নজরুলের সুর বিকৃতিতে দায় কার

কাজী নজরুল ইসলামের ‘কারার ঐ লৌহ-কবাট’ গানের সুর বিকৃতিতে দায় কার?

নজরুলের গান নিয়ে বিতর্কের মধ্যে ঘুরেফিরে একটি চুক্তিপত্রের কথা সামনে আসছেছবি: কোলাজ

কাজী নজরুল ইসলামের ‘কারার ঐ লৌহ-কবাট’ গানের ‘সুর বিকৃতি’ নিয়ে সমালোচনার মধ্যে ঘুরেফিরে একটি চুক্তিপত্রের কথা সামনে আসছে। সেই চুক্তিপত্রের ওপর ভিত্তি করেই গানটিতে নতুন করে সুরারোপ করেছেন অস্কারজয়ী ভারতীয় সুরকার ও সংগীত পরিচালক এ আর রাহমান।
২০২১ সালের ৮ সেপ্টেম্বর নজরুলের কনিষ্ঠ পুত্র কাজী অনিরুদ্ধর স্ত্রী, সংগীতশিল্পী কল্যাণী কাজীর সঙ্গে চুক্তিটি করেছে ‘পিপ্পা’ সিনেমার প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান রয় কাপুর প্রডাকশনস প্রাইভেট লিমিটেড। এতে সাক্ষী হিসেবে স্বাক্ষর করেছেন অনিরুদ্ধ–কল্যাণীর ছেলে কাজী অনির্বাণ।

চুক্তিপত্রের একটি অনুলিপি প্রথম আলোর কাছে এসেছে; এতে দেখা গেছে, ‘কারার ঐ লৌহ-কবাট’—কবিতায় নতুন করে সুরারোপ করে সিনেমায় ব্যবহারের অনুমতি চেয়েছে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানটি। আর কল্যাণী কাজীকে নজরুলের কবিতাটির একক মালিক হিসেবে দাবি করা হয়েছে।
তবে কপিরাইট বিশেষজ্ঞরা বলেন, কল্যাণী কাজী এই কবিতা কিংবা গানের একক মালিকানা দাবি করতে পারে না; এতে নজরুলের আট উত্তরাধিকারীর সমান অধিকার রয়েছে। তিনি সর্বোচ্চ তাঁর প্রয়াত স্বামী অনিরুদ্ধ ও ছেলে অনির্বাণের স্বত্বাধিকারটুকু রয় কাপুর প্রডাকশনসকে দিতে পারেন; পুরো গান কিংবা কবিতা নয়।

চুক্তিপত্রের একটি অনুলিপি প্রথম আলোর কাছে এসেছে।
কাজী অনির্বাণের সৌজন্যে

গানটি প্রকাশের আগেই চলতি বছরের মে মাসে মারা যান কল্যাণী কাজী। চুক্তিতে কল্যাণী কাজীর স্বাক্ষর থাকলেও সেটি কাজী অনির্বাণই করিয়েছেন বলে অভিযোগ নজরুল পরিবারের। তবে এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন অনির্বাণ। চুক্তি বাবদ দুই লাখ রুপি পেয়েছেন কল্যাণী কাজী।

সন্তান ও নাতি–নাতনি মিলিয়ে নজরুলের গানের উত্তরাধিকারী মোট আটজন; এর মধ্যে ছয়জন বেঁচে আছেন। অনির্বাণ ছাড়া বাকি পাঁচ উত্তরাধিকারীই চুক্তির বিষয়ে অবগত ছিলেন না, গান প্রকাশের পর তাঁরা চুক্তির কথা জেনেছেন।

অভিযোগের বিষয়ে কাজী অনির্বাণ গতকাল রোববার রোববার প্রথম আলোকে জানান, তাঁর মা কল্যাণী কাজী বাকিদের কেন অবহিত করেননি- তা তাঁর জানা নেই।

কাজী নজরুল ইসলামের জ্যেষ্ঠ পুত্র কাজী সব্যসাচীর বড় মেয়ে, সংগীতশিল্পী খিলখিল কাজী গতকাল রোববার বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, তিনি (কল্যাণী কাজী) একা গানটার মালিকানা দাবি করতে পারেন না, এটা উনি ভুল করেছেন।

চুক্তিপত্রটি বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশ কপিরাইট অফিসের সাবেক রেজিস্ট্রার অব কপিরাইটস জাফর রাজা চৌধুরী গতকাল রোববার প্রথম আলোকে বলেন, পুত্রবধূ হিসেবে তিনি (কল্যাণী কাজী) শুধু স্বামীর মালিকানা পেতে পারেন। তিনি নজরুলের কোনো গানের একক মালিকানা দাবি করতে পারেন না, এককভাবে কাউকে গান ব্যবহারের অনুমতিও দিতে পারেন না।

পুত্রবধূ হিসেবে তিনি (কল্যাণী কাজী) শুধু স্বামীর মালিকানা পেতে পারেন। তিনি নজরুলের কোনো গানের একক মালিকানা দাবি করতে পারেন না, এককভাবে কাউকে গান ব্যবহারের অনুমতিও দিতে পারেন না।
জাফর রাজা চৌধুরী

বিষয়টি নিয়ে অনির্বাণের ভাষ্য, ‘বাংলাদেশে দাদুর গানের অনুমতি দেন খিলখিল কাজী, আর ভারতে মা অনুমতি দেন। ভারতের অনেক রেকর্ডিং কোম্পানি মায়ের কাছে অনুমতি নিয়ে দাদুর গান করেছেন। মা ভেবেছিলেন, এ আর রাহমান দাদুর গান করলে অবাঙালিদের কাছে গানটি ছড়িয়ে পড়বে। তবে তাঁরা গানের সুর পাল্টে ফেলবে— তা জানতাম না। গান প্রকাশের আগে আগে শোনানোর কথা থাকলেও শোনানো হয়নি। গান প্রকাশের পরপরই প্রযোজনা সংস্থাকে জানিয়েছি, এটা অগ্রহণযোগ্য। ’

‘কারার ঐ লৌহ-কবাট’ মূলত কবিতা, কবিতাটি লেখার পর এতে সুরারোপ করেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। গান নয়, কবিতার (সাহিত্যকর্ম) ওপর সুরারোপের অনুমতি নিয়েছে রয় কাপুর প্রডাকশনস প্রাইভেট লিমিটেড। চুক্তিপত্রের কোথাও ‘কারার ঐ লৌহ-কবাট’কে গান হিসেবে উল্লেখ করেনি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানটি।

‘কারার ঐ লৌহ-কবাট’ মূলত কবিতা, কবিতাটি লেখার পর এতে সুরারোপ করেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। গান নয়, কবিতার (সাহিত্যকর্ম) ওপর সুরারোপের অনুমতি নিয়েছে রয় কাপুর প্রডাকশনস প্রাইভেট লিমিটেড। চুক্তিপত্রের কোথাও ‘কারার ঐ লৌহ-কবাট’কে গান হিসেবে উল্লেখ করেনি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানটি। অথচ এই গানে কাজী নজরুল ইসলাম সুরারোপ করে গেছেন, বাঙালিমাত্রই তা জানেন। তবে কৌশলে এড়িয়ে গেছে ভারতীয় প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানটি।

কবিতার ওপর নিজেদের মতো করে সুরারোপের অনুমতি নিয়েছে রয় কাপুর প্রোডাকশনস প্রাইভেট লিমিটেড; ফলে নজরুলের গানের মূল সুরের ধারেকাছেও যায়নি এ আর রাহমানের সুর। এ আর রাহমানের সুরারোপিত গানের স্বত্বও নিজেদের করে নিয়েছে রয় কাপুর প্রডাকশনস প্রাইভেট লিমিটেড।

‘কারার ঐ লৌহ-কবাট’ কবিতায় সুরারোপ করেছেন এ আর রাহমান
কোলাজ

এর আগে রয় কাপুর প্রোডাকশনস প্রাইভেট লিমিটেড এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, পরিবারের অনুমতি নিয়েই গানটিতে সুরারোপ করা হয়েছে। তারপরও গানটি কারও আবেগে আঘাত করলে ক্ষমা চেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
এই গানে কণ্ঠ দিয়েছেন একাধিক ভারতীয় বাঙালি গায়ক। তাঁদের মধ্যে আছেন তীর্থ ভট্টাচার্য, রাহুল দত্ত, পীযূষ দাস, শালিনী মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। এ আর রাহমান কিংবা গানের বাঙালি শিল্পীরা—কেউ গানটির কথা জানবেন না, এটা মানতে নারাজ অনেকে।
জাফর রাজা চৌধুরী বলেন, এটি এড়িয়ে গেছে রয় কাপুর প্রোডাকশনস প্রাইভেট লিমিটেড, এটা একধরনের প্রতারণা।

কল্যাণী কাজীই নজরুলের গানের একমাত্র স্বত্বাধিকারী নন, এটাও প্রতিষ্ঠানটির না জানার কথা নয়। জাফর রাজা চৌধুরীর ভাষ্যে, তারা (প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান) উদ্দেশ্যমূলকভাবে কল্যাণী কাজীর ওপর দোষটা চাপিয়ে দিয়েছে।

দাদুর সুরটা নষ্ট করা হয়েছে। এ আর রাহমানের আরও স্টাডি করা উচিত ছিল।
বাবুল কাজী, কাজী নজরুল ইসলামের নাতি

এই গানে সুরারোপের আগে গানটির ইতিহাস জানা জরুরি ছিল এ আর রাহমানের। নজরুলের পৌত্র বাবুল কাজী গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘দাদুর সুরটা নষ্ট করা হয়েছে। এ আর রাহমানের আরও স্টাডি করা উচিত ছিল।’
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে বলিউডে তৈরি রাজা কৃষ্ণ মেনন পরিচালিত হিন্দি ছবি পিপ্পা মুক্তি পেয়েছে ১০ নভেম্বর।

কাজী নজরুল ইসলামের সাড়ে তিন হাজারের বেশি গান রয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতের কপিরাইট অফিসে তাঁর কোনো গানই কপিরাইট নিবন্ধন করা হয়নি। আইন অনুসারে তাঁর মৃত্যুর পর ৬০ বছর গানের স্বত্ব পাবেন উত্তরাধিকারীরা। সে হিসাবে ২০৩৬ সাল পর্যন্ত নজরুলসংগীতের স্বত্ব পাবেন জীবিত ছয় উত্তরাধিকারী।


এর মধ্যে নজরুলের জ্যেষ্ঠ পুত্র প্রয়াত কাজী সব্যসাচীর তিন সন্তান—খিলখিল কাজী, মিষ্টি কাজী ও বাবুল কাজী রয়েছেন; তাঁরা ঢাকায় থাকেন। কনিষ্ঠ পুত্র কাজী অনিরুদ্ধর তিন সন্তান কাজী অনির্বাণ, কাজী অরিন্দম ও কাজী অনিন্দিতা; তাঁরা কলকাতা ও যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন।

আরও পড়ুন