ভাইরাল সেই ‘বাগানের মালি’, আরও অনেক গল্প বললেন সুমি

গতকাল এসেছে লালন ব্যান্ডের নতুন গান ‘বাগানের মালি’। একটি ভিডিও সাক্ষাৎকারে ব্যান্ডের ভোকালিস্ট নিগার সুলতানা সুমি গানটির দুটি লাইন ‘তোমারে ফুটাইতে গো আমার চোখের নিচে কালি/ তুমি যেই বাগানের ফুল আমি সেই বাগানের মালি’ গেয়েছিলেন। এই অংশটা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। এই গানসহ গায়িকার ক্যারিয়ার ও জীবনের জানা–অজানা গল্প শুনেছেন নাজমুল হক

নিগার সুলতানা সুমী। ছবি: শিল্পীর সৌজন্যে

বাবা ছোটবেলা থেকেই গান করতেন, তাই বাড়িতে গানের একটা পরিবেশ ছিল। তবে দেড় বছর আগে সুমি জানতে পারেন, তাঁর দাদাও বয়াতি ছিলেন। ভালো বেহালা বাজাতেন। সংগীত তাই তাঁর পরিবারেই ছিল। সুমি বলেন, ‘দাদাকে নিয়ে যতই জানছি, অবাক হচ্ছি। পরিবারের সংগীতের বীজ দাদার হাতেই হয়তো বোনা। শুনেছি, উনি বাড়ি থেকে বিভিন্ন অঞ্চলে চলে যেতেন। দাদাকে যখন খুঁজে পাওয়া যেত না, তখন দাদি বেহালার দিকে তাকিয়ে দেখতেন—যদি বেহালা না থাকত, তবে তিনি বাড়ি থেকে বেরিয়েছেন। আর যদি বেহালা থাকত, তবে দাদা আশপাশেই আছেন।’
সুমির শুরুটা শাস্ত্রীয় সংগীত দিয়ে, খুলনায় আলী আহমেদের কাছে কিছুদিন ক্ল্যাসিক্যাল শেখেন। তারপর নজরুল। তবে তাঁর লোকসংগীতের আগ্রহ ছিল বেশি, তাই অনেক ওস্তাদ ঘুরে অসীম দেবনাথের কাছে শিখতে শুরু করেন।

নিগার সুলতানা সুমী। ছবি: শিল্পীর সৌজন্যে

লালনের গানে
বাবার সঙ্গে একবার মেহেরপুরে একটি সাধুসঙ্গে গিয়েছিলেন। তখন বয়স আট কি নয়। সুমি বলেন, ‘সাধুসঙ্গ কী, তখন কিছুই বুঝতাম না। কিন্তু সেখানে গিয়ে লালন সাঁইজির বাণী শোনার পর জেদ চাপল, এই গান ছাড়া আমি অন্য কিছু গাব না।’ গুরু অসীম দেবনাথকেও এ কথা জানান। এরপর রেডিওতে অডিশনের জন্য গুরুর কাছ থেকে ২৫টি লালনের গান শেখেন সুমি। সেই থেকেই শুরু। ১৪ বছর বয়সে কুষ্টিয়ায় ফরিদা পারভীনের এক অনুষ্ঠানে প্রথমবার মঞ্চে ‘তিন পাগল’ পারফর্ম করেন সুমি। শুনে ফরিদা পারভীনও মুগ্ধ হয়েছিলেন।

পেশাদার যাত্রা
সুমির বড় ভাই ‘মন জ্বলে’ গায়ক রুপম। ভাই ও তাঁর বন্ধুদের ড্রামস ও গিটার ব্যান্ড সংগীতের প্রতি সুমির আগ্রহ তৈরি করে। রুপম ঢাকা চলে এলে খুলনার কয়েকজনকে নিয়ে ব্যান্ড গঠনের পরিকল্পনা করেন সুমি। ২০০১ সালে যাত্রা শুরু করে লালন। সুমি বলেন, ‘(সোলসের সাবেক ড্রামার) আশিক ভাইয়ের সঙ্গে কাজ শুরু করি। প্রথমে ব্যান্ডের কম্পোজিশনে লালনের গান দিয়ে শুরু করি, এরপর কিছু মৌলিক গান। প্রায় আট বা নয় মাস গান গাওয়ার পর পয়লা বৈশাখের দিন একটি কনসার্টে ব্যান্ডের নামকরণ করি।’

নিগার সুলতানা সুমী। ছবি: শিল্পীর সৌজন্যে

২০০৩ সালে ‘বেনসন অ্যান্ড হেজেস স্টার সার্চ’ প্রতিযোগিতার ফাইনাল রাউন্ডে অংশ নিতে প্রথম ঢাকায় আসেন সুমি। সেরা পারফরমার হন তিনি। তারপরও কিন্তু স্বেচ্ছাবিরতি নেন, তাঁর মনে হয়েছিল বড় ইন্ডাস্ট্রিতে ঢোকার আগে আরেকটু শিখে আসা উচিত। ২০০৬ সালে শুরু হয় প্রথম অ্যালবামের রেকর্ডিং, ২০০৭ সালে বি-প্রতীপ প্রকাশের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে লালন ব্যান্ড।

শ্রোতাদের ভালোবাসা
লালন সাঁইয়ের ১৩৫তম তিরোধান দিবস উপলক্ষে ১৮ অক্টোবর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পারফর্ম করে লালন। রাত সাড়ে ১২টায় মঞ্চে ওঠে তারা। এত রাত হয়ে যাওয়ার পরও দর্শক তো কমেইনি, বরং বেড়েছে। অনেকের হাতে ছিল লালন ব্যান্ড ও সুমিকে নিয়ে লেখা বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড। এখানেই শুধু নয়, দেশের অন্য জায়গার কনসার্টেরও একই চিত্র। দেড় দশকে ব্যান্ডটির একটি বড় ভক্তশ্রেণি তৈরি হয়েছে। সুমি বলেন, ‘এই পাগলদের কাছে সব সময় আমি ক্ষমাপ্রার্থী। তাদের ফোন কল থেকে ফেসবুকের মেসেজ আমার দেখা হয় না। ইচ্ছাকৃতভাবে নিজেকে এই সকল মাধ্যম থেকে দূরে রাখি যেন মনোযোগ কেবল গানেই থাকে।’

নিগার সুলতানা সুমী। ছবি: শিল্পীর সৌজন্যে

সুমি মনে করেন, ব্যান্ডের এই সাফল্য ও শ্রোতাদের ভালোবাসা তৈরি হওয়ার পেছনে ব্যান্ডের দলনেতা ও ড্রামার থেইন হান মং তিতির অবদান সবচেয়ে বড়। তিনি বললেন, ‘ব্যান্ড পরিচালনা থেকে কম্পোজিশন, সবকিছুই সে সামলিয়েছে। ব্যান্ডকে এই জায়গায় আনতে হলে কী করতে হবে, তাঁর মাথায় ছিল; পারফরম্যান্সের ড্রেস থেকে সমস্ত পরিকল্পনা তাঁর মাথায় ছিল। এই দেড় যুগে আমি শুধু গেয়ে গেছি; কোথায় শো, কোন হোটেল কিছুই কিন্তু আমার মাথায় ছিল না।’

সমালোচনা
দেড় যুগের এ যাত্রায় লালন ব্যান্ডকে প্রচুর সমালোচনার মুখেও পড়তে হয়েছে। লালনের গান নিয়ে ব্যান্ড সংগীত থেকে সুমির গায়কি নিয়েও অনেক লালনশিল্পী সমালোচনা করেছেন। এই সংগীতশিল্পী বলেন, ‘সমালোচনাকে সব সময় ইতিবাচক হিসেবে নিয়েছি আমরা। এত বছর পেরিয়ে এখন যখন চিন্তা করি, একজন নারী ভোকালিস্ট হিসেবে ব্যান্ড নিয়ে এত দূর এলাম! তখন অবাক হই। এই তো এক গত সপ্তাহে খেয়াল করলাম লালনের কিছু গান ভুলভাবে গাইছি। এদিনই সাধুদের উপস্থিতিতে মঞ্চে উঠে নিজের ভুল স্বীকার করি। সাঁইজির বাণী হলো, “ভুল না করলে শুদ্ধ পথ কখনোই দেখা সম্ভব না।’”

আরও পড়ুন

‘বাগানের মালি’
গত বছরের ১৮ এপ্রিল সুনামগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান কণ্ঠশিল্পী ও গীতিকার পাগল হাসান। মৃত্যুর প্রায় দেড় বছর পর পাগল হাসানের নতুন গান নিয়ে এসেছে লালন। ‘বাগানের মালি’ গানটি প্রকাশ পেয়েছে গতকাল। ‘তোমারে ফুটাইতে গো আমার চোখের নিচে কালি/ তুমি যেই বাগানের ফুল আমি সেই বাগানের মালি’—পাগল হাসান বেঁচে থাকতেই তাঁর সঙ্গে যৌথভাবে গানটি করে ব্যান্ড লালন। মজার বিষয় হচ্ছে গানটি প্রকাশের আগেই আলোচনায়! আসলে টেলিভিশনের একটি সাক্ষাৎকারে গানটির দুই লাইন গেয়েছিলেন সুমি। তাঁর কণ্ঠে এ দুই গান কয়েক মাস ধরে ফেসবুক রিলস থেকে টিকটকে ছিল ভাইরাল। গানটি প্রসঙ্গে সুমি বলেন, ‘পাগল হাসান লালন ব্যান্ডের জন্য গানটি লিখলেও আমরা তাঁকে গানটি গাওয়ারও অনুরোধ করি। আমাদের অনেক জনপ্রিয় গান তাঁর লেখা। তাঁর আত্মা শান্তি পাক।’