গানে দেশপ্রেম, প্রেম আর বেদনার ভাষা বদলে দিয়েছিলেন যিনি
বাংলা গানের ইতিহাসে অনেক সুরকার এসেছেন, পেয়েছেন জনপ্রিয়তা, থেকেছেন সময়ের শীর্ষে। কিন্তু খুব কম মানুষই আছেন, যাঁরা পুরো সময়কে নিজের সুরে রাঙিয়ে গেছেন। আলাউদ্দিন আলী তেমনই একজন। তিনি শুধু সফল সুরকার নন, তিনি একটি ধারার প্রচলন করেছেন, বাংলা চলচ্চিত্রগানের ভাষা বদলে দেওয়া এক সুরকার ও সংগীত পরিচালক—এই জায়গাটিতেই তিনি আলাদা।
১৯৫২ সালের ২৪ ডিসেম্বর মুন্সিগঞ্জের টঙ্গিবাড়ী উপজেলার বাঁশবাড়ি গ্রামে জন্ম আলাউদ্দিন আলীর। সংগীত ছিল তাঁর উত্তরাধিকার। বাবা ওস্তাদ জাদব আলী, মা জোহরা খাতুন—সংগীতের আবহেই বেড়ে ওঠা তাঁর। আত্মীয়স্বজনের বড় একটি অংশও ছিলেন সংগীতের সঙ্গে যুক্ত। ফলে শৈশব থেকেই সুর, তাল ও লয়ের সঙ্গে ছিল তাঁর নিবিড় সম্পর্ক। পরিবারের গুণীজনদের কাছেই উচ্চাঙ্গসংগীতে হাতেখড়ি। সেই তালিমকে নিজের অসাধারণ মেধা ও অধ্যবসায়ের মাধ্যমে আত্মস্থ করেন তিনি।
আলাউদ্দিন আলীর সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য ছিল—তিনি চলচ্চিত্রের গানকে কখনোই ‘সহযোগী শিল্প’ হিসেবে দেখেননি। তাঁর কাছে গান ছিল স্বাধীন, স্বয়ংসম্পূর্ণ এক শিল্পমাধ্যম। সিনেমার দৃশ্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গান তৈরি করলেও, সেই গান দৃশ্য ছাড়াও শ্রোতার হৃদয়ে টিকে থাকার শক্তি রাখত। এ কারণেই তাঁর সুর করা গানগুলো চলচ্চিত্র পেরিয়ে হয়ে উঠেছে আলাদা শিল্পকর্ম।
আলাউদ্দিন আলী এমন এক সময় বাংলা চলচ্চিত্রে কাজ করেছেন, যখন গান ছিল ব্যবসার বড় হাতিয়ার। কিন্তু আলাউদ্দিন আলী সেই বাণিজ্যিক কাঠামোর ভেতর থেকেও সুরে এনে দিয়েছেন গভীরতা ও পরিমিতিবোধ। উচ্চাঙ্গসংগীত ও লোকসংগীতের উপাদানকে আধুনিক সংগীতভাবনার সঙ্গে মিশিয়ে তিনি তৈরি করেছেন নিজস্ব ঘরানা—যা একবার শুনলেই আলাদা করে চেনা যায়।
দেশপ্রেমের গানে আলাউদ্দিন আলীর আলাদা পরিচয় আছে। ‘ও আমার বাংলা মা তোর আকুল করা রূপের সুধায়’ বা ‘সূর্যোদয়ে তুমি সূর্যাস্তেও তুমি’ বা ‘প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ’—এই গানগুলো কেবল দেশাত্মবোধক নয়, এগুলো অনুভূতির গান। এখানে দেশ মানে শুধু ভূগোল নয়, দেশ মানে মা, প্রকৃতি, স্মৃতি ও আত্মপরিচয়ের ব্যাপারগুলো ফুটে ওঠেছে।
বেদনার গানে আলাউদ্দিন আলী ছিলেন আরও অনন্য। ‘আমায় গেঁথে দাও না মাগো একটা পলাশ ফুলের মালা’—এই গান কেবল শোকের প্রকাশ নয়, এটি এক জাতিগত ক্ষতবোধকে গানে গানে উপস্থাপন। আলাউদ্দিন আলী এমন সুর তৈরি করতেন, যেখানে কান্না নেই, কিন্তু বুক ভার হয়ে আসে। এসবই তাঁকে আলাদা করেছে।
প্রেমের গানেও আলাউদ্দিন আলীর আলাদা ভাষা ছিল। ‘যেটুকু সময় তুমি থাকো কাছে’, ‘একবার যদি কেউ ভালোবাসত’, ‘যে ছিল দৃষ্টির সীমানায়’—এই গানগুলোতে প্রেম কখনো অতিনাটকীয় নয়, বরং ব্যক্তিগত ও সংবেদনশীল। তিনি প্রেমকে দেখেছেন অনুভবের জায়গা থেকে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো—আলাউদ্দিন আলী ছিলেন শিল্পী-নির্মাতা। তিনি শুধু প্রতিষ্ঠিত কণ্ঠেই আটকে থাকেননি। কনকচাঁপা, মাকসুদ, মিতালী মুখার্জী, কুমার বিশ্বজিৎ, সামিনা চৌধুরী, তপন চৌধুরী, আইয়ুব বাচ্চু, হাসান—এমন বহু শিল্পীর চলচ্চিত্রের গানের যাত্রা তাঁর সুরেই শুরু হয়েছে। নতুন কণ্ঠকে বিশ্বাস করার সাহস ও দূরদৃষ্টি তাঁর মধ্যে ছিল।
প্রায় পাঁচ হাজার গানের সুর তৈরি করেছেন আলাউদ্দিন আলী—চলচ্চিত্র, বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনের জন্য। কিন্তু সংখ্যার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো মান। তাঁর গানগুলো সময়ের সঙ্গে পুরোনো হয়নি। আজও নতুন প্রজন্মের শ্রোতা তাঁর গান শুনে আবেগ অনুভব করে—এটাই তাঁর শিল্পের সবচেয়ে বড় প্রমাণ।
‘এই দুনিয়া এখন তো আর সেই দুনিয়া নাই’, ‘আছেন আমার মোক্তার আছেন আমার ব্যারিস্টার’, ‘আমায় গেঁথে দাও না মাগো একটা পলাশ ফুলের মালা’, ‘প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ’, ‘শত জনমের স্বপ্ন তুমি আমার জীবনে এলে’, ‘কী করে বলিব আমি আমার মনে বড় জ্বালা’, ‘ভালোবাসা যত বড় জীবন তত বড় নয়’, ‘চোখের নজর এমনি কইরা’, ‘যেটুকু সময় তুমি থাকো কাছে মনে হয় এ দেহে প্রাণ আছে’, ‘যে ছিল দৃষ্টির সীমানায়’, ‘একবার যদি কেউ ভালোবাসত’, ‘সূর্যোদয়ে তুমি সূর্যাস্তেও তুমি’, ‘বন্ধু তিন দিন তোর বাড়িত গেলাম’, ‘জন্ম থেকে জ্বলছি মাগো’, ‘সুখে থাকো ও আমার নন্দিনী হয়ে কারও ঘরনি’, ‘একা একা কেন ভালো লাগে না’—এই গানগুলো সুরস্রষ্টা আলাউদ্দিন আলীকে অনন্য উচ্চতায় আসীন করেছে।
গাজী মাজহারুল আনোয়ার একবার বলেছিলেন, ‘আলাউদ্দিন আলী এত এত ভালো গান সুর করেছেন, নাম বলতে গেলেই কিছুদিন হারিয়ে যাবে। বাংলা চলচ্চিত্রের গান বলতেই একটা সময় উনি। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন সংগীত পরিচালক হিসেবে একাধিকবার। পেয়েছেন গীতিকার হয়ে। তাঁর ভাষায় বলতে গেলে, আশাজি, লতাজি ছাড়া এমন কোনো শিল্পী নেই, এ উপমহাদেশে যে আমার গান গায়নি।’ সাবিনা ইয়াসমীনের ভাষায়, ‘ভারতীয় উপমহাদেশের একজন শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালক আলাউদ্দিন আলী। তাঁরা যুগে যুগে আসেন না। এলে হয়তো এত দিনে চোখে পড়ত, জানতে পারতাম।’
আলাউদ্দিন আলী তেমনই একজন সুরশিল্পী, যিনি সুরের রং দিয়ে অন্তরের বিমূর্ত ভাবনাগুলোকে মূর্ত করে তুলতে পারতেন—এমনটা মনে করেন সৈয়দ আবদুল হাদী। তিনি বলেছিলেন, ‘ও আমার বাংলা মা তোর আকুল করা রূপের সুধায়’ বা ‘সূর্যোদয়ে তুমি সূর্যাস্তেও তুমি’ গানের মধ্যে স্বদেশ-প্রকৃতির প্রতি যে বিমুগ্ধতা-তন্ময়তা অথবা ‘আমায় গেঁথে দাও না মাগো’ গানের মধ্যে যে স্বজন হারানোর বেদনাবোধ, তা যেন সুরের রংতুলিতে আঁকা একেকটি ছবি। বাংলা দেশপ্রেমের গানের ভান্ডারে এসব গান ভাস্বর হয়ে থাকবে।
পুরো সত্তর দশক তিনি মাতিয়ে রেখেছিলেন তাঁর সম্মোহনী সুরের মায়াজালে। মৃত্যুর আগপর্যন্ত কাজ করেছেন, সেই মায়াজালে শ্রোতাদের বন্দী করে রেখেছিলেন তিনি। তাঁর এ সাফল্যের পেছনে ছিল তাঁর অধ্যবসায়, শ্রম ও মেধা। শিল্পী ও শ্রোতাদের মতে, তিনি বেঁচে থাকবেন তাঁর সুরের মায়াজালে মুগ্ধ সংগীতপ্রেমীর অন্তরে চিরকাল।
সংগীত পরিবার থেকে এসেছেন আলাউদ্দিন আলী। তাঁর আত্মীয়স্বজনও ছিলেন সংগীত পরিবারের। ফলে এক সংগীত আবহে বেড়ে উঠেছিলেন তিনি। উচ্চাঙ্গসংগীতে তালিম নিয়েছেন পরিবারেরই গুণীজনদের কাছে। সেই তালিমকে তাঁর অসাধারণ মেধা দিয়ে আত্মস্থ করেছেন। সেই সঙ্গে দেশ-বিদেশের বৃহত্তর সংগীতজগতের সঙ্গেও পরিচিত হয়েছেন, নিজেকে ঋদ্ধ করেছেন। কিশোর বয়স থেকেই বেহালা বাজাতেন ঢাকা অর্কেস্ট্রাতে। এই সুবাদেই তিনি সে সময়ের বিখ্যাত সংগীত পরিচালক সুবল দাস, আলী হোসেন, শহীদ আলতাফ মাহমুদ, খান আতাউর রহমান, খন্দকার নুরুল আলম, সত্য সাহা, আনোয়ার পারভেজের মতো গুণীদের সংস্পর্শে এসেছেন, খুব কাছ থেকে দেখেছেন, শিখেছেনও। আনোয়ার পারভেজের সঙ্গে তিনি সহকারী হিসেবেও কাজ করেছেন।
আলাউদ্দিন আলীর শুরুটা হয়েছিল ব্যর্থতার মধ্য দিয়ে। তিনি চলচ্চিত্রে প্রথম কাজ করেন ১৯৭৪ সালে। মীর মোহাম্মদ হালিম পরিচালিত ওই ছবির নাম ‘সন্ধিক্ষণ’, মুক্তি পায় ১৯৭৬ সালে। কিন্তু না, সাফল্যের জন্য তাঁকে দুই বছর অপেক্ষা করতে হয়। ১৯৭৮ সাল, আমজাদ হোসেন তৈরি করেন ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’। এই ছবির জন্য আলাউদ্দিন আলী তৈরি করেন ‘আছেন আমার মোক্তার’ শিরোনামে একটি গান। গানটির গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার আর কণ্ঠ দেন সৈয়দ আব্দুল হাদী। গানটি চুম্বকের মতো কাজ করে ওই সময়। শ্রোতারা অবাক হয়ে শোনেন গানটি। একই ছবির আরেকটি গান তখন দারুণ জনপ্রিয়তা পায়, ‘হায় রে কপাল মন্দ, চোখ থাকিতে অন্ধ’। এই গানের গীতিকারও আমজাদ হোসেন। দুটি গানই আলাউদ্দিন আলীকে নিয়ে যায় অন্য জায়গায়।
একই বছর মুক্তি পায় ‘ফকির মজনু শাহ’ নামের আরেকটি ছবি। এই ছবির ‘প্রেমের আগুনে’, ‘সবাই বলে বয়স বাড়ে’ আর ‘চোখের নজর এমনি কইরা’ গানগুলো আলাউদ্দিন আলীর ব্যাপারে সবাইকে আগ্রহী করে তোলে। প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আলাউদ্দিন আলী বলেছিলেন, ‘প্রথম ছবির সংগীত পরিচালনার পর দর্শকের সাড়া খুব একটা ভালো ছিল না। ছবিটি ব্যবসায়িক দিক থেকে তেমন সুবিধা করতে পারেনি। তাতে দুঃখ পাইনি। কিন্তু “গোলাপী এখন ট্রেনে” ছবির মাধ্যমেই আমি যেন সাফল্যের ট্রেনে চড়ে বসি। এরপর থেকে যা-ই করেছি, শ্রোতা-দর্শক আমাকে দুই হাত ভরে দিয়েছেন, আমাকে ভালোবেসেছেন।’
পিতা ওস্তাদ জাভেদ আলী ও ছোট চাচা ওস্তাদ সাদেক আলীর কাছে সংগীতের হাতেখড়ি। তিনি ছেলেবেলায় বেহালা বাজানোর জন্য অল পাকিস্তান চিলড্রেনস প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পেয়েছিলেন। আলাউদ্দিন আলীর প্রয়াত স্ত্রী নজরুলসংগীতশিল্পী সালমা সুলতানা, তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী মিমি আলাউদ্দিনও একজন আধুনিক গানের শিল্পী।
ব্যক্তিজীবনে আলাউদ্দিন আলী ছিলেন প্রচারবিমুখ। সুরই ছিল তাঁর ভাষা। দীর্ঘ রোগভোগের পর ২০২০ সালে তিনি চলে গেলেও, তাঁর সুর চলে যায়নি। কারণ, আলাউদ্দিন আলী এমন গান তৈরি করেছেন, যেগুলো সময়ের সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকে। এই কারণেই বাংলা গানের ইতিহাসে আলাউদ্দিন আলী আলাদা। তিনি শুধু গান বানাননি, তিনি একটি রুচি তৈরি করেছেন, একটি মানদণ্ড স্থাপন করেছেন। বাংলা চলচ্চিত্রের গানকে তিনি অনন্য মর্যাদায় বসিয়েছেন। আজ তাঁর জন্মদিনে তাই শুধু স্মরণ নয়, শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বীকার করতে হয়—বাংলা গানের ইতিহাসে আলাউদ্দিন আলী একটি অধ্যায় নয়, একটি ভিত্তিও।