‘বাংলা লোকগানে এদেশ-ওদেশ বলে কিছু নেই’

লোকগানের দল ‘মাদল’-এর শিল্পীরানাজনীন আখতার

২০০৫, ২০১৬ ও ২০২৪ সাল। দীর্ঘ বিরতিতে পরিবর্তন-পার্থক্য বড় হয়ে চোখে ধরা পড়ে। কলকাতার লোকগানের দল ‘মাদল’-এর শিল্পীরা ওই তিনটি সালে বাংলাদেশে গান পরিবেশন করতে এসে সেই পরিবর্তনগুলো ভালোভাবে অনুভব করেছেন। এ সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে তাঁদের কোনো প্রিয়জন স্মৃতি হয়ে গেছেন, রাস্তার চেহারা বদলেছে, পরিচিত অনুষ্ঠানে রং-বৈচিত্র্য এসেছে ভিন্ন ঢঙে। তবে তাঁদের ভাষায়, যে আকুলতা নিয়ে বাংলাদেশে এসেছেন, সেটার কোনো পরিবর্তন নেই। সেটা হচ্ছে—বাংলা গান। সীমানা পেরিয়ে বাংলা গান গাইতে পারা, দর্শকদের সঙ্গে একাত্ম হতে পারা, তাঁদের সবচেয়ে বড় পাওয়া।

সম্প্রতি বাংলা নববর্ষে গান গাইতে ঋষিজ শিল্পগোষ্ঠীর আমন্ত্রণে ঢাকা এসেছিলেন মাদলের চার শিল্পী শিখা ভট্টাচার্য, শর্মিষ্ঠা চ্যাটার্জি, মালা চক্রবর্তী ও টুপশী চ্যাটার্জি।

লোকগানের দল ‘মাদল’-এর শিল্পীরা
সৌজন্যে

এই গানের দলটি নারীদের নিয়েই তৈরি। ১৫ এপ্রিল সকালে সেগুনবাগিচার একটি হোটেলে তাঁদের কক্ষে বসেই কথা হচ্ছিল প্রথম আলোর প্রতিবেদকের।

আরও পড়ুন

আগের দিন সকালে শিশুপার্কের একটি অংশে এবং সন্ধ্যায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গান গেয়েছেন শিল্পীরা। দর্শকের সাড়া পাওয়া নিয়ে বেশ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বলেন, লোকগান এমন একটা বিষয়, যা মানুষের সঙ্গে দ্রুত সংযোগ স্থাপন করিয়ে দেয়। কলকাতার চেয়ে বাংলাদেশে নববর্ষ উদ্‌যাপন অনেক বেশি গণমানুষের বলে মনে হয়েছে তাঁদের কাছে।

লোকসংগীতের ওপর রবীন্দ্রভারতীতে এমএ করেছেন শিখা ভট্টাচার্য। ২০০৫ সালে ঋষিজ শিল্পগোষ্ঠীর আমন্ত্রণে ঢাকায় বাংলা নববর্ষে গান গাওয়ার প্রথম অভিজ্ঞতা হয় তাঁর। ওই সময় লক্ষ করেন, গান শুনতে আসা নারী-পুরুষ ও শিশু সবার পরনে লাল-সাদা পোশাক। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে সারা দিন ধরে নববর্ষের উদ্‌যাপন চলে। এটা বেশ ভালো লাগে। কলকাতায় শোভাযাত্রা বের হয়। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের মতো এত বর্ণাঢ্য নয়। মন্দিরে পূজা-অর্চনা ও নতুন পোশাক কেনার মধ্যেই কলকাতায় নববর্ষ বরণ হয়।’ তাঁর ভাষায়, চারুকলা অনুষদে ঢুকে তাঁর মনটা একদম ভরে গেছে।

লোকগানের দল ‘মাদল’-এর শিল্পীরা
নাজনীন আখতার

২০১৬ সালের নভেম্বরে ঋষিজ শিল্পগোষ্ঠীর ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষে মাদলের শিল্পীরা যখন ঢাকায় এসেছিলেন, তখন বাউল মনির সরকারের সঙ্গে এক মঞ্চে দেখা হয়েছিল। সেটা নিয়ে শিল্পীদের বাড়তি উচ্ছ্বাস ছিল। এর আগের বছর ‘হাওয়ার ওপর চলে গাড়ি/ লাগে না পেট্রল-ডিজেল/ মানুষ একটা দুই চাকার সাইকেল/...’ ইউটিউবে গানটি শুনে এর মূল গায়ককে খুঁজতে খুঁজতে নানাজনের মাধ্যমে মনির সরকারের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। তাঁর অনুমতি নিয়ে দেহতত্ত্ব গানটি ওই সময় মাদলের গানের অ্যালবাম ‘কিয়াফুল’-এ যুক্ত করা হয়েছিল। বাংলাদেশের সিলেট ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের গানগুলো তাঁরা নিয়মিত পরিবেশন করেন।

লোকগানই মাদলের প্রাণের জায়গা বলে জানান শিল্পী। মালা চক্রবর্তী বলেন, ‘লোকগান হচ্ছে সাধনা ও প্রার্থনা। বাংলা লোকগানের ক্ষেত্রে এ দেশ-ও দেশ বলে কিছু নেই। লোকগানের নিজস্ব একটা দুলুনি আছে। আলাদা করে নাচের প্রয়োজন হয় না।’ তিনি বলেন, ‘শাস্ত্রীয় সংগীত শিখেছি ছোটবেলা থেকে। ৭-৮ বছর আগে লোকগানের রসে আকৃষ্ট হই। লোকগান শেখার পর মনে হয়েছে মানুষই একমাত্র সাধন।’
লোকগানকে ভিত্তি করে মাদলের জন্ম ২০০২ সালে। ‘চিড়া কুডি, চিড়া কুডি/ বইল গাছের তলেতে/ ও দিদি কুডুম আইসাছে বাড়িতে/...’ মেয়েদের জীবনের চালচিত্র উঠে আসা এমন কিছু লোকগানকে উপজীব্য করে গানের জগতে যাত্রা শুরু করে মাদল। বলা হয়, কাজের ক্লান্তি আর একঘেয়েমি দূর করতে এ ধরনের গান ছিল টোটকা। হলুদবাটা, কনে সাজানো বা ভাদ্র মাসের ব্রত মেয়েদের আচার নিয়ে গানগুলো মাদল পরিবেশন করে। ‘চিরন্তনী’, ‘বন্দে জননী’, ‘কিয়াফুল’, ‘সুন্দরী কমলা’, ‘প্রাণ ঝরনা’, ‘হৃদয়ে আছ’, ‘উড়া পঙ্খি’, ‘মায়া লাগাইসে’—মোট আটটি অ্যালবাম প্রকাশ করেছে মাদল।

লোকগানে ফিউশন এখন জনপ্রিয়। বিষয়টিকে নেতিবাচকভাবে দেখেন না মাদলের শিল্পীরা। শর্মিষ্ঠা চ্যাটার্জি বলেন, গানের সুর ও তাল ঠিক রেখে ফিউশন গান করা যেতেই পারে।

চার শিল্পীর সঙ্গেই বাংলাদেশ কোনো না কোনোভাবে সম্পর্কিত। দেশভাগের আগে শিল্পী শিখার বাবার বাড়ি ছিল বরিশাল। শর্মিষ্ঠার তিন কাকা এখনো থাকেন ফরিদপুরে। টুপশীর শ্বশুরবাড়ি বরিশাল। মালার শ্বশুরবাড়ি ফরিদপুর। ফলে বাংলাদেশ নিয়ে তাঁদের বাড়িভর্তি আবেগ। এবার বাংলাদেশে এসে পদ্মা সেতু পাড়ি দিলেন। পদ্মা-বন্দনায় তাঁদের চোখেমুখে নানা অভিব্যক্তি। তাঁরা বারবার বাংলাদেশ আসতে চান। বাংলাদেশের মানুষকে গান শোনাতে চান।