ঠুস, হুঁশ, ফুস, ভুশ—এসব শব্দ তাঁরা খুঁজে পাননি...
বাংলা সাহিত্যের সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক। কাব্য, গদ্য, নাটক, গল্প-উপন্যাস, চিত্রনাট্য, গান—লেখালেখির সব শাখায় শক্তিশালী লেখনী তাঁর। আজ তাঁর চিরবিদায়ের দিন। ২০১৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর তিনি মারা যান। জীবনকালে তাঁকে স্মরণ করে তাঁর লেখা গানে কাজ করার অনুভূতি লিখেছেন এন্ড্রু কিশোর। আজ সৈয়দ হকের মৃত্যুদিনে সেই লেখাটি আবার প্রকাশিত হলো।
সৈয়দ শামসুল হক, সবার প্রিয় হক ভাই, আমার কাছে তিনি সাধারণ কোনো কবি-সাহিত্যিক নন, তিনি অনেক কিছুর ঊর্ধ্বে একজন। তাঁর প্রতি আমার সম্মান ও শ্রদ্ধার জায়গাটা কাজ করত অন্য রকমভাবে। তাঁর গাওয়ানো কয়েকটি গান করা ছাড়া তাঁর সঙ্গে আমার কোনো স্মৃতি নেই। আমি তাঁর সঙ্গে দেখা যে করব, সেই সাহসও দেখালাম না। এটা একেবারে শ্রদ্ধার জায়গা থেকে।
হক ভাইয়ের লেখা প্রথম গান গাওয়ার সুযোগটা হয় ১৯৮২ সালে। ‘বড় ভালো লোক ছিল’ সিনেমায় সেই গানটি হচ্ছে ‘হায় রে মানুষ রঙিন ফানুস দম ফুরাইলে ঠুস’। আলম খান ভাইয়ের সুর করা এই গানটির রেকর্ড করি শ্রুতি স্টুডিওতে। গানটি গাওয়ার সময় হক ভাইয়ের সঙ্গে আমার সেভাবে কোনো পরিচয়ও ছিল না।
এই গানটা আমার জীবনের একটি অবিস্মরণীয় গান। এই গানের জন্য আমি প্রথমবারের মতো জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাই ১৯৮২ সালে। হক ভাই তখন গান লিখতেন না।
সৈয়দ শামসুল হক সক্রিয়ভাবে জড়ালেন সাহিত্যকর্মে, কিন্তু তাঁর আগ্রহ উপচে পড়ল আরও নানা শিল্পমাধ্যমে। চলচ্চিত্র, গান, শিল্পকলায়। ১৯৫১ সালে বাড়ি থেকে পালিয়ে চলে গিয়েছিলেন চলচ্চিত্র-নগরী বোম্বেতে। ভিড়ে গিয়েছিলেন চলচ্চিত্রকার কামাল আমরোহির নির্মাতা দলের তরুণ সদস্য হয়ে। দেশে ফিরেও এলেন ১৯৫২ সালে। আরও কিছু পরে, ঢাকার চলচ্চিত্রের উন্মেষের যুগে, হয়ে পড়লেন এক স্বপ্নদলের সঙ্গী। ‘মাটির পাহাড়’ নামে একটি ছবি হবে—তার গান লিখলেন শামসুর রাহমান, সংগীত পরিচালনায় সমর দাশ, আর চিত্রনাট্য লিখলেন সৈয়দ হক। এরপর জড়িয়ে থাকলেন আরও কত ছবির কাহিনি, চিত্রনাট্য আর গান রচনায়।
এই সিনেমার প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ‘শাওন সাগর’ সে সময় বেশ নামকরা ছিল। তাদের বেশির ভাগ ছবিতে নান্দনিকতাও ছিল। এই সিনেমার পরিচালক মহিউদ্দিন সাহেব একজন অধ্যাপক ছিলেন। সবাই তাঁকে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করত।
জীবনের প্রথম গানটি সৈয়দ হক লিখেছিলেন ফরাশগঞ্জে একটি বাড়ির চিলেকোঠায় বসে ১৯৬১ সালে। গানের শেষ অংশটুকুতে কণ্ঠ দিয়েছিলেন কাজী আনোয়ার হোসেন। ওই চিলেকোঠায় বসেই তিনি ‘সুতরাং’ ছবির গান লিখেছিলেন। পরে সবগুলো গানই দর্শকনন্দিত হয়েছে। সিনেমার জন্য গান রচনার বিষয়ে তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘আমি কখনো গান লিখতে চাইনি। প্রথম গান লিখতে হয়েছিল প্রোডাকশনের খরচ বাঁচাতে এবং সুরকার সত্য সাহাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। সে গল্প আমি আগেও করেছি। সত্যিকার অর্থে একজন লিখছেন, একজন সুর করছেন, এটা আমার পছন্দ নয়। এতে সুর ও কথার বিচ্যুতি ঘটে। একজনই এই দুটো কাজ করলে অসাধারণ কিছু সৃষ্টি হয় বলেই আমার বিশ্বাস। এ কারণে আমি গানটা লিখেছি বটে, কিন্তু মন কখনো সায় দেয়নি।’
বয়স অনেক হয়ে যাওয়ায় তাঁকে দিয়ে একটা সিনেমা বানানোর পরিকল্পনা করা হলো। যেটা দিয়ে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়া যাবে, যাতে শেষ বয়সে উনি পুরস্কার ও সম্মান পান। আর সত্যি সত্যি অনেক পুরস্কারও পেয়েছিল এই ছবি। সে হিসেবে হক ভাইকে গান লিখতে দেওয়া হয়েছিল।
আমার এখনো মনে আছে, আমি তখন আলম ভাইয়ের বাসায় বসে আছি, হঠাৎ এই গানটি নিয়ে উপস্থিত হলেন হক ভাই।
সুভাষ দত্তের ‘সুতরাং’ ছবির সবগুলো গানই ছিল সৈয়দ হকের লেখা। একই পরিচালকের ‘আয়না ও অবশিষ্ট’র জন্যও তিনি ১৯৬৭ সালে ‘যার ছায়া পড়েছে মনেরও আয়নাতে’ গানটি লিখেছিলেন। সত্য সাহার সুরে গানটি গেয়েছিলেন ফেরদৌসী রহমান। বর্তমান প্রজন্মের কাছেও গানটি ভীষণ জনপ্রিয়। ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত ‘ময়নামতি’ ছায়াছবির জন্য ‘ফুলের মালা পরিয়ে দিলে আমায় আপন হাতে’ শিরোনামে গান লেখেন সৈয়দ হক। গানটির সুর দিয়েছিলেন শিল্পী বশির আহমেদ। কণ্ঠ দিয়েছিলেন জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী সাবিনা ইয়াসমীন।
গানটি দিয়ে বললেন, ‘আলম সাহেব গান তো লিখতে বলেছেন। কিন্তু গান তো লিখি না আমি। লিখতে চাইও না। কারণ, যা–ই লিখতে যাই তা রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, লালন লিখে শেষ করে ফেলেছেন! আর যদি নতুন কিছু না দিতে পারি, তাহলে তো লিখে লাভ নেই। আমি অনেক চিন্তা করে একটা ছোট্ট জিনিস লিখে এনেছি, জানি না এটা আপনার কেমন লাগবে। তবে মনে হয়, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল—কেউই এই শব্দগুলো তাঁদের গানে ব্যবহার করেননি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, যদি গানটা পুরোপুরি শেষ করতে পারি, তাহলে এই গানের জন্য জাতীয় পুরস্কার দিতে বাধ্য।
কামাল আহমেদ পরিচালিত ১৯৬৯ সালে ‘অবাঞ্ছিত’ সিনেমার জন্য ‘কেহ করে বেচাকেনা কেহ কান্দে’ গানটি রচনা করেছিলেন সৈয়দ হক। সুর করেছিলেন আলী হোসেন। কণ্ঠ দিয়েছিলেন শিল্পী আব্দুল আলীম। মোহাম্মদ মহিউদ্দিন পরিচালিত ১৯৮২ সালে মুক্তি পায় ‘বড় ভালো লোক ছিলো’। সিনেমাটির চিত্রনাট্য ও সংলাপের সঙ্গে সবগুলো গান লিখেছিলেন সৈয়দ হক। এই ছবির ‘তোরা দেখ তোরা দেখ দেখরে চাহিয়া’ গানটি শ্রোতাপ্রিয় হয়। একই ছবিতে আলম খানের সুরে এন্ড্রু কিশোরের গাওয়া ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস দম ফুরাইলে ঠুস’ সকল শ্রেণির শ্রোতার মুখে মুখে আজও গানটি শোনা যায়।
কারণ, এ ধরনের গানের কথা আগে হয়নি। আপনি যদি আমার চাওয়ামতো সুর করতে পারেন, তাহলে আপনিও পুরস্কার পাবেন। আর আপনি যাঁকে দিয়ে গাওয়াবেন, তাঁর শতভাগ লাগবে না, যদি মোটামুটিও গাইতে পারে, তাহলে সেও জাতীয় পুরস্কার পাবে নিশ্চিত।’
অবাক করা বিষয় হলো, গানটি গাওয়ার পর শামসুল হক ভাইয়ের সব কথা সত্যি ফলে গিয়েছিল। গানটা রিলিজের পর আমি কলকাতা ও মুম্বাই গিয়েছিলাম। সেখানে যখন বিখ্যাত গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় ও গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হলো, দুজনই আমাকে একই প্রশ্ন করেছিলেন।
এ জে মিন্টু পরিচালিত ১৯৮৩ সালে ‘মানসম্মান’ ছবির জন্য সৈয়দ হকের লেখা ‘কারে বলে ভালবাসা কারে বলে প্রেম’ গানটিও ব্যাপক শ্রোতাপ্রিয় হয়। আলম খানের সুরে গানটি গেয়েছেন এন্ড্রু কিশোর। তজিম উদ্দীন রিজভী পরিচালিত ১৯৮৩ সালে ‘আশীর্বাদ’ ছবির জন্য তাঁর লেখা আরেকটি গান ‘চাঁদের সাথে আমি দেব না তোমার তুলনা’। আলম খানের সুরে রুনা লায়লা ও এন্ড্রু কিশোরের গাওয়া এই গানটিকে ভাবা হয় দেশীয় চলচ্চিত্রের সেরা ১০টি প্রেমের গানের একটি। ২০১৬ সালে সৈয়দ হক ‘মাটির ঘরে চাঁদ নেমেছে’ শিরোনামে একটি গান লিখেছিলেন ‘বাসর হবে মাটির ঘরে’ ছবির জন্য। আলাউদ্দীন আলীর সুর-সংগীতে গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছেন রুনা লায়লা ও সুবীর নন্দী। গানটির সুর ও সংগীত পরিচালনা করেছেন বরেণ্য সংগীত পরিচালক আলাউদ্দীন আলী।
তাঁদের কথা হলো, তাঁরা দুই গীতিকার আধুনিক গান নিয়ে এত গবেষণা করেছেন, তবু গানে ঠুস, হুঁশ, ফুস, ভুশ—এসব শব্দ তাঁরা খুঁজে পাননি এবং যাঁদের বাংলা সাহিত্যের দিকপাল ভাবা হয়, তাঁরাও এসব শব্দের ব্যবহার করেননি। ‘তো, এই গীতিকার ছেলেটি কে?’ প্রশ্ন করলেন। আমি হেসে বললাম, ‘ছেলেটা না, উনি একজন ভদ্রলোক। আমাদের দেশের প্রখ্যাত সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক।’
শ্রুতি রেকডিং স্টুডিওতে গানটা রেকর্ড করা হয়। গানটা গুরুত্বপূর্ণ এটা ঠিকই ভেবেছি, কিন্তু এতটা আলোড়ন তুলবে তা চিন্তা করিনি। আমাকে দিয়ে যে গানটা গাওয়ানো হবে, এটাও জানতাম না। এরপর হক ভাইয়ের লেখা আরও তিনটি গান গাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। শেষ যে গানটি গেয়েছিলাম তা হচ্ছে, ‘চাঁদের সাথে আমি দেব না তোমার তুলনা।’
২০১৪ সালে স্বাধীনতার ৪২তম বাষির্কী উদ্যাপন উপলক্ষে সিদ্ধান্ত হয় লাখো কণ্ঠে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ জাতীয় সংগীত পরিবেশনের। এই ঐতিহাসিক আয়োজনেও অসুস্থ অবস্থায় সৈয়দ হক দায়িত্ব নিয়ে রচনা করেন থিম সঙ ‘বাঙালির জয়! জয় বাংলার ধ্বনিতে একাত্তর’। থিম সঙের সুর ও সংগীত পরিচালনা করেন বাপ্পা মুজমদার। কণ্ঠ দিয়েছেন সাবিনা ইসয়াসমীন, সুবীর নন্দী, এন্ড্রু কিশোর, সামিনা চৌধুরী, মমতাজ, এলিটা, বাপ্পা মুজমদার, কনা ও কোনাল।
পরিশেষে বলতে চাই, হক ভাইকে শতকোটি সালাম ও প্রণাম। আমার একটা অদৃশ্য চাওয়া হচ্ছে—তিনি যদি আমাদের আরও কয়েকটা গান দিয়ে যান, তাহলে আমরা নিজেদের আরও কিছু ভালো কাজের অংশ মনে করতে পারতাম।