ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর কাছে সেতারে দীক্ষা নিতে রবিশঙ্কর মাইহার গিয়েছিলেন ১৯৩৮ সালে। মাইহার জায়গাটি পড়েছে ভারতের মধ্যপ্রদেশে। তখন রবিশঙ্করের বয়স ১৮ বছর। এই বয়সেই তাঁর প্যারিসসহ ইউরোপের বড় বড় শহর ঘোরা শেষ। বড় ভাই উদয়শঙ্কর একজন নামকরা নৃত্যশিল্পী ছিলেন। ১০ বছর বয়স থেকেই বড় ভাইয়ের সঙ্গে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ঘোরেন এবং নৃত্যে বিশেষ পারদর্শিতা অর্জন করেন।
দীর্ঘ সংগীতজীবনে অসংখ্য ভক্ত, অনুরাগী সৃষ্টি করেছেন শাস্ত্রীয় সংগীতের মাইহার-ঘরানার কিংবদন্তি শিল্পী আলাউদ্দিন খাঁ। তিনি চাইতেন তাঁর শিষ্যরা বিশুদ্ধ রূপে সংগীতশিক্ষা করবে। কোনো ধরনের অমনোযোগিতা তিনি সহ্য করতেন না। একটু এদিক-ওদিক হলেই দুই ঘা লাগিয়ে দিতেন। বকাঝকা করতেন। ছাত্রদের বাবুয়ানি দেখতে পারতেন না তিনি।
আলাউদ্দিন খাঁর আত্মজীবনী ‘আমার কথা’। সাংবাদিক লেখক শুভময় ঘোষের অনুলিখিত বইটির ভূমিকা লিখেছেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর। এই ভূমিকাতেই মাইহার-জীবনের নানা বিষয় উঠে এসেছে।
বলা যেতে পারে, ভারতের রাগসংগীতের অন্যতম কিংবদন্তি পণ্ডিত রবিশঙ্কর ছিলেন আলাউদ্দিন খাঁর প্রিয় ছাত্রদের একজন। মাইহারে এসে তিনি (রবিশঙ্কর) পেলেন আলাউদ্দিন খাঁর ছেলে সরোদের নামী শিল্পী ওস্তাদ আলী আকবর খাঁকেও। মাইহারে মোট ছয় বছর (১৯৩৮-১৯৪৪) ছিলেন রবিশঙ্কর।
সাধক শিল্পীর সরল জীবন
এই সময়ে আলাউদ্দিন খাঁর বড় কন্যা রওশন আরা বেগমকে (পরে নাম হয় অন্নপূর্ণা) বিয়ে করেন। ১৯৪১ সালের ১৫ মে তাঁদের বিয়ে হয়। অন্নাপূর্ণা তখন ১৩ বছরের কিশোরী, আর রবিশঙ্করের বয়স ২১। যদিও সুরবাহারের নামী শিল্পী অন্নপূর্ণার সঙ্গে পরে বিচ্ছেদ ঘটে গিয়েছিল।
তবে বইয়ে আলাউদ্দিন খাঁর মেজাজমর্জির যেসব ঘটনা তিনি উল্লেখ করেছেন, বোধ করি তা জামাতা হওয়ার আগে।
বইয়ে আলাউদ্দিন খাঁর মেজাজের একটা উদাহরণ দিয়েছেন রবিশঙ্কর। তিনি লিখেছেন, ‘একজন সেতারের শাগরেদকে বাবা একবার মারতে উঠে হাতের কাছে কিছু না পেয়ে ওর সেতারটা দিয়েই মাথায় ঘা লাগালেন। সেতারের তুম্বাটা তখন ভেঙে ছেলেটির মাথায় বসে গেল। সেই শাগরেদ তখন হাউমাউ করে উঠল।’
বইটিতে ছাত্রদের প্রতি গুরুর এমন আচরণের আরও উদাহরণ আছে।
কিন্তু রবিশঙ্কর কোনো দিন আলাউদ্দিন খাঁর হাতে মার খাননি, এমনকি গালিগালাজও নয়। কিন্তু কেন? তিনি লিখছেন, ‘হয়তো তার কারণ এই যে, আমার মা আমাকে বাবার হাতে তুলে দিয়েছিলেন, আর বাবাও মাকে কথা দিয়েছিলেন। সেই থেকে আমি তাঁর আরেক ছেলের মতো হলাম। তা ছাড়া উনি জানতেন আমি ছোটবেলা থেকে কী আদরে মানুষ, আর অভিমানী স্বভাবের ছেলে…তাই হয়তো...’
রবিশঙ্কর লিখেছেন, তিনি ভুল কম করতেন, তাড়াতাড়ি তুলে ফেলতে পারতেন। এ কারণে বাবা তাঁকে খোশ মেজাজেই শেখাতেন। কিন্তু যেদিন আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবের মেজাজটা আগে থেকেই খিঁচড়ে থাকত, সেদিন ভয়ে তারও সবগড় হয়ে যেত। শেখানো জিনিসগুলো তুলতে অযথা দেরি হয়ে যেত। মারধর বা গালি না জুটলেও বুঝতেন, বাবার মেজাজ আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে এবং তা প্রকাশ পেত তাঁর গলার কর্কশতায় এবং আওয়াজের ভলিউমের তারতম্যে। এ রকম অবস্থায় বেশ কড়া সুরে বলতেন, বাজাও। বলে বাইরে চলে যেতেন।
রবিশঙ্কর লিখেছেন, ‘আমার তো তখন বাজনা মাথায় চড়েছে। অভিমানে চোখ ফেটে জল আসতো। ভাবতাম মাথায় থাক বাজনা, আজকের বিকেলের ট্রেনে এখান থেকে বিদেয় হবো। প্রায়ই এরকম পরিস্থিতি হতো। কিন্তু কিছু পরে ফিরে এসে ঠান্ডা মাথায় আবার শেখাতে শুরু করতেন। অথবা বলতেন, যাও বাড়ি গিয়ে রেওয়াজ করো।’
রবিশঙ্করের ওপর রাগ পুরোপুরি প্রকাশ করতে না পেরে ফ্রাসট্রেটেড হয়ে একেবারে বাইরে চলে যেতেন আলাউদ্দিন খাঁ। যাকে পেতেন, তার ওপরই চেঁচামেচি করে রাগটা খালাস করে দিতেন। অথবা রাগ আরও বেশি হলে অন্য কোনো ছাত্রকে দুই ঘা মেরে দিতেন। অথবা পাড়ার কোনো কুকুরকে লাঠির বাড়ি মেরে নিজের রাগটুকু ঝরিয়ে দিতেন।
আজ ৬ সেপ্টেম্বর শাস্ত্রীয় সংগীতের মহাসাধক, সুরসম্রাট আলাউদ্দিন খাঁর প্রয়াণবার্ষিকী। জন্ম ১৮৬২ সালের ৮ অক্টোবর, বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলার নবীনগর উপজেলার শিবপুর গ্রামে। জায়গাটা তখন ত্রিপুরার অধীনে ছিল। দীর্ঘ জীবন পেয়েছিলেন ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ। তাঁর আত্মার শান্তি হোক।
আরও পড়ুন:
ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর প্রয়াণবার্ষিকী আজ
সাধক শিল্পীর সরল জীবন