‘আমাকে ক্যান এই পারের লোকদের সাথে রাখছ’

দেবব্রত বিশ্বাসের জন্মদিন আজ। ছবি : ফেসবুক থেকে

জন্মভূমি ছেড়েছিলেন। কলকাতার রাসবিহারী অ্যাভিনিউর বাড়িতে থাকতেন বটে, মনের মধ্যে ছিল কিশোরগঞ্জ। পশ্চিমবঙ্গে বাস করেও তাই জন্মভূমি ত্যাগ করেননি, তেমনি মাতৃভাষাকেও কখনো ভুলে যাননি। তাই ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতায় যখন দুই বাংলার শিল্পীরা বাংলাদেশের পক্ষে গান গাওয়ার জন্য যখন এক হন, দেবব্রত বিশ্বাস ওরফে জর্জ বিশ্বাস অথবা সবার প্রিয় জর্জদা সেখানে সবার আগে ছুটে যান। পশ্চিমবঙ্গের শিল্পীদের সঙ্গে নয়, জোর করে ঢুকে যান বাংলাদেশের শিল্পীদের দলে। আজ ২২ আগস্ট শিল্পী দেবব্রত বিশ্বাসের জন্মদিন। ১৯১১ সালের এই দিনে অবিভক্ত বাংলা (বর্তমানে বাংলাদেশ) কিশোরগঞ্জে জন্ম হয় এই সংগীতশিল্পীর। জন্মদিন উপলক্ষে দেবব্রত বিশ্বাসের বাংলাদেশ-যোগ ও অন্যান্য প্রসঙ্গে আলো ফেলা যাক।

দেবব্রত বিশ্বাস বুঝেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের পাশে সাধারণ মানুষকে দাঁড় করাতে হবে, গানের শক্তি দিয়েই গড়ে তুলতে হবে জনমত। তাই তিনি নিজের উদ্যোগে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় ছেলে দ্বিজেন্দ্রনাথের পৌত্র সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে চিঠি লিখে অনুরোধ জানান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে দুটি গান লিখে পাঠাতে।

রূপান্তরের গান
১৯৭১ সালের ১ জুলাই। কলকাতার দৈনিক কালান্তর-এ প্রকাশিত হলো এক অভিনব অনুষ্ঠানসূচির বিজ্ঞাপন। লেখা ছিল, ‘দেশভাগের পর সীমান্ত পারের শিল্পীদের এমন প্রতিনিধিত্বমূলক মিলনমেলা এই প্রথমবার ঘটতে চলেছে কলকাতায়। সদ্য ঘোষিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের শিল্পীরা একত্রে মঞ্চে উঠবেন আর ২৫ মার্চের রক্তাক্ত ইতিহাস পেরিয়ে বিশ্ববাসীকে শোনাবেন তাঁদের প্রথম সম্মিলিত সংগীত।’
তখন মুক্তিযুদ্ধ চলছে পুরোদমে। যুদ্ধ শুরুর পর শিল্পীদের অনেকেই দেশ ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নিয়েছেন। কলকাতার যেসব শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের পক্ষে ছিলেন, তাঁরা বাংলাদেশের শিল্পীদের সাহায্য করতে গঠন করেন ‘বাংলাদেশ সহায়ক শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী সমিতি’, সংক্ষেপে বুদ্ধিজীবী সমিতি। এই সমিতির উদ্যোগে কলকাতায় আয়োজন করা হয় বাংলাদেশ ও ভারতের শিল্পীদের যুগ্ম সংগীতানুষ্ঠান। অনুষ্ঠানটি হয় ১৯৭১ সালের ৩ ও ৪ জুলাই, রবীন্দ্রসদনে। পরিচালনায় ছিলেন সন্‌জীদা খাতুন। প্রথম দিনের আসর ঠিক হয়েছিল বাংলাদেশি শিল্পীদের জন্য, দ্বিতীয় দিন পশ্চিমবঙ্গের শিল্পীদের। পরিকল্পনামতোই এগোচ্ছিল আয়োজন—কিন্তু বাদ সাধলেন দেবব্রত বিশ্বাস।

তাঁর গাওয়ার কথা ছিল কলকাতার শিল্পীদের সঙ্গে, দ্বিতীয় দিন। কিন্তু তিনি বলে ওঠেন, ‘আমি তো বাংলাদেশের (কিশোরগঞ্জের) লোক। আমাকে ক্যান এই পারের লোকদের সাথে রাখছ?’ তিনি গোঁ ধরে বসে থাকেন। শেষ পর্যন্ত আয়োজকদের নতি স্বীকার করতেই হয়। দেবব্রত বিশ্বাস গান গাইলেন প্রথম দিনই, বাংলাদেশের শিল্পীদের সঙ্গে।
সেই দিন মঞ্চে পরিবেশিত হয়েছিল বাংলাদেশের শিল্পীদের সম্মিলিত পরিবেশনা ‘রূপান্তরের গান’। তাঁদের পরিবেশনার ফাঁকে দেবব্রত বিশ্বাস এককভাবে গান করেন তিনটি রবীন্দ্রসংগীত। পরের দিন ৪ জুলাই, মঞ্চে ওঠেন পশ্চিমবঙ্গের শিল্পীরা—শান্তিদেব ঘোষ, সুচিত্রা মিত্র, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, নীলিমা সেন, সাগর সেনসহ অনেকে। আবৃত্তি করেন শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্র, অপর্ণা সেন প্রমুখ।

মুক্তিযুদ্ধে ব্যক্তিগত উদ্যোগ
দেবব্রত বিশ্বাস বুঝেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের পাশে সাধারণ মানুষকে দাঁড় করাতে হবে, গানের শক্তি দিয়েই গড়ে তুলতে হবে জনমত। তাই তিনি নিজের উদ্যোগে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় ছেলে দ্বিজেন্দ্রনাথের পৌত্র সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে চিঠি লিখে অনুরোধ জানান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে দুটি গান লিখে পাঠাতে। তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘ব্রাত্যজনের রুদ্ধসংগীত’-এ দেবব্রত লিখেছেন, ‘আমার জন্মভূমি পূর্ববঙ্গের অর্থাৎ বাংলাদেশের আমার ভাই-বোনেরা জীবন-মরণ পণে যে মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন, সেই লড়াইকে তিনি (সৌমেন্দ্রনাথ) সমর্থন করেন কি না জানতে চাইলাম। যদি সেই লড়াইয়ের প্রতি তাঁর সামান্য একটু সমর্থন থাকে, তাহলে ওদের মুক্তিযুদ্ধ সম্বন্ধে দুটি গান আমায় লিখে পাঠাতে অনুরোধ জানালাম, যাতে সেই গান দুটির রেকর্ড প্রকাশ করে এবং নানা অনুষ্ঠানে গেয়ে এপার বাংলার জনসাধারণকে বাংলাদেশের আমার ভাইবোনদের স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রতি একটু সহানুভূতিশীল করে তুলতে পারি।’

দেবব্রত বিশ্বাস। ফেসবুক থেকে

দেবব্রতের আন্তরিক অনুরোধে সাড়া দেন সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর। কয়েক দিন পরে তিনি গান দুটি লিখে স্বরলিপিসহ পাঠিয়ে দেন দেবব্রতের কাছে। গান দুটি ছিল ‘ওই তারা চলে দলে দলে মুক্তি পতাকাতলে’ ও ‘শোনো বাংলার জনসমুদ্রে জোয়ারের হুংকার’। এর আগেই দেবব্রত ব্যবস্থা করেন গান দুটি হিন্দুস্তান রেকর্ডস থেকে প্রকাশের। রেকর্ড বিক্রি যাতে ভালো হয়, সে জন্য নিজেই রেকর্ড কোম্পানির সঙ্গে দরাদরি করেছিলেন তিনি।

‘খারিজ’ করে দেওয়া এক গায়ক
দেবব্রত বিশ্বাসের দুর্ভাগ্য, যখন তাঁর গলা দুর্দান্ত, যখন তাঁর গানে ভরা জোয়ার, তখন তাঁর রেকর্ড কদাচিৎ বিক্রি হতো। গানের অনুষ্ঠানে ডাকা হতো কদাচিৎ। বিশ্বভারতী তাঁর গানের রেকর্ড প্রকাশে আপত্তি করেছিল। শুধু তা–ই নয়, তেমন বিক্রি নেই বলে ‘হিজ মাস্টাস ভয়েস’ (এইচএমভি) কোম্পানি তাদের কলাম্বিয়া লেবেল থেকে তাঁর নাম খারিজ পর্যন্ত করে দিয়েছিল!
আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন, ‘এই গানগুলোর রেকর্ড প্রকাশিত হওয়ার পর এইচএমভি কোম্পানির একজন পদস্থ অফিসার আমাকে আধুনিক গান রেকর্ড করবার নির্দেশ দিলেন। কারণ হিসাবে উনি জানালেন যে রবীন্দ্রসংগীত আশানুরূপভাবে বাজারে চলছে না। আমি তাঁর প্রস্তাবে রাজি হতে পারলাম না। তাই কোম্পানিতে রেকর্ড করা বন্ধ করতে হলো।’

‘মেঘে ঢাকা তারা’ সিনেমার দৃশ্য। আইএমডিবি

আর দেবব্রত বিশ্বাসের সৌভাগ্য যে যখন হাঁপানির টানে গলা পড়ন্ত, যখন দমের ঠিক নেই, তখন তাঁর জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। রেকর্ড বিক্রি অন্তহীন। তাঁকে মঞ্চে দেখামাত্র শ্রোতারা উল্লাসে ফেটে পড়ত। তবে দেবব্রত বিশ্বাসের প্রতি অবহেলা এবং এই সমাদর বাঙালির ‘আজব সমঝদারির অন্যতম নমুনা’ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। তাঁর মতো এমন গলা, এমন ভঙ্গি আজও বিরল বাংলা গানে। এটা আজ স্বীকৃত যে তাঁর গাওয়া রবীন্দ্রসংগীত যেকোনো সময়ে যেকোনো মানুষকে আকৃষ্ট করে। সে যদি আগে কোনো দিন রবীন্দ্রসংগীত না–ও শুনত, সে–ও ভক্ত হয়ে উঠত রবীন্দ্রনাথের গানের।
তা সে মানুষ যদি কখনো সে গান আগে না-ও শুনে থাকেন। এতটাই হৃদয় স্পর্শ করা মাদকতা তাঁর গানে। এতটা মরমে সঞ্চারিত শব্দের অনুরণন অন্য কোনো শিল্পীর কাছে আজ অবধি রবীন্দ্রসংগীতের শ্রোতারা পাননি। তাঁর বিরোধীরা এমন মন্তব্যও করেছেন, দেবব্রত বিশ্বাস স্বরলিপি বিচ্যুত হয়েছেন, বেশ কিছু গানে। কিন্তু হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বলেছেন, এই বিচ্যুতিতে তিনি তাঁর গুরুদেবের (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের) প্রতি কিছুমাত্র অবজ্ঞা প্রকাশ করেছেন, এমন নয়।

ব্যাকরণের সীমানা পেরোনো দুই শিল্পী
গান নিয়ে সত্যজিৎ রায় ও ঋত্বিক ঘটকের দর্শন ছিল বিপরীত। সত্যজিতের মত ছিল, ধ্রুপদি সংগীতজ্ঞদের সিনেমার সঙ্গে যুক্ত করলে তাঁরা গানকে সিনেমার চেয়ে বেশি প্রাধান্য দিয়ে দেন। ফলে সিনেমার সঙ্গে মানানসইভাবে যে গানকে ব্যবহার করতে হয়, তা তাঁরা সব সময় মানতে চান না। তাই পরবর্তীকালে সত্যজিৎ রায় তাঁর সিনেমায় গানে নিজেই সুর করা শুরু করেন।
অন্যদিকে ঋত্বিক ঘটক ভারতীয় ধ্রুপদি সংগীতকে পরিবর্তন না করে সিনেমার সঙ্গে সেটা কীভাবে এক করা যায়, সেই চেষ্টা করেছেন। যেমন ‘মেঘে ঢাকা তারা’ সিনেমায় তিনি বেছে নেন রাগ হংসধ্বনি। তাঁর আলাপ বিলম্বিত, বিস্তার, লয়—সবকিছুই আখ্যানের আনুপাতিক। ‘মেঘে ঢাকা তারা’ ছবিতে ‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলি’ গানে যে জর্জ বিশ্বাস, তিনি যেন ছবিরই চরিত্র। কান্নার মতো একটা গান। হারমোনিয়াম ধরে রেখেছে সেই কান্নাকে, একেবারে শেষে সরোদের আচমকা অনুপ্রবেশের সময়টুকু ছাড়া।

‘মেঘে ঢাকা তারা’ সিনেমার দৃশ্য। আইএমডিবি

ঋত্বিক এক আড্ডায় বলেছিলেন, ‘জর্জদা (দেবব্রত) শব্দকে দেখতে পান। রবীন্দ্রসংগীত ওঁকে বাদ দিয়ে…অ্যাবসার্ড!’ পশ্চিমবঙ্গের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক, চলচ্চিত্র–গবেষক সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় মনে করেন, এই নিবেদনই অনুজপ্রতিম ঋত্বিককে নিয়ে গিয়েছিল দেবব্রত বিশ্বাসের দরজায়। ‘তাঁদের দুজনের যা মিল, শ্রদ্ধা ও স্নেহ, তার উৎস হয়তো বামপন্থা, কিন্তু দুজনেই দেখা যাবে নিজ বাসভূমে পরবাসী, প্রত্যাখ্যাত। আর দুজনেই পার হয়ে যাবেন ব্যাকরণের সীমানা। ফলে ঋত্বিক যেমন ক্যামেরায় খুব সচেতনভাবে কিছু চ্যুতিকে প্রশ্রয় দেন, শাস্ত্রসম্মত ব্যাকরণ মানেন না, দেবব্রত বিশ্বাসের গানেও কিছু পথচ্যুতি আছে এবং সেই চ্যুতিটির জন্যই এই দুজনের মধ্যে এক সহজ সমীকরণ তৈরি হয়।’ মনে করেন তিনি।

নিজের বিশ্বাসে বরাবরই অটল ছিলেন দেবব্রত। গোঁ ধরে থাকার রোগ অনেক পুরোনো। তখন ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’ করছেন ঋত্বিক। পরিচিত মহলে বলছেন, ‘ছবিতে একটা রবীন্দ্রসংগীত থাকবে। এবং জর্জদাই গাইবেন।’ ঘনিষ্ঠরা জিজ্ঞেস করেন, ‘কোন গান ঋত্বিকদা?’ ঋত্বিক তো নিজেই জানেন না, উত্তর দেবেন কী! রেকর্ডিংয়ের দিন টেকনিশিয়ান স্টুডিওর স্কোরিং থিয়েটারে জর্জ এলেন। মোটা খদ্দরের পাঞ্জাবি। সাদা পাজামা। কাঁধে ঝোলা, মুখে পান। ফ্লোরে ঢুকেই ঋত্বিকের পিঠ চাপড়ে বললেন, ‘দ্যাখ ভবা, আমরা ঠিক আইস্যা পড়ছি।’

ঋত্বিক বললেন, ‘সবকিছু রেডি আছে জর্জদা। একবার শোনালেই, ফাইনাল টেক হবে।’ বিধি বাম। হঠাৎ জর্জ বললেন, ‘আমি তো বাবা তোরে আগেই কইসি, গলা খারাপ। আমি গামু না!’ সেকি! কে গাইবে এ গান? এ গান, ছবির যে সিচুয়েশন, আপনি না গাইলে হবে না! প্লিজ জর্জদা, প্লিজ এটা করবেন না।’ জর্জ তবু অনড়। মেঝের দিকে মাথা নিচু করে তাকিয়ে তাঁর নির্লিপ্ত ভঙ্গি। সেদিন স্টুডিওতে ছিলেন তুষার তালুকদার। পরে যিনি পুলিশ কমিশনার হন। ‘উন্মুক্ত ব্রাত্যজন’ তথ্যচিত্রে তাঁর সে দিনের স্মৃতি, ‘ঋত্বিকদা কারও কাছে কাকুতি মিনতি করার লোক নন। বরং ওনার মর্জিমতো ব্যাপারটা না ঘটলে, ভীষণ রেগে গিয়ে এমনভাবে রিঅ্যাক্ট করতেন, সেটা না বলা ভালো। কিন্তু এই ব্যতিক্রম দেখলাম জর্জদার ক্ষেত্রে এবং সেটা জর্জদার ক্ষেত্রেই সম্ভব। আলটিমেটলি একটা সমঝোতা হলো যে গানটা শুরু করবেন জর্জদা। ফলো করবেন সুশীল।’ রেকর্ডিং হলো। জর্জ গাইলেন। সঙ্গে তাঁর ছাত্র সুশীল মল্লিক। রবীন্দ্রনাথের ২৫ বছর বয়সে লেখা গান। কাফি রাগে। ‘কেন চেয়ে আছো গো মা’। ছবিতে অভিমানী জর্জের গায়ন আর এলোমেলো যাপনের ঋত্বিকের ক্লোজআপ ফ্রেম মিলেমিশে হলো একাকার।

১৭৪-ই রাসবিহারী অ্যাভিনিউ
কলকাতায় এই ঠিকানার ঘরটিই ছিল জর্জ বিশ্বাসের সাম্রাজ্য। ভেজানো কাঠের দরজা। ওপারে ছোট্ট গলি। গেট খুলে বারান্দা। ঘরের ভেতর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছোপ ধরা পিকদান। অগোছালো বিছানায় ডাঁই করে রাখা গানের খাতা। ক্যাসেট, হট ব্যাগ, মারফি রেডিও। ছোট্ট টিভি। ইনহেলার। কাঠের সেলফ। সেই সেলফে স্বরবিতান। কাউকে হাত দিতে দিতেন না। সব হাতের কাছে রাখতেন। তারপর যখন অসুস্থ হলেন, ডাক্তারের কথায় ঘরের ভেতরে জানালার জাল কেটে ফেলা হলো। সারাক্ষণ ইজিচেয়ারে। সেখানেই ঘুমাতেন। ঘুম? শ্বাসকষ্টের জন্য ঘুমাননি কত কাল! সামনেই টুলের ওপর রাখা হারমোনিয়ম। একচিলতে এই ঘরের ইজিচেয়ারে শুয়ে, অভিমানী বাউল জর্জ কেবলই স্মৃতির অতলে হারিয়ে যান। দিন দিন শ্বাসের টান যেন বাড়ছে। রাতভর জেগে কাটে জর্জের। ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে মাথার নিচে হাত দুটো রাখলে ইদানীং একটু আরাম হয়। কেউ গেলে, মোড়া দেখিয়ে বসতে বলেন। কথা বলেন খুব আস্তে। চলে যাওয়ার কথা। এই অবেলায় পৌঁছে, তাঁর উদাস মন উড়ে যায় কাঁটাতারের ও পারে কিশোরগঞ্জে, কলকাতার প্রথম জীবনে।

আরও পড়ুন

১৯৮০ সালের ১৮ আগস্ট চলে যান দেবব্রত বিশ্বাস, সবার প্রিয় জর্জদা। মৃত্যুর আগেও রসিকতা করতে ছাড়েননি। চলে যাওয়ার সাত দিন আগে ভাগনি পারমিতাকে বললেন, ‘‘শোন, আমি আর এক সপ্তাহ আছি। সকালে উঠে দেবদুলালের গলায় রেডিওতে শুনবি, কুখ্যাত গায়ক দেবব্রত বিশ্বাস মারা গেছে!’ তাঁর মৃত্যুর পর মরদেহ নেওয়া হয় রবীন্দ্রসদনে, শহরজুড়ে তখন শোকমিছিল। এই রবীন্দ্রসদনেই কিছুদিন শেষ সংবর্ধনা নিয়েছেন জর্জ। স্মৃতি থেকে যেন তাঁর গান ভেসে আসছে। ফিরে ফিরে গেয়ে চলেছেন জর্জ, ‘আজি পুবের হাওয়ায় হাওয়ায় হায় হায় হায় রে/ কাঁপন ভেসে চলে’।

তথ্যসূত্র: ‘ব্রাত্যজনের রুদ্ধসংগীত : দেবব্রত বিশ্বাস’, ‘ভালোবাসায় বাড়ানো হাত : মতিউর রহমান’, ‘মুক্তিযুদ্ধে সাংস্কৃতিক অবদান : মুনতাসীর মামুন’, আনন্দবাজার পত্রিকা, রোববারডটইন