চারবার স্ট্রোক, সেই রিংকুর জীবনের গল্প এখন হতাশা আর হাহাকারে ভরা
‘ক্লোজআপ ওয়ান’ দিয়ে ক্যারিয়ার শুরু করেন তিনি। গানের আয়োজনটি শেষ হওয়ার পরে সবাই যখন এককভাবে ক্যারিয়ার এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন, তখন সবার মধ্যে অনেকটা এগিয়ে ছিলেন এই তরুণ গায়ক। অল্প সময়ের মধ্যে নিজস্ব একটা দর্শক তৈরি করতে পেরেছিলেন গায়ক মশিউর রহমান রিংকু। মেধা ও প্রজ্ঞা দিয়ে সংগীত অঙ্গনে যখন আলাদা করে পথচলা শুরু, তখনই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। সরে যান গান থেকে। আলোচিত রিংকুর পরের গল্প যেন হতাশা আর হাহাকারে ভরা।
‘ভুল বুঝে চলে যাও, যত খুশি ব্যথা দাও, সব ব্যথা নীরবে সইব বন্ধুরে তোমার লেখা গান আমি গাইব’, কখনো গানটি শুনলে বা গানটির কথা উঠলেই সংগীতশিল্পী রিংকুর কথা মনে পড়ে। রিংকু টেলিভিশন লাইভ বা মঞ্চে দরদ দিয়ে গানটি গাইতেন। শ্রোতারা বুঁদ হয়ে থাকতেন গানে। এমন যত্ন নিয়েই আরও অনেক গান রিংকুর দখলে ছিল। গানটির কথা বলার বিশেষ কারণ, গানটি গাওয়ার সময় হঠাৎ করেই থেমে যেতেন রিংকু।
এরপর বলতেন, গানটির সঙ্গে তাঁর ‘আত্মীয়তা’র কথা। ভক্তদের শোনাতেন নাটোরের চলনবিল এলাকার কথা। সেখানে শৈশবে অনেক যাত্রা দেখেছেন। শীতের মধ্যে চাদর গায়ে দিয়ে সেই যাত্রা দেখতে যেতেন রিংকু। যাত্রায় অবধারিত ছিল গানটি। এমন অনেক গান শুনে সংগীতশিল্পী হওয়ার প্রেরণা পেয়েছিলেন সেই শৈশবে। গান দিয়ে শ্রোতাদের আনন্দ দেওয়া এই সংগীতশিল্পী এখন ভালো নেই। অল্প বয়সেই ক্যারিয়ারের শেষ প্রান্তে তিনি। বেঁচে থাকা নিয়েই এখন তাঁর ব্যস্ততা। গান থেকে দীর্ঘদিন তিনি দূরে। অভিমানে গান নিয়েও এখন তিনি কথা বলতে চান না। সর্বশেষ গত বছর বুকভরা অভিমান নিয়ে ঢাকায় এসেছিলেন। দীর্ঘ নিশ্বাস নিয়ে গণমাধ্যমে বলেছিলেন, ‘হয়তো গেয়ে ফেলেছেন জীবনের শেষ গান।’ সেই গানের শিরোনাম ছিল ‘জোছনাবিলাস’। তার পরে আর অভিমান নিয়ে গণমাধ্যমে কথা বলেননি এই গায়ক।
অভিমান নিয়ে সেই গান প্রকাশের সময় রিংকু বলেছিলেন, ‘অসুস্থতা নিয়ে এই সময়ে কোনো অনুষ্ঠানে আসব, এটা আমি ভাবতেই পারিনি। আমাকে কেউ আর এখন ডাকে না। আমাকে নিয়ে এমন আয়োজনের জন্য ধন্যবাদ রাজকে।’ জানা যায়, রাজের কাছে গানটির কথা শুনেই অসুস্থ অবস্থায় গাইতে রাজি হয়েছিলেন।
রিংকুর সংবাদ সম্মেলনে তাঁর শারীরিক অবস্থা প্রসঙ্গে জানিয়েছিলেন, তিনি রোগের সঙ্গে নিত্যদিন যুদ্ধ করছেন। ইতিমধ্যে তিনি চারবার স্ট্রোক করেছেন। যে কারণে কথায় কিছুটা জড়তা। সেভাবেই মনে করিয়ে দিলেন অতীতের সুসময়ের কথা। যখন দর্শকেরা তাঁর গান শোনার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়তেন। কখনো গান শুনে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়তেন।
ভক্তদের আশার কথা শুনিয়ে রিংকু বলেছিলেন, ‘আমি আগের চেয়ে কিছুটা ভালো। হয়তো আরও ভালো চিকিৎসা পেলে সুস্থ হয়ে গানে ফিরতে পারব। একটা সময় আমি সারা দিন গান নিয়ে থাকতাম। গুনগুন করে গান গাইতাম। গানের মধ্যেই থাকা হতো। কিন্তু এখন শারীরিক অসুস্থতার জন্য কোনো গানই করা হয় না। গান নিয়ে থাকব, ভাবব, এটা মানসিকভাবে পারি না।’
আলোচনায় উঠে আসে রিংকুর কষ্টের কথা। উঠে এল ঢাকার কথা। এই ঢাকাতেই একসময় রাতদিন কেটেছে গান নিয়ে। গান নিয়ে আড্ডায় ছুটেছেন এক টেলিভিশন থেকে আরেক টেলিভিশনের লাইভে, স্টেজ শো নিয়ে ব্যস্ত থেকেছেন। সেই ঢাকা এখন যেন রিংকুর চোখে নতুন। একসময় একটু আড়াল হলেই বন্ধু, সহকর্মীরা কাজের জন্য খোঁজখবর নিতেন। কিন্তু অসুস্থ হয়ে নওগাঁর আত্রাই উপজেলার গ্রামের বাড়িতে থাকার পর সেই প্রিয় মানুষেরা যেন অচেনা হয়ে যান। সেই মানুষেরাই আর খবর নেন না।
সেই কষ্টের কথা বলতে গিয়ে রিংকু বলেন, ‘এখন আমার খবর আর কে নেবে। আমি আর কোনো কাজেও লাগি না। কেউ আমার খবরও নেয় না। ইন্ডাস্ট্রির মানুষেরা স্বার্থপর। আমি অসুস্থ হওয়ার পর কারও কাছ থেকে তেমন সহায়তা পাইনি। ক্লোজ-আপ ওয়ানের বন্ধুরাও খবর নেয় না।’
লোকগানের গায়ক রিংকুর দিন কাটে এখন গ্রামের বাড়িতে। দীর্ঘ কয়েক বছর ধরেই তিনি গ্রামেই রয়েছেন। ২০১৬ সালে হঠাৎ করেই মারা যান রিংকুর বাবা। তখন অস্ট্রেলিয়ার মঞ্চে ছিলেন এই গায়ক। এর মধ্যেই বাবার মৃত্যুর খবর শোনেন এই গায়ক। শোকে তিনি স্ট্রোক করেন। স্ট্রোক হওয়ার পর গানের জগৎ থেকে একরকম দূরেই চলে গিয়েছিলেন রিংকু। আস্তে আস্তে আবার সুস্থ হয়ে উঠছেন। টুকটাক গানও শুরু করেছেন। তবে সেই গান হয়তো নিয়মিত আর গাওয়া হবে না। থাকেন নওগাঁয়।