‘এই সুরে বহুদূরে’ চলে গেলেন বাপীদা

তাপস বাপী দাস
ফেসবুক থেকে

রোববার বিকেল চারটায় এই লেখা যখন লিখতে বসেছি, তখন কলকাতার বেহালার বাড়িতে অন্তিম যাত্রার প্রস্তুতি চলছে মহীনের ঘোড়াগুলি ব্যান্ডের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য তাপস বাপী দাসের। অন্যদিকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে সবাই জড়ো হচ্ছেন প্রিয় এই শিল্পীকে শ্রদ্ধা জানিয়ে গানমিছিলের জন্য। সবার পথই গিয়ে মিশবে গড়িয়া শ্মশানে, সেখানেই তাঁর শেষকৃত্য হবে। এই গড়িয়া শ্মশানেই ১৯৯৯ সালের ২০ জুন মহীনের ঘোড়াগুলির দলনেতা গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের শেষকৃত্য হয়েছিল। ২৪ বছর পর আবার সেই জুন মাসেই তাঁর প্রিয় সঙ্গী তাপস দাসের জীবনাবসান হলো।

আরও পড়ুন

তাপস দাস বাপী ‘বাপীদা’ নামেই পরিচিত ছিলেন বেশি। তাঁর জন্ম ১৯৫৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর কলকাতায়। তিনি বছরখানেক ফুসফুস ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করে রোববার ভারতীয় সময় সকাল সাড়ে নয়টায় কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেছেন।

ছোটবেলা থেকেই গানবাজনা ও লেখালেখির প্রতি টান। গানে বাঁধাধরা কোনো তালিম পাননি। কৈশোরেই বেহালায় পাড়ার অনুষ্ঠানে নিয়মিত গিটার বাজিয়ে গান করতেন। সত্তরের দশকের শুরুতে গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর সখ্য গড়ে ওঠে। তখনো মহীনের ঘোড়াগুলির জন্ম হয়নি।

তাপস বাপী দাস
ফেসবুক থেকে

তাঁরা সবাই একসঙ্গে আড্ডা দিতেন, বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের গান শুনতেন। দলবলসহ কলকাতার রাস্তায় বেরিয়ে পড়তেন নতুন গানের সন্ধানে। বেদে, বৃহন্নলাদের গান থেকে শুরু করে লোকাল ট্রেনের বাউলগান—সবই মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। পাশ্চাত্যের সঙ্গে বাংলার নিজস্বতাও অক্ষুণ্ন রেখে গান তৈরি করার চেষ্টা করতেন তাঁরা। এরপর নকশাল আন্দোলনে যোগ দিলেন গৌতম চট্টোপাধ্যায়। বাপীদা পরোক্ষভাবে নকশাল আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেলেন। একসময় গৌতম চট্টোপাধ্যায় ধরা পড়লেন, জেল হলো দেড় বছরের। এভাবে বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহ পেরিয়ে সাতজন সদস্য নিয়ে ১৯৭৫ সালে গঠিত হলো কলকাতার প্রথম ব্যান্ড ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’।

১৯৭৫-৮১, সক্রিয় থাকাকালীন এই ব্যান্ডের তিনটি অ্যালবাম বের হয়েছিল। অ্যালবামের অধিকাংশ গানেরই ‘কণ্ঠ’ কিংবা ‘কথায়’ মিশে ছিলেন বাপিদা। ভেসে আসে ‘কলকাতা’, ‘সংবিগ্ন পাখিকূল’, ‘হায় ভালোবাসি’, ‘সুধীজন শোনো’, ‘এই সুরে বহুদূরে’—এগুলো উল্লেখযোগ্য। গতানুগতিক সংগীতবোধের বাইরে গিয়ে সে সময় এসব গানে রাজনীতি-বিপ্লব, ভালোবাসা, দারিদ্র্য, অন্যায়-অবিচার, স্বাধীনতা—সবকিছুই এসেছে। এরপর নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি তাঁদের সম্পাদিত অ্যালবাম নিয়ে আবার ফিরে আসে এই ব্যান্ড। মূলত সেই সময়েই নতুন করে মহীনের ঘোড়াগুলি জনপ্রিয়তা লাভ করে। এরপর গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সমাপ্তি ঘটে মহীন অধ্যায়ের।

কিছুদিন আগেও চিকিৎসা চলাকালীন অবস্থাতেও নাকে টিউব লাগিয়ে কলকাতার দেশপ্রিয় পার্কের মঞ্চে হাজারো মানুষের সামনে গান গেয়েছিলেন। মৃত্যুর আগপর্যন্ত কোনো কিছুই থামাতে পারেনি সত্তরের কলকাতায় ‘নতুন দিনের গান’ আন্দোলনের অন্যতম যোদ্ধা এই তাপস দাস বাপীকে

এরপরও থেমে থাকেননি তাপস দাস বাপী। মহীনের ঘোড়াগুলির সাংগীতিক দর্শন বুকে ধারণ করে ২০০৩ সালে নতুনদের নিয়ে গঠন করেন ব্যান্ড ‘মহীন এখন ও বন্ধুরা’। অ্যালবাম প্রকাশের পাশাপাশি তাদের নিয়মিত কনসার্টেও দেখা যেত। তিনি সব সময় সক্রিয় থেকেছেন গানে-লেখায়, নতুনদের দেখিয়েছেন আলো। অর্থাভাবে চিকিৎসা বাধার সম্মুখীন হলেও হাসিমুখে ফিরিয়ে দিয়েছেন রাজনৈতিক দলগুলোর আর্থিক সাহায্য। এরপর তাঁর চিকিৎসার সব দায়িত্ব নেয় পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার।

কিছুদিন আগেও চিকিৎসা চলাকালীন অবস্থাতেও নাকে টিউব লাগিয়ে কলকাতার দেশপ্রিয় পার্কের মঞ্চে হাজারো মানুষের সামনে গান গেয়েছিলেন। মৃত্যুর আগপর্যন্ত কোনো কিছুই থামাতে পারেনি সত্তরের কলকাতায় ‘নতুন দিনের গান’ আন্দোলনের অন্যতম যোদ্ধা এই তাপস দাস বাপীকে। তিনি রেখে গেছেন স্ত্রী সুতপা ঘোষ ও আমাদের মতো দুই বাংলার অনেক অনুরাগী, অনুসারী।

লেখক: রক মিউজিক গবেষক