জাপানের সাম্প্রতিক কালের সবচেয়ে পরিচিত সংগীত রচয়িতা রিউইচি সাকামোতোর মৃত্যুকে ‘আকস্মিক’ আখ্যায়িত করার কোনো উপায় নেই। ৭১ বছর বয়স সেই অর্থে তারুণ্য ধরে রাখার বয়স নয়, যদিও দীর্ঘ জীবনলাভের দেশ জাপানে মৃত্যুর কাঙ্ক্ষিত বয়স হিসেবেও সেটাকে ধরে নেওয়া যায় না। তবে এক দশকের বেশি সময় ধরে ক্যানসারের বিরুদ্ধে বেঁচে থাকার সংগ্রামে জড়িত থেকে মৃত্যুর পথ ধরেই যেন হেঁটে যাচ্ছিলেন তিনি, যে ব্যাধি শেষ পর্যন্ত সমাপ্তি টেনে দিয়েছে তাঁর জীবনের। সেদিক থেকে এটা প্রত্যাশিত মৃত্যু হওয়া সত্ত্বেও রিউইচি সাকামোতোর চলে যাওয়া জাপানের ধ্রুপদি সংগীতের জগতে নিয়ে এসেছে এমন এক শূন্যতা, যা সহজে পূরণ হওয়ার নয়। এ কারণে তা আরও নয় যে সংগীতের বাইরে সমাজের নানা রকম অন্যায় আর ব্যর্থতার বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সোচ্চার, মৃত্যুর অল্প কিছুদিন আগে পর্যন্ত যে কণ্ঠ মানুষকে শুনিয়ে গেছে আশার বাণী, দেখিয়েছে আলোর সন্ধান।
আন্তর্জাতিকভাবে সুপরিচিত জাপানি চলচ্চিত্র পরিচালক নাগিসা ওশিমার নির্মিত ছবি ‘মেরি ক্রিসমাস মিস্টার লরেন্স’ ছবির সংগীত রচনার জন্য ১৯৮৩ সালে শ্রেষ্ঠ সংগীতকার হিসেবে অস্কার জিতেছিলেন তিনি। এ ছাড়া বেরনার্দো বার্তেলুচ্চির আরেক বিখ্যাত ছবি ‘দ্য লাস্ট এম্পেরর’–এর সংগীতও ছিল তাঁর সৃষ্টি।
৩০টির বেশি ছবির সংগীত রচনার পাশাপাশি সংগীতের অন্যান্য দিকেও সাকামোতো ছিলেন খুবই সক্রিয় এক সৃজনশীল ব্যক্তিত্ব। ২ এপ্রিল রবিবার প্রচারিত এক বিবৃতিতে সাকামোতোর কার্যালয়ের পক্ষ থেকে তাঁর মৃত্যুর খবর প্রচার করে বলা হয়েছে, গত ২৮ মার্চ মঙ্গলবার তিনি শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন এবং পরিবারের ঘনিষ্ঠ স্বজনদের উপস্থিতিতে তাঁর শেষকৃত্যের অনুষ্ঠান ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। মৃত্যুর কারণের উল্লেখ বিবৃতিতে করা না হলেও ধারণা করা হচ্ছে, ক্যানসারের বিরুদ্ধে চালিয়ে যাওয়া সংগ্রামে পরাজয় শেষ পর্যন্ত প্রত্যাশিত মৃত্যু নিয়ে এসেছে।
রিউইচি সাকামোতোর পিতা ছিলেন জাপানের পরিচিত একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের সম্পাদক। বালক অবস্থায় পিয়ানো বাজানোর শিক্ষা গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে সংগীতের জগতে তাঁর প্রবেশ। এরপর ১০ বছর বয়সে সংগীত রচনার শিক্ষাগ্রহণ শুরু করেন তিনি। তবে ১৯৬০–এর দশকের শেষ দিকে হাইস্কুলের ছাত্র থাকা অবস্থায় তিনি ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রতিবাদ জানাতে জাপানজুড়ে ছড়িয়ে পড়া ছাত্র বিক্ষোভে যোগ দিয়েছিলেন। সেই অভিজ্ঞতা তাঁকে পরবর্তী জীবনে নানাভাবে প্রভাবিত করেছে। অনেক বছর পরে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, যে পর্যায়ে তিনি এখন দাঁড়িয়ে, তাঁকে সেখানে নিয়ে আসতে সাহায্য করেছে সেই অভিজ্ঞতা।
২০১৪ সালে গলার ক্যানসার শনাক্ত হওয়ার পর চিকিৎসা গ্রহণ করে ক্যানসারমুক্ত হন সাকামোতো। তবে ২০২০ সালে ক্যানসার তাঁর দেহে ফিরে আসে। তখন থেকে মলনালির ক্যানসারের চিকিৎসা নিয়ে আসছিলেন। গত বছর জুন মাসে লেখা এক নিবন্ধে তিনি উল্লেখ করেছিলেন যে বেশ কয়েকটি অস্ত্রোপচার সত্ত্বেও ক্যানসার তাঁর দেহে ছড়িয়ে পড়েছে এবং রোগের চতুর্থ ধাপে আছেন তিনি।
সেই একই রচনায় সাকামোতো আরও উল্লেখ করেন, ‘বয়স আমার এখন সত্তর হলেও আমার জানা নেই আর কয়টি পূর্ণ চাঁদ আমি দেখে যেতে পারব! তবে সে রকম চিন্তা মনে দেখা দেওয়া সত্ত্বেও জীবন আমাকে দেওয়া হয়েছে বলে আমি প্রার্থনা করছি, জীবনের একেবারে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আমি যেন সংগীত সৃষ্টি করা বজায় রাখতে সক্ষম হই, ঠিক যেমন করেছিলেন আমার প্রিয় সংগীতকার বাখ ও দেবুসি।’
জাপানে ২০১১ সালের ভূমিকম্প ও সুনামি বিপর্যয়ের পর ক্ষতিগ্রস্ত তোহোকু অঞ্চলের শিশুদের নিয়ে গড়ে তোলা একটি অর্কেস্ট্রার স্বেচ্ছাসেবী সংগীত পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন সাকামোতো। গত বছর মার্চ মাসে ক্যানসারের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত অবস্থায় টোকিওতে একটি কনসার্টে তিনি অংশ নিয়েছিলেন, যেখানে তাঁর রচিত নতুন একটি সিম্ফনি ‘সময় এখন ঝুঁকে পড়ছে’ উপস্থাপন করা হয়।
সংগীত রচনার পাশাপাশি পরমাণুমুক্ত বিশ্ব গড়ে তোলা, সেই সঙ্গে পরিবেশ ও শান্তি আন্দোলন নিয়েও সাকামোতো ছিলেন উৎসাহী। জাপানের তারকা জগতের এমন এক বিরল দৃষ্টান্ত হিসেবে তাঁকে দেখা হয় যে বিতর্কিত বিভিন্ন রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে মন্তব্য করতে যিনি কখনো কুণ্ঠা বোধ করেননি। যুক্তরাষ্ট্রে ২০০১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের সন্ত্রাসী হামলার পর বিশ্বজুড়ে দেখা দেওয়া অস্থির পরিস্থিতি নিয়ে করা এক মন্তব্যে তিনি বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রভুত্বসুলভ আচরণ হামলার সেই পরিবেশ তৈরি করে দিয়েছে।
জাপানে ২০১১ সালের ভূমিকম্প ও সুনামি বিপর্যয়ের পর ক্ষতিগ্রস্ত তোহোকু অঞ্চলের শিশুদের নিয়ে গড়ে তোলা একটি অর্কেস্ট্রার স্বেচ্ছাসেবী সংগীত পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন সাকামোতো। গত বছর মার্চ মাসে ক্যানসারের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত অবস্থায় টোকিওতে একটি কনসার্টে তিনি অংশ নিয়েছিলেন, যেখানে তাঁর রচিত নতুন একটি সিম্ফনি ‘সময় এখন ঝুঁকে পড়ছে’ উপস্থাপন করা হয়। ঘণ্টার শব্দ দিয়ে শেষ হওয়া সেই সিম্ফনির ব্যাখ্যা দর্শকের সামনে তুলে ধরে তিনি বলেছিলেন, ভূমিকম্প এবং যুদ্ধে নিহত মানুষের আত্মার শান্তির একই প্রার্থনা ভাগাভাগি করে নেয়। ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা শুরু হওয়ার মুখে অনুষ্ঠিত সেই কনসার্টে তিনি আরও বলেছিলেন যে সিম্ফনির শেষে যে ঘণ্টাধ্বনি যুক্ত করা হয়েছে, মৃতের প্রতি নিবেদিত সংগীত নাকি আশার শব্দের মতো সেটা শোনাবে, সেই সিদ্ধান্ত নির্ভর করবে প্রত্যেকের নিজের ওপর।
সংগীতের জগতে রিউইচি সাকামোতো সক্রিয় থেকেছেন জীবনের একেবারে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। ডিসেম্বর মাসে বিশ্বের ১০টির বেশি দেশে তাঁর একটি সংক্ষিপ্ত অনলাইন কনসার্টের প্রচার শুরু হয়। সেই উপলক্ষে দেওয়া এক বিবৃতিতে সাকামোতো বলেছিলেন, ‘শক্তি আমি আসলেই হারিয়ে ফেলছি, ফলে নব্বই মিনিট ধরে স্বাভাবিক একটি কনসার্ট চালানো আমার পক্ষে এখন খুবই কষ্টসাধ্য। আর এ জন্যই কনসার্টের প্রতিটি সংগীত আমাকে ভিন্নভাবে রেকর্ড করে নিতে হয়েছে এবং কনসার্টের জন্য এগুলো যুক্ত করে আমি সম্পাদনা করে নিয়েছি। আমার বিশ্বাস, স্বাভাবিক উপায়ে যেমন হয়ে থাকে, সে রকম একই ধরনের তৃপ্তিদায়ক হবে এগুলো।’
‘মেরি ক্রিসমাস মিস্টার লরেন্স’ ও ‘দ্য লাস্ট এম্পেরর’–এর থিম সংগীতসহ সাকামোতোর একক ১৩টি পিয়ানো সংগীত এতে অন্তর্ভুক্ত আছে। চারবার এর ভিডিও স্ট্রিমিং প্রচারিত হয়েছে এবং শেষ পর্বটি ছিল জাপানে গত সোমবার সকালে, সংগীত রচয়িতার অনন্ত যাত্রার ঠিক এক দিন আগে।