ব্যান্ডের নাম ‘রোমিও ব্রাদার্স’ কেন?
নয়ন: ‘রোমিও ব্রাদার্স’ আমাদের গায়কি, ফিলোসফি (দর্শন) এবং আমাদের উপস্থাপনাকে গভীরভাবে প্রকাশ করে।
অরূপ: ‘রোমিও’ যেমন একটি নাটকের চরিত্র, আমাদের ব্যান্ডও মঞ্চে ঠিক ততটাই পারফরমেটিভ। আমরা শুধু গান গাই না, আমাদের কস্টিউম (পোশাক), স্টেজ ডেকোরেশন (মঞ্চসজ্জা) এবং সামগ্রিক উপস্থাপনায়ও একধরনের রঙিন, রোমান্টিক আবহ তৈরি করার চেষ্টা করি। আর ‘ব্রাদার্স’ আমাদের বন্ধনের প্রতীক—আমরা শুধু একটা ব্যান্ড নই, আমরা একটি পরিবার।
ব্যান্ডটি তৈরি হলো কীভাবে?
নয়ন: শুরুটা একদম হুট করেই। আমি অরূপের কাছে গিটার শিখতাম, একদিন একসঙ্গে গান গেয়ে একটা ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করলাম। ভাবিনি, মানুষ এতটা পছন্দ করবে। এরপর একের পর এক গান আপলোড করতে থাকলাম। দেখলাম, শুধু গান নয়, আমাদের জুটিকেও মানুষ আপন করে নিচ্ছে।
অরূপ: শুরু থেকেই আমরা হয়তো একটু আলাদা ছিলাম। ভিন্ন ভিন্ন গানের ম্যাশআপ করতাম, মায়ের পায়ে আলতা পরাতে পরাতে রবীন্দ্রসংগীত গাইতাম বা ছাদে গান গাইতে গাইতে আমাদের বোন নাচত। এসব শেয়ার করতে করতে সোশ্যাল মিডিয়ার বাইরে আমাদের পরিচিতি ছড়িয়ে পড়ল। প্রয়োজনের তাগিদে একটি ব্যান্ড হয়ে উঠলাম। আমাদের দুজনের সঙ্গে পাঁচজন বাদ্যযন্ত্রী আছেন।
অনেকে মনে করেন, আপনারা দুই ভাই...
অরূপ: অনেকেই আমাদের ভাই মনে করে। প্রথমে আমরা ভাবছিলাম, ব্যান্ডের নাম ‘ব্রাদার্স’ থাকার কারণে হয়তো এমনটা হচ্ছে। কিন্তু পরে বুঝলাম, এটা শুধু নামের ব্যাপার নয়। আমাদের দর্শকেরা একদম সরাসরি এসে বলেই ফেলে, ‘আপনারা কি টুইন বা ভাই?’ এমনকি মাঝেমধ্যে আমাদের নামও বদলে যায়।
নয়ন: আসলে আমরা বন্ধু। তবে আমাদের পারিবারিক সম্পর্ক রয়েছে। বয়সের মধ্যে পার্থক্য থাকলেও গানের কারণে আমাদের বন্ধুত্ব অনেক দৃঢ়। আর দশটি ভাইয়ের মতোই আমাদের মধ্যে যেমন মিল রয়েছে, তেমনি আছে খুনসুটি, ঝগড়া আর অনেক মজার মুহূর্ত।
আপনারা বাংলা, উর্দু, হিন্দিসহ বিভিন্ন ভাষায় গান করেন। শ্রোতাদের অনেকে আপনাদের ভারতীয় কিংবা পাকিস্তানি মনে করেন।
অরূপ: বাংলা, ইংরেজি, উর্দু, হিন্দি, পাঞ্জাবি, স্প্যানিশ, চাকমা—আমরা ছয় থেকে সাত ভাষায় গান করি। আর প্রতিটি ভাষার গান গাওয়ার আগে সেই ভাষার এক্সপ্রেশন (অভিব্যক্তি), অ্যাকসেন্ট (উচ্চারণের টান)—সবকিছু ধরার চেষ্টা করি, যেন আসল ফিলটা (অনুভূতি) আসে। হয়তো এ কারণেই মানুষ আমাদের নিয়ে কনফিউজড (দ্বিধান্বিত) হয়ে যায়।
নয়ন: অনেকে ভাবে আমরা দুই দেশ থেকে এসেছি। হয়তো আমাদের চেহারা বা গায়ের রঙের জন্য। তবে যে যা–ই ভাবুক, বাংলা আমাদের মায়ের ভাষা, হৃদয়ের ভাষা আর আমরা শতভাগ বাংলাদেশি। বাংলা গানের প্রতি আমাদের ভালোবাসা কখনোই কমেনি, কমবে না।
কোন গান রোমিও ব্রাদার্সের বাঁক বদল করেছে?
নয়ন: ২০২৩ সালের এপ্রিল থেকে আমাদের পথচলায় অনেকগুলো মাইলফলক রয়েছে। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের ‘মধুমালতী’ ও নচিকেতার ‘নীলাঞ্জনা’ ভাইরাল হওয়ার পর থেকেই মনে হয়েছে, শ্রোতারা আমাদের সঙ্গে কানেক্ট (যোগাযোগ) করতে পারছেন। রাস্তাঘাটে, জনসমাগমে আমাদের দেখে চেনা শুরু করে, ছবি তুলতে আসে, আশীর্বাদ করে।
অরূপ: যদিও আমরা কখনোই ভাইরাল হতে চাইনি, তবে আমাদের স্টেজ পারফরম্যান্সের কিছু ছোট লাইভ ক্লিপ ছিল, যা মুহূর্তেই লাখ লাখ মানুষের কাছে পৌঁছে গেছে। আমরা অবাক হয়ে গিয়েছিলাম, যখন দেখলাম, অনেক আন্তর্জাতিক গুণী শিল্পীও এগুলো লাইক, শেয়ার ও কমেন্ট করছেন। আসলে সেই গানগুলোই আমাদের ব্যান্ডের জন্য একটা বড় টার্নিং পয়েন্ট হয়ে উঠেছে।
আপনাদের গানে আসা কীভাবে?
নয়ন: সংগীতচর্চা আমাদের শৈশবেই শুরু। আমি পুরান ঢাকায় বেড়ে উঠেছি, যেখানে পরিবারেই কাওয়ালি, সুফি, হিন্দি ও উর্দু গানের চর্চা ছিল। এসব শুনেই বড় হয়েছি। পরে ইংরেজি সাহিত্যে পড়াশোনা করেছি, যা শিল্প-সাহিত্যের প্রতি আমার ভালোবাসাকে আরও গভীর করেছে।
অরূপ: আমি ছোটবেলা থেকেই রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলগীতি ও সেমিক্ল্যাসিক্যাল গানের চর্চা করেছি। ঢাকার দোহারের নবাবগঞ্জে বেড়ে উঠেছি, পরে মাল্টিমিডিয়া ও ক্রিয়েটিভ টেকনোলজিতে পড়াশোনা করেছি।
মৌলিক গানে কবে আসছেন?
অরূপ: মৌলিক গান নিয়ে এখনো কোনো পরিকল্পনা করিনি। মাত্র এক বছর হলো পেশাদারভাবে গান করছি। এখনো শিখছি, গানের গভীরে ডুব দিচ্ছি। তবে শিগগিরই কিছু কালজয়ী বাংলা গান নতুন আঙ্গিকে কাভার করছি, আমাদের নিজস্ব ঢঙে।
নয়ন: শুধু করার জন্য মৌলিক গান করতে চাই না। আমি মনে করি, ব্যান্ড হিসেবে একটা মৌলিক গান তৈরি করতে গানের কথা, সুর, কম্পোজিশন—সবকিছুতেই দক্ষতা দরকার। আমরা চাই, আমাদের গান সত্যিকার অর্থেই মৌলিক হোক—আমাদের কথায়, আমাদের সুরে। তাই একটু সময় নিচ্ছি, যথাযথ প্রস্তুতি নিয়েই মৌলিক গান করব।
‘রোমিও ব্রাদার্স’ নিয়ে পরিকল্পনা কী?
নয়ন: উপমহাদেশে অনেক কিংবদন্তি মিউজিক্যাল ডুয়ো রয়েছে—শঙ্কর-জয়কিষান, নাদিম-শ্রাবণ, লক্ষ্মীকান্ত-পেয়ারেলাল, বিশাল-শেখর, সেলিম-সুলেমান, অজয়-অতুল, নিজামি ব্রাদার্স, নোরা সিস্টার্সসহ অনেক। এসব ডুয়োর কাজ ভিন্ন ভিন্ন ফ্লেভারের হয়, যা মানুষকে গভীরভাবে কানেক্ট করে। আমরা চাই, আমাদের কাজও যেন মানুষের হৃদয়ে স্থায়ী জায়গা তৈরি করে, যেন নতুন এক ধারা সৃষ্টি করে।
অরূপ: বাংলা গানকে বিশ্বদরবারে তুলে ধরার স্বপ্ন আমাদের রয়েছে এবং আমাদের নিজস্বতা বজায় রেখে পৃথিবীর বিভিন্ন সংস্কৃতির গানের মাধ্যমে তাদের সঙ্গে সেতুবন্ধ তৈরি করতে চাই।