগে প্রতিযোগিতায় বিজয়ী ৮০ জন একক শিল্পী এবং ১৭টি দল মিলিয়ে প্রায় ৩০০ শিল্পী জাতীয় পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছেন। উদীচী মনে করে, সবার যূথবদ্ধ প্রয়াসে গণসংগীতের যেমন প্রসার ঘটবে, শিল্পীরা উদ্বুদ্ধ হবেন এই গান গাইতে, তেমনি গণমানুষের শোষণ–বঞ্চনা, পাওয়া না–পাওয়া, সুখ–দুঃখ সুরের ললিত বাণী হয়ে ব্যাপ্ত হবে চারদিকে।

উদীচীর সাধারণ সম্পাদক অমিত রঞ্জন দে বলেন, রাজনৈতিক অঙ্গীকারসম্পন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন হিসেবে দেশ-বিদেশে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী। ১৯৬৮ সালের ২৯ অক্টোবর প্রতিষ্ঠার পর থেকেই গান-নাচ-নাটক-কবিতা-চলচ্চিত্রের মতো সৃজনশীল মাধ্যমকে হাতিয়ার করে সমাজের নানা অসংগতি, শোষণ-বঞ্চনা-অত্যাচার-নির্যাতন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা পালন করে চলেছে উদীচী।

শুক্রবার বিকেলে উৎসব উদ্বোধন করেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কণ্ঠসৈনিক রথীন্দ্রনাথ রায়।
ছবি: উদীচীর সৌজন্যে

প্রাথমিক অবস্থায় একটি গানের দল হিসেবে যাত্রা শুরু করা উদীচী চারণ শিল্পীদের মতো কণ্ঠে গণসংগীত নিয়ে মানুষের মুক্তির জন্য ন্যায় ও অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সুরের মাধুর্যে অসুর নিধনের ব্রত নিয়ে এগিয়ে চলেছে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে ভাষা আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রাম, গণজাগরণ মঞ্চ আন্দোলনসহ সাধারণ জনগণের যেকোনো অধিকার আদায়ের সংগ্রামে অন্যতম অনুপ্রেরণা রেখেছে গণসংগীত।

আলোচনা পর্ব শেষে উদীচীর গণসংগীতের স্বরলিপির বই ‘দ্রোহের গান’-এর মোড়ক উন্মোচন করেন অতিথিরা। উদীচীর কেন্দ্রীয় প্রকাশনা বিভাগের উদ্যোগে প্রকাশিত বইটিতে স্থান পেয়েছে কাজী নজরুল ইসলাম, সত্যেন সেন, মাহমুদ সেলিম, প্রবীর সরদারসহ বিভিন্নজনের লেখা ও সুর করা ২২টি উল্লেখযোগ্য গণসংগীত। এসব গানের স্বরলিপি তৈরি করেছেন মাহমুদ সেলিম ও পূর্ণচন্দ্র মণ্ডল।

এরপর ঘোষণা করা হয় জাতীয় পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের নাম। এবারের প্রতিযোগিতায় ‘ক’ বিভাগে প্রথম হয়েছেন শ্রেয়া রায়, দ্বিতীয় হয়েছেন তীর্থ বিশ্বাস এবং যৌথভাবে তৃতীয় হয়েছেন রাহুল দেবনাথ ও সায়রা খান শুকরিয়া। ‘খ’ বিভাগে দেশসেরা হয়েছেন তনুশ্রী পাল, দ্বিতীয় হয়েছেন অনুশ্রী শর্মা এবং তৃতীয় হয়েছেন রাহমিম ইয়াসরীব সামিন। ‘গ’ বিভাগে চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন ইমন দাস, দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেছেন জ্যোতিষ চন্দ্র বর্মণ এবং তৃতীয় হয়েছেন অলি উল্লাহ। এ ছাড়া দলীয়, অর্থাৎ ‘ঘ’ বিভাগে দেশসেরা হয়েছে উদীচী নোয়াখালী জেলা সংসদ, দ্বিতীয় উদীচী বগুড়া জেলা সংসদ এবং তৃতীয় স্থান পেয়েছে খুলনার সৃজনী সংগীত একাডেমি। প্রতিযোগিতায় বিচারকের ভূমিকা পালন করেন গীতিকার ও সুরকার সেলিম রেজা; প্রখ্যাত গণসংগীতশিল্পী সোহানা আহমেদ এবং গীতিকার ও সুরকার তানভীর আলম সজীব। এ পর্ব সঞ্চালনা করেন উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সহসাধারণ সম্পাদক এবং দ্বাদশ সত্যেন সেন গণসংগীত উৎসব ও জাতীয় গণসংগীত প্রতিযোগিতা প্রস্তুতি পরিষদের সদস্যসচিব সঙ্গীতা ইমাম।

বাংলা একাডেমির নজরুল মঞ্চে গণসংগীত উৎসবের উদ্বোধনী দিনের দলীয় পরিবেশনা
ছবি: উদীচীর সৌজন্যে

এরপরই শুরু হয় সাংস্কৃতিক পরিবেশনা পর্ব। এ পর্বে ছিল একক ও দলীয় পরিবেশনা। সারা দেশ থেকে আসা শিল্পীরা অংশ নেন এ পর্বে। শনিবার বিকেল চারটায় উৎসবের দ্বিতীয় দিনের অনুষ্ঠানমালা আয়োজিত হবে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে। এদিন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের মধ্য দিয়ে শুরু হবে কার্যক্রম।