কিংবদন্তির মৃত্যু নেই

অগ্রজ গাজী মাজহারুল আনোয়ারের অনুরক্ত, ভক্ত কবির বকুল
কোলাজ

আধুনিক গানের সৃজন ঘটেছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গীতিকবিতায়। আর আমাদের বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের গানের ভান্ডার সমৃদ্ধ হয়েছিল হাতে গোনা কজন গীতিকবি ও গীতিকারের গীতিকবিতায়।  তাঁদের মধ্যে অন্যতম গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার। এই নাম বলার প্রথম কারণ হলো, আমি বাংলা গানের প্রেমে পড়ি ১৮ কি ১৯ বছর বয়স থেকে। কিশোর বয়সেই চলচ্চিত্রের গানের বাণীগুলো শোনার পাশাপাশি গানটি কে লিখেছেন বা সুর করেছেন, সেটা জানার চেষ্টা করতাম। দেখা গেছে, চলচ্চিত্রের যে গানটাই খুব ভালো লাগত, সেই গানটিরই রচয়িতা গাজী মাজহারুল আনোয়ার।

সেই থেকেই আমি এই কিংবদন্তির অনুরক্ত, ভক্ত। সেই থেকেই তিনি আমার কাছে গীতিকবিতার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। আর আমি সেই প্রতিষ্ঠানের একনিষ্ঠ ছাত্র। তাঁর পথ অনুসরণ করেই তাঁর পথে হেঁটে চলেছি।

আবার পেছনে ফিরে যাই। বাড়িতে একটা ফিলিপস ব্র্যান্ডের রেডিও ছিল। আব্বা সেই রেডিওতে খবরটাই বেশি শুনতেন। আর আমরা ভাইবোন মিলে দুপুরবেলা শুনতাম চলচ্চিত্রের গান। রেডিওতে ভেসে আসত সত্য সাহার সুরে আঞ্জুমান আরা বেগমের গাওয়া ‘আয়না ও অবশিষ্ট’ ছবির গান ‘আকাশের হাতে আছে একরাশ নীল’, কিংবা সুবল দাসের সুরে রুনা লায়লার গাওয়া ‘গানেরই খাতায় স্বরলিপি লিখে’। (এই গান ছিল রুনা লায়লার বাংলা চলচ্চিত্রের প্রথম প্লেব্যাক) এ দুটো গানই গাজী মাজহারুল আনোয়ারের লেখা। প্রথম গানটির কথায় কী অসাধারণ কাব্যময়তা, ‘আকাশের হাতে আছে একরাশ নীল/ বাতাসের আছে কিছু গন্ধ/ রাত্রির গায়ে জ্বলে জোনাকি/ তটিনীর বুকে মৃদু ছন্দ।’

আর পরের গানটির সঞ্চারীর লাইনগুলো আমাকে বিস্মিত করে, ‘যে কুড়ায় কাচের গুড়ো/ পথের ধারে ছিঁড়ে ফেলে/ আঁচলে চন্দ্র ঢেকে সে হয় খুশি পিদিম জ্বেলে।’ এ দুটি গানের কথা উল্লেখ করার কারণ, ‘আমরা যারা গান লেখার চেষ্টা করি, তাদের জন্য গান দুটি আদর্শ রেফারেন্স। গান রচনাকৌশল, গানের কবিতায় ছন্দ, অন্তমিল, কাব্যময়তা—সবই রয়েছে গান দুটিতে।’

গাজী মাজহারুল আনোয়ার
ছবি: সংগৃহীত

একটি চলচ্চিত্রে দেখা গেছে, ছয়টি বা পাঁচটি গান থাকে। প্রতিটি গানই বিচিত্র রকম। কখনো ভীষণ রোমান্টিক, কখনো চটুল রোমান্টিক, কখনো বিরহকাতর, আবার কখনো কমেডিতে ভরপুর। আর গল্পের প্রয়োজনে যে ধরনের গানই হোক না কেন, সবগুলোই দারুণভাবে উঠে এসেছে গাজী মাজহারুল আনোয়ারের কলমে এবং তাঁর লেখা অধিকাংশ গানই সুপারহিট। এ পর্যন্ত বাংলা চলচ্চিত্রে যত গান হয়েছে, তার অর্ধেক গানই গাজী মাজহারুল আনোয়ারের লেখা।

ভীষণ রোমান্টিক কয়েকটি গানের কথা বলি। আনোয়ার পারভেজের সুরে রুনা লায়লার গাওয়া ‘দ্য রেইন’ ছবির ‘আয় রে মেঘ আয় রে’। সত্য সাহার সুরে রুনা লায়লার গাওয়া আনারকলি ছবির ‘আমার মন বলে তুমি আসবে’। আনোয়ার পারভেজের সুরে সাবিনা ইয়াসমীনের গাওয়া ‘মানসী’ ছবির গান ‘এই মন তোমাকে দিলাম’। আনোয়ার পারভেজের সুরে তপন চৌধুরী ও শাকিলা শর্মার গাওয়া ‘ঢাকা ৮৬’ ছবির ‘পাথরের পৃথিবীতে কাচের হৃদয়’।

আবার চটুল রোমান্টিক গান উল্লেখ করলে বলব, আলাউদ্দীন আলীর সুরে রুনা লায়লার গাওয়া ‘কসাই’ চলচ্চিত্রের ‘বন্ধু তিন দিন তোর বাড়িত গেলাম দেখা পাইলাম না’। সত্য সাহার সুরে খন্দকার ফারুক আহমেদ ও সাবিনা ইয়াসমীনের গাওয়া ‘ঢাকা শহর আইসা আমার আশা পুরাইছে। সত্য সাহার সুরে সাবিনা ইয়াসমীনের গাওয়া ‘সমাধি’ ছবির ‘ও আমার রসিয়া বন্ধু রে, তুমি কেন কোমরের বিছা হইলা না।’

গাজী মাজহারুল আনোয়ার
ছবি: সংগৃহীত

এমন কোনো বিষয় নেই, যা নিয়ে গীত রচনা করেননি গাজী মাজহারুল আনোয়ার। বাংলা চলচ্চিত্রে কিছু আধ্যাত্মিক গান তিনি লিখেছেন। এ গানগুলোর বাণী এতটাই অর্থবহ এবং ভাবপূর্ণ, যা কালজয়ী গান হিসেবে অমর হয়ে থাকবে।

আলাউদ্দীন আলীর সুরে সৈয়দ আব্দুল হাদীর গাওয়া ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ চলচ্চিত্রের ‘আছেন আমার মোক্তার আছেন আমার ব্যারিস্টার’। আলাউদ্দীন আলীর সুরে সৈয়দ আব্দুল হাদীর গাওয়া ‘চোখের নজর এমনি কইরা একদিন ক্ষইয়া যাবে’। আলাউদ্দীন আলীর সুরে রথীন্দ্রনাথ রায়ের গাওয়া ফকির মজনু শাহ ছবির গান ‘সবাই বলে বয়স বাড়ে আমি বলি কমে রে’। আলাউদ্দীন আলীর সুরে রথীন্দ্রনাথ রায়ের গাওয়া ‘নাগরদোলা’ ছবির ‘তুমি আরেকবার আসিয়া, যাও মোরে কান্দাইয়া।’

গাজী মাজহারুল আনোয়ারের সঙ্গে কবির বকুল।
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

চলচ্চিত্র থেকে বেরিয়ে আমরা যদি কান পাতি দেশাত্মবোধক গানে। আমাদের কানে ভেসে আসবে অসাধারণ কিছু গান। আনোয়ার পারভেজের সুরে শাহনাজ রহমতুল্লাহর গাওয়া তিনটি গান ‘একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনারগাঁয়’, ‘যদি আমাকে জানতে সাধ হয় বাংলার রূপ তুমি দেখে নিও’, ‘একতারা তুই দেশের কথা বল রে এবার বল’। আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের সুরে সাবিনা ইয়াসমীনের গাওয়া ‘মাগো আর তোমাকে ঘুমপাড়ানি মাসি হতে দেব না’। সুবীর নন্দীর সুরে, সুবীর নন্দী, তপন চৌধুরী ও শাকিলা শর্মার গাওয়া ‘আমার গানের অস্থায়ী আমার বাংলাদেশটা।’

আর যে গানটি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে বাঙালিকে উদ্বুদ্ধ করেছিল, অনোয়ার পারভেজের সুরে সেই জাগরণমূলক গান, ‘জয় বাংলা বাংলার জয়/ হবে হবে হবে হবে নিশ্চয়/ কোটি প্রাণ একসাথে মিলেছে অন্ধরাতে/ নতুন সূর্য ওঠার এই তো সময়।’

গাজী মাজহারুল আনোয়ার
ছবি: কোলাজ

কিংবদন্তি বরেণ্য গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার। কিংবদন্তিদের মৃত্যু নেই। তাঁরা চির অমর। আপনি জন্ম নিয়েছিলেন বলেই আমাদের বাংলা গানের ভান্ডার এত সমৃদ্ধ হয়েছে। আপনার গান লেখা শুনে ও পড়ে আমরা জানতে চেষ্টা করে যাচ্ছি গান লেখার কৌশল। আপনাকে অনুসরণ করে, আপনার দেখানো পথ ধরে হাঁটছি আমরা।
আজ আপনার জন্মদিন। শুভ জন্মদিন হে বরেণ্য। যেখানেই থাকুন, শান্তিতে থাকুন।