ওয়ারফেজ কেন আলাদা

বাংলায় হেভি মেটাল ধারার গানকে শ্রোতাদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে অগ্রগণ্য ভূমিকা রেখেছে ওয়ারফেজ। ব্যান্ডটি চার দশক পূর্ণ করেছে গতকাল।

ওয়ারফেজের বর্তমান লাইনআপছবি: ব্যান্ডের সৌজন্যে

সত্তর-আশির দশকে আইরন মেইডেন, স্করপিয়নস, ডিপ পার্পেল, ব্ল্যাক সাবাথ, মেটালিকার গানে বুঁদ ছিলেন ঢাকার তরুণেরা। তখনো ঢাকায় কোনো হেভি মেটাল ব্যান্ড গড়ে ওঠেনি।

দুনিয়াজুড়ে ইংরেজি গান নিয়ে উন্মাদনার মধ্যে ১৯৮১ সালে ঢাকায় ‘ওয়েভস’ নামে একটি হেভি মেটাল ব্যান্ড গড়ে ওঠে। মূলত বাইরের ইংরেজি গান কাভার করত ব্যান্ডটি; তখনো বাংলায় হেভি মেটালের চল আসেনি।

১৯৮৪ সালের ৬ জুন যাত্রা করে ওয়ারফেজ। বাকি ব্যান্ডের মতো ওয়ারফেজও ইংরেজি গান কাভার করত। রাজধানীর রাশিয়ান কালচারাল সেন্টারে গাইতেন তারা; দর্শকসারিতে ২০–২৫ জনের মতো থাকতেন।

১৯৯৬ সালের কমল, সাঞ্জয়, বাবনা, রাসেল ও ফুয়াদ ইবনে রাব্বী
ব্যান্ডের সৌজন্যে

ফিডব্যাকের মাকসুদুল হকের পরামর্শে ইংরেজি ছেড়ে বাংলা গানে থিতু হয়েছিল ওয়ারফেজ। চার দশকের স্মৃতি হাতড়ে বৃহস্পতিবার মাকসুদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওদের বয়স কম ছিল, বয়সের তুলনায় অনেক এগিয়ে ছিল। ব্যান্ড হিসেবে ওরা নিখুঁত ছিল। একদিন ডেকে বললাম, তোমরা বাংলা গান করো না কেন? ব্যান্ডকে টিকিয়ে রাখতে মৌলিক গান দরকার।’

একসময় মাকসুদও ইংরেজি গান করতেন। আজম খানের তাড়নায় বাংলা গানে ফিরেছেন তিনি। সেই তাড়না ওয়ারফেজের মধ্যে ছড়িয়ে দেন মাকসুদ। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পতনের পর ১৯৯০ সালে বিজয় দিবসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মল চত্বরে কনসার্ট করেছিল বাংলাদেশ মিউজিক্যাল ব্যান্ডস অ্যাসোসিয়েশন (বামবা)।

ব্যান্ডের প্রথম অ্যালবাম ওয়ারফেজ–এর প্রচ্ছদ
ছবি: সংগৃহীত

বামবার প্রথম সভাপতি মাকসুদের পরামর্শে সেই কনসার্টে প্রথমবারের মতো বাংলা গান পরিবেশন করে ওয়ারফেজ। তখন থেকে নিয়মিত বাংলায় গান করে আসছে ব্যান্ডটি।

ওয়ারফেজের দলনেতা টিপু বলেন, ‘মাকসুদ ভাই আমাদের বোঝালেন, বাংলা গানই আমাদের পরিচয়। তখন ব্যাপারটা অনুধাবন করে বাংলা গান শুরু করি। এর পর থেকে মৌলিক গান নিয়েই এগিয়ে যাই।’

১৯৯১ সালে বাংলায় প্রথম হেভি মেটাল অ্যালবাম ‘ওয়ারফেজ’ প্রকাশ করে এই ব্যান্ড। ওয়ারফেজের হাত ধরেই বাংলায় হেভি মেটাল প্রাণ পেয়েছে। ইংরেজি হেভি মেটালের জোয়ারের বিপরীতে মানুষের মুখে মুখে বাংলা হেভি মেটাল ছড়িয়েছে। অ্যালবামের ‘বসে আছি’, ‘একটি ছেলে’র মতো গান বাংলা রক সংগীতে নতুন দিশা দিয়েছে।

রক সংগীতের গবেষক মিলু আমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘তখন আমরা ইংরেজি হার্ড রক, হেভি মেটাল শুনে বেড়ে উঠছি। সেই সময় বাংলায় হেভি মেটাল পাইনি। ফলে ওয়ারফেজ অ্যালবামটি পেয়ে আমরা আকাশ থেকে পড়েছিলাম। গানগুলোর সাউন্ড ও কথায় নতুন ব্যাপার ছিল।’

সেই সময়ে ওয়ারফেজ ছাড়াও হেভি মেটাল চর্চা করেছে ‘রকস্ট্রাটা’, ব্যান্ডটির প্রথম অ্যালবাম রকস্ট্রাটা প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯২ সালে। ‘ইন ঢাকা’ ও ‘এসেস’-এর মতো ব্যান্ডও হেভি মেটাল গান করছিল।

আজ বিকেলে কেক কেটে ওয়ারফেজের চার দশক পূর্তি উদযাপন করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ব্যান্ড সোসাইটি
ছবি: সংগৃহীত

ওয়ারফেজ কেন আলাদা

চার দশকের পথচলায় বহু ভাঙা-গড়ার মধ্যেও জোরালোভাবেই টিকে রয়েছে ওয়ারফেজ, এটিই ব্যান্ডটিকে আলাদা করেছে বলে মনে করেন মাকসুদ। তাঁর ভাষ্যে, ৪০ বছরে ২০ বারের বেশি ভাঙা-গড়া দেখেছে ব্যান্ডটি।

‘টিপু ও কমল ব্যান্ডটিকে টিকিয়ে রেখেছে। ওয়ারফেজ দেশের সেরা ব্যান্ডগুলোর একটা।’ বলেন মাকসুদ।

ওয়ারফেজ সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকা ব্যান্ড বলা হয়। ওয়ারফেজের দলনেতা শেখ মনিরুল আলম টিপু বলেন, ‘আমরা অ্যাডভান্স মিউজিক করেছি। এই গানটা আজকের জন্য নয়, ২০ বছর পর সেটি সাফল্য পাবে। ভালো কথা ও সুরের গান শত বছর বেঁচে থাকে। সেই দর্শনেই এগিয়েছি। গানই আমাদের বাঁচিয়ে রাখবে।’

‘অসামাজিক’, ‘জীবনধারা’, ‘ধূসর মানচিত্র’, ‘মহারাজ’-এর মতো প্রতিবাদী গান করেছে ওয়ারফেজ। আবার ‘অবাক ভালোবাসা’, ‘মৃত্যু এলিজি’, ‘পথচলা’র মতো আধ্যাত্মিক ধরনের গানও করেছে।

কোক স্টুডিও বাংলায় ‘অবাক ভালোবাসা’ প্রকাশের পর নব্বইয়ের শ্রোতাদের পাশাপাশি হালের তরুণ শ্রোতারাও বুঁদ হয়ে আছেন। মূলত গানের কথাই ওয়ারফেজকে আলাদা করেছে। ব্যান্ডের বেশির ভাগ গান লিখেছেন বাবনা করিম ও কমল।

‘বাংলার রক মেটাল’ বইয়ের অন্যতম লেখক মিলু আমানের ভাষ্যে, ‘ব্যান্ডটির গানের লিরিক অর্থবহ। তরুণদের অনুপ্রাণিত করে। গান শুনলে বোঝা যায়, গীতিকারের বাংলা কবিতা সম্পর্কে বেশ জানাশোনা আছে।’

ওয়ারফেজের পুরানো সদস্যেরা
ছবি: ওয়ারফেজের সৌজন্যে

গানের কথার বাইরে ব্যান্ডটি গায়কি ও গিটারে নিজেদের আলাদা করেছে। সাঞ্জয়, বাবনা করিম, মিজান, পলাশের মতো ভোকালিস্ট নিয়ে এসেছে ব্যান্ডটি। কমল, রাসেল আলী, জুয়েলের মতো গিটারিস্ট বাংলা রক সংগীতে নিজেদের ছায়া ফেলেছেন।

ড্রামার হিসেবে নিজেকে অন্য উচ্চতায় নিয়েছেন টিপু। নানা চড়াই-উতরাইয়ে ব্যান্ডকে আগলে রেখেছেন তিনি। টিপু বলেন, ‘যে যার মতো করে অন্য ক্যারিয়ারে চলে গেছে। তবে ব্যান্ডটি নিয়ে স্বপ্ন, দৃঢ়তা ছিল, এখনো আছে। সাবেক সদস্য, বর্তমান সদস্য ও ভক্তদের ভালোবাসায় আমরা এত দূর এসেছি। সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা রইল।’

নতুন অ্যালবাম

৪০ বছর পূর্তিতে নতুন অ্যালবামের পরিকল্পনা করেছে ব্যান্ডটি। এতে বর্তমান সদস্যদের সঙ্গে সাবেক দু-তিনজন সদস্যও থাকতে পারেন। অ্যালবামের নাম এখনো চূড়ান্ত করা হয়নি। নতুন সব গানে সাজানো হবে অ্যালবামটি।

এর বাইরে ‘পথচলা ২’ অ্যালবামে পুরোনো গানগুলো নতুনভাবে প্রকাশ করা হবে।

ওয়ারফেজের বর্তমান লাইনআপ: টিপু (দলনেতা, ড্রামস), পলাশ (ভোকাল), কমল (লিড গিটার), রজার (বেজ), শামস (কি-বোর্ড), সামির (লিড গিটার), সৌমেন (লিড গিটার)।