১০ হাত দূরে কোল্ডপ্লে !

সন্ধ্যা ৭টায় কনসার্ট শুরু হলেও আমরা কনসার্টের ভেন্যু ব্যাংককের রাজামঙ্গলা স্টেডিয়ামে পৌঁছালাম সকাল ৯টায়
মানিক–রতন

সেই কিশোরকালে ব্যাকস্ট্রিট বয়েজ, ওয়েস্টলাইফের মতো বয় ব্যান্ডের পপ সংগীত দিয়ে ইংরেজি গান শোনা শুরু। স্কুল পেরোতেই ফরিদপুরের যে পাড়ায় থাকতাম, সেই পাড়ার প্রতিবেশী এক বড় ভাইয়ের কাছ থেকেই প্রথম পরিচয় ঘটে কোল্ডপ্লের গানের সঙ্গে। প্রথম শুনেছিলাম ওদের ‘ইন মাই প্লেস’।
বলছি প্রায় ২২ বছর আগের কথা। তখন সবে ব্রিটিশ এই ব্যান্ড ইন্ডি ঘরানার সংগীতের শ্রোতামহলে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। ওদিকে আমাদের গানের স্বাদেও ব্যাপক পরিবর্তন ঘটাল কোল্ডপ্লে। মহাভক্ত হয়ে গেলাম ক্রিস মার্টিনের কণ্ঠের, কোল্ডপ্লের লিরিকের আর অল্টারনেটিভ রক মিউজিকের।
এরপর ওদের ‘দ্য সায়েন্টিস্ট’, ‘ওয়ার্নিং সাইন’, ‘ইয়েলো’, ‘শিভার’, ‘ফিক্স ইউ’, ‘ভিভা লা ভিদা’ শুনতে শুনতেই মনস্থির করে ফেললাম যে জীবনে একবার হলেও স্কোল্ডপ্লেকে স্বচক্ষে গান গাইতে দেখব। কিন্তু ওদের কনসার্টগুলো ইউরোপ, আমেরিকার বাইরে খুব একটা হতোই না।
ব্যত্যয় ঘটলো ২০১৭ সালে। কোল্ডপ্লে প্রথমবারের মতো আসছে দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ায়! সেবার অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে টিকিট করেই ফেললাম সিঙ্গাপুরের শোয়ের। ঢাকা থেকে উড়াল দিলাম কনসার্ট দেখতে। এমন জমকালো আয়োজন আর কোল্ডপ্লের মন্ত্রমুগ্ধ করা গান শুনতে শুনতে আবার মনস্থির করে ফেললাম, আরও একবারের জন্য হলেও স্বচক্ষে ওদের গান গাইতে দেখতে যেতে হবে।

সন্ধ্যা ৭টায় কনসার্ট শুরু হলেও আমরা কনসার্টের ভেন্যু ব্যাংককের রাজামঙ্গলা স্টেডিয়ামে পৌঁছালাম সকাল ৯টায়। সিঙ্গাপুরের অভিজ্ঞতা থেকেই পরিকল্পনা করেছিলাম, যত জলদি যাব, লাইনের শুরুতে থাকার সম্ভাবনা তত বেশি।

ছয় বছর পর আবার সুযোগ এসে গেল। ২০২৩ সালে ঘোষণা হলো, আবারও এশিয়ায় কনসার্ট হবে। অন্য দেশের পাশাপাশি বাংলাদেশের কোল্ডপ্লে–ভক্তদের মধ্যেও ব্যাপক উত্তেজনা শুরু হয়ে গেল। ব্যাংককের কনসার্টের টিকেট মাত্র এক দিনেই শেষ! টিকিট করে ফেললাম এক সুযোগেই। কর্মসূত্রে থাকি ব্যাংককেই। এমন সুযোগ, কষ্ট করে দূরের দেশে উড়ালও দিতে হবে না। ওদিকে ভক্তমহলের সাড়া দেখে আরেক দিন বাড়ানো হলো এখানকার আয়োজন। মুহূর্তেই সেটার টিকিটও বিক্রি হয়ে গেল।
৩ ফেব্রুয়ারি ছিল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। দলে দলে ভারত, ইন্দোনেশিয়া, চীন, ফিলিপাইনের পাশাপাশি শত শত বাংলাদেশি ভক্তও উড়ে এলেন থাইল্যান্ডে।
সন্ধ্যা ৭টায় কনসার্ট শুরু হলেও আমরা কনসার্টের ভেন্যু ব্যাংককের রাজামঙ্গলা স্টেডিয়ামে পৌঁছালাম সকাল ৯টায়। সিঙ্গাপুরের অভিজ্ঞতা থেকেই পরিকল্পনা করেছিলাম, যত জলদি যাব, লাইনের শুরুতে থাকার সম্ভাবনা তত বেশি। গিয়ে দেখি, ততক্ষণে চীন থেকে আসা দর্শকের ভিড় লেগে গেছে। কিন্তু কোল্ডপ্লে নিয়ে ওদের পাগলামি যেন একটু বেশিই! নিজ দেশ থেকে ওরা কেউ কোল্ডপ্লের ব্যাজ, কেউ স্টিকার, কেউ পোস্টার, অস্থায়ী উল্কি ইত্যাদি বানিয়ে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন আর সবার ভেতর বিনা মূল্যে বিলাচ্ছেন। কী অদ্ভুত এক পরিবেশ! নানা দেশের নানা মানুষ, অথচ কত যেন পরিচিত সবাই।

সময় পেরিয়ে ঘড়িতে ৫টা বাজতেই আমরা ঢোকা শুরু করলাম অনুষ্ঠানস্থলে। সবার হাতে ধরিয়ে দেওয়া হলো পুনর্ব্যবহারযোগ্য এলইডি রিস্ট ব্যান্ড, যা গানের তালে তালে নানা রঙে জ্বলবে, নিভবে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, আদতে প্লাস্টিকের হলেও এই রিস্ট ব্যান্ড জীবাণুবিয়োজ্য। মানে সহজেই মাটিতে মিশে যায়।
দীর্ঘ ৮ ঘণ্টা ধরে ব্যাংককের ‘বিখ্যাত’ গরমে স্টেডিয়ামে ঢোকার অপেক্ষাটা কিন্তু আমাদের বিফলে যায়নি। মঞ্চের একদম সামনের সারিতে দাঁড়ানোর সুযোগ পেয়ে গেলাম।

দীর্ঘ ৮ ঘণ্টা ধরে ব্যাংককের ‘বিখ্যাত’ গরমে স্টেডিয়ামে ঢোকার অপেক্ষাটা কিন্তু আমাদের বিফলে যায়নি
মানিক–রতন

কনসার্ট শুরু হতে হতে জানতে পারলাম, ওদের টিকিটের লভ্যাংশের একটা বড় পরিমাণ ব্যয় হয় পরিবেশ রক্ষার আইনি লড়াইয়ে, সমুদ্রদূষণ বন্ধে আর বৃক্ষরোপণে। প্রকৃতির ক্ষতি হয় এমন কোনো কিছুই প্রায় ব্যবহার হয় না এই অনুষ্ঠানে। প্লাস্টিকের ব্যবহার কমাতে বারবার ব্যবহারযোগ্য পানির বোতল আনতে উৎসাহিত করা হয় সবাইকে। কাগজের গ্লাসে বিনামূল্যে খাবার পানি বিলানো হয়। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, অনুষ্ঠানের বিদ্যুৎ চাহিদার কিছুটা মেটাতে দর্শকসারিতে রাখা হয় গতিশক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ড্যান্স ফ্লোর আর অনেকগুলো বাইসাইকেল। কনসার্ট চলাকালে ড্যান্স ফ্লোরে দর্শকেরা নাচলে আর একদল দর্শক সাইকেলের প্যাডেল ঘোরালেই উৎপন্ন হবে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ। ক্ষতিকর জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমাতে, পরিবেশ রক্ষায় কতই না চেষ্টা কোল্ডপ্লের সদস্যদের।

সন্ধ্যা ৭টায় অনুষ্ঠান শুরু হয় থাই গায়িকা ভালেন্তিনা প্লয়ের গান দিয়ে। কোল্ডপ্লে যখন মঞ্চে ওঠে, তখন ঘড়িতে বাজে ৮টা। তখন থেকেই টানা আড়াই ঘণ্টা গানের তালে মাতোয়ারা করে রাখেন ক্রিস মার্টিন, গিটারে জনি বাকল্যান্ড আর গাই বেরিম্যান, ড্রামে উইল চ্যাম্পিয়ন
১০ হাত দূরে কোল্ডপ্লে
মানিক–রতন

সন্ধ্যা ৭টায় অনুষ্ঠান শুরু হয় থাই গায়িকা ভালেন্তিনা প্লয়ের গান দিয়ে। কোল্ডপ্লে যখন মঞ্চে ওঠে, তখন ঘড়িতে বাজে ৮টা। তখন থেকেই টানা আড়াই ঘণ্টা গানের তালে মাতোয়ারা করে রাখেন ক্রিস মার্টিন, গিটারে জনি বাকল্যান্ড আর গাই বেরিম্যান, ড্রামে উইল চ্যাম্পিয়ন। এমনকি ‘মাই ইউনিভার্স’ দ্বৈত গানে ডিজিটালভাবে যুক্ত হলেন কোরিয়ান ব্যান্ড বিটিএসের গায়কেরাও। সঙ্গে ৬০ হাজার দর্শকের গলা মিলে গানে গানে পুরো স্টেডিয়াম যেন প্রকম্পিত হচ্ছিল বারবার।
এভাবেই মঞ্চের মাত্র ১০ হাত দূরে দাঁড়িয়ে কোল্ডপ্লেকে গাইতে দেখলাম শ্রোতাপ্রিয় ২৭টা গান। আর গানে গানে তারা ছড়িয়ে দিতে থাকে মানবতার বার্তা। সঙ্গে দর্শকের হাতের এলইডি রিস্ট ব্যান্ডে গানের তালে ঝলমল করা পুরো স্টেডিয়াম যেন আমাদের নিয়ে গেল অন্য এক মহাজগতে।
আর তখনই আবারও মনস্থির করে ফেললাম, আরও একটাবারের জন্য হলেও স্বচক্ষে গাইতে দেখতে হবে কোল্ডপ্লেকে।