সাগরের তীর থেকে... জীনাত রেহানার গানে জীবনের আলো
জন্মদিনের কেক আনা হয়েছে। কেকের ওপর জ্বলছে মোমবাতি। হাস্যোজ্জ্বল মুখে মানুষটা এগিয়ে এসে পড়বেন রবীন্দ্রনাথের কবিতা—‘তোমরা রচিলে যারে/ নানা অলংকারে/ তারে তো চিনি নে আমি,/ চেনেন না মোর অন্তর্যামী/ তোমাদের স্বাক্ষরিত সেই মোর নামের প্রতিমা।’ পরক্ষণেই গেয়ে উঠবেন নিজের জনপ্রিয় গান ‘সাগরের তীর থেকে’। গান শেষে সমুদ্রের শান্ত ঢেউয়ের মতো থেমে যাবেন। ডেকে নেবেন প্রিয় মানুষদের, কেক কাটবেন। ‘শুভ জন্মদিন’ আর করতালির শব্দে মুখর হবে চারপাশ।
এই দৃশ্য হয়তো হতোই, যদি তিনি আজ বেঁচে থাকতেন। কিন্তু সে সুযোগ আর নেই। ‘সাগরের তীর থেকে’ গানের শিল্পী জীনাত রেহানা ২ জুলাই (মঙ্গলবার) না–ফেরার দেশে চলে গেছেন। ‘জন্মিলে মরিতে হবে’—এই চিরন্তন সত্য মেনে নিয়েই সবাইকে চলে যেতে হয়। থেকে যায় কর্ম, সৃষ্টি আর মানুষের ভালোবাসা। জীনাত রেহানাও রয়ে যাবেন তাঁর গানে, সৃষ্টিতে, স্মৃতিতে।
তবে যে গান তাঁকে খ্যাতি আর পরিচিতি এনে দিয়েছিল, সেই গানের সঙ্গে তাঁর শৈশবের স্বপ্নের খুব একটা সম্পর্ক ছিল না। গান ভালো লাগত, শিখতেনও, তবে এর পেছনে নাম, যশ, খ্যাতির কোনো তাড়া ছিল না তাঁর।
গানের প্রতি ভালোবাসা তাঁর পারিবারিক উত্তরাধিকার। মা জেব-উন-ন্নেসা জামাল ছিলেন গীতিকার ও লেখক। খালা ছিলেন বিখ্যাত কণ্ঠশিল্পী আঞ্জুমান আরা বেগম। ফরিদা ইয়াসমিনসহ সেই সময়ের খ্যাতিমান শিল্পীদের গানও মনোযোগ দিয়ে শুনতেন জীনাত রেহানা। নিজেও গান গাইতেন। তাঁর সংগীতযাত্রার মোড় ঘুরেছিল বেতারে অডিশন দিতে গিয়ে। অডিশন বোর্ডের সদস্য ছিলেন আবদুল আহাদ ও সমর দাশ। কিশোরী বয়সেই তাঁদের মন জয় করে তালিকাভুক্ত শিল্পী হন জীনাত রেহানা। ১৯৬৪ সাল থেকে শুরু হয় তাঁর বেতারযাত্রা।
গানের এই পথচলায় সবচেয়ে বড় সাহস ও অনুপ্রেরণা দিয়েছিলেন খালা আঞ্জুমান আরা বেগম। মা-ও পিছিয়ে ছিলেন না। এক সাক্ষাৎকারে জীনাত রেহানা বলেছিলেন, ‘আমার প্রয়োজনেই কিন্তু মা গান লেখা শুরু করেছিলেন।’ এরপর বাংলাদেশ টেলিভিশনের (তৎকালীন পাকিস্তান টেলিভিশন) মাধ্যমে টেলিভিশনেও গান গাওয়ার সুযোগ পান। ১৯৬৫ সাল থেকে নিয়মিত শিল্পী ছিলেন টেলিভিশনে। ১৯৬৮ সালে বেতারে রেকর্ড হয় তাঁর বিখ্যাত গান ‘সাগরের তীর থেকে’। প্রথমবার বেতারে এই গান তিনিই গেয়েছিলেন। পরে ‘সুরবিতান’ অনুষ্ঠানে টেলিভিশনে গানটি গেয়েছিলেন শাহনাজ রহমতুল্লাহ ও সৈয়দ আবদুল হাদী। ১৯৬৯ সালে আবারও নিজেই এই গান পরিবেশন করেন জীনাত রেহানা। বেতারে ‘সাগরের তীর থেকে’ প্রচারের পরপরই জনপ্রিয়তা পায় গানটি। ক্রমে শ্রোতাদের হৃদয়ে জায়গা করে নেয়। গানটির কথা লিখেছিলেন তাঁর মা জেব-উন-ন্নেসা জামাল, সুর করেছিলেন করীম সাহাবুদ্দীন।
ব্যক্তিজীবনে মিষ্টভাষী, দৃঢ়চেতা ও সাহসী ছিলেন জীনাত রেহানা।
বিয়ে করেন টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব মোস্তফা কামাল সৈয়দকে। নিয়মিত সংগীতচর্চায় সম্পৃক্ত না থাকলেও কাজ করেছেন জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায়। সময় পেলে আবারও ফিরতেন গানের জগতে। আধুনিক গানের পাশাপাশি তিনি ছোটদের গানও গেয়েছেন।
ছোটদের গান নিয়ে তাঁর ছিল বিশেষ ভালোবাসা। মায়ের লেখা বই ‘জাদুর পেনসিল’ থেকে অনেক গান করেছেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল, ‘ছোটদের গান হবে ছোটদের মতোই।’
২০১৪ সালে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন ছোটদের গান নিয়ে তাঁর বিশেষ স্বপ্নের কথা। মানুষ চলে যায়, কিন্তু থেকে যায় কাজ ও সৃষ্টি। জিনাত রেহানাও বেঁচে থাকবেন তাঁর গানে—‘এই চোখেতে কাজল আর রাখব না’, ‘আমি কাঁকন দিয়ে ডেকেছিলাম মুখে লজ্জা ছিল বলে’, ‘আমি যার কথা ভাবছি মনে আনমনে’—এসব গান বাজলেই মনে পড়বে তাঁর কথা।
গানের ভুবনে তিনি রয়ে যাবেন আলোর মতোই।