ভাই রে ৯ ঘণ্টা আগে গান করলি ৯ ঘণ্টা পরে তুই কাঁদালি...

মতিউর রহমান হাসান ওরফে পাগল হাসান। ছবি: ফেসবুক

মারা যাওয়ার ১০ ঘণ্টা আগেও ফেসবুকে সরব ছিলেন। সহকর্মী, ভক্তদের সঙ্গে কথাও হয়েছে। সেই সময় গানপাগল এই গায়কের সুরে ছিল জীবনবোধের গান। শেষবারের মতো কণ্ঠে তুলে ধরেছিলেন ‘জীবন আমার রেলগাড়ির ইঞ্জিন’ শিরোনামে একটি গান। সেই গানটি গভীর রাতে ফেসবুকে পোস্ট করেছিলেন। সেই গান শুনে ঘুম থেকে উঠেই অনেকেই শুনেছেন প্রিয় মানুষটি আর নেই। কেউ সকালে গান শুনতে শুনতেই জানতে পেরেছেন তরুণ গায়ক মতিউর রহমান হাসান আর নেই। তিনি পাগল হাসান নামেই পরিচিত।

মতিউর ঈদের পর গান নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। বেশ কিছু জায়গায় কনসার্ট ছিল। তিন দিন আগেও সুনামগঞ্জ জেলার শিল্পকলা একাডেমিতে গান করেছেন। সেই ধারাবাহিকতায় গতকালও ছিল গানের আসর। সেই আসর থেকে আর ফেরা হলো না। এই ঘটনায় সাংস্কৃতিক কর্মীদের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। তাঁদের মুখে ঘুরেফিরে আসছে শেষ স্ট্যাটাসের কথা।

গায়ক মতিউর রহমান
ছবি: ফেসবুক

এই তরুণ গায়কের মৃত্যুতে শফিকুল ইসলাম নামের একজন ফেসবুক বন্ধু সর্বশেষ ফেসবুক পোস্ট করা গানটির নিচে স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘ভাই রে ৯ ঘণ্টা আগে গান করলি আর ৯ ঘণ্টা পরে তুই কাঁদালি, আমাদের কাঁদিয়ে দুনিয়া ছেড়ে চলে গেলি রে ভাই, মানতে বড় কষ্ট হচ্ছে তোমার অকালমৃত্যু। গত বছর এই দিনে তুমি আমার সঙ্গে দুবাইতে ছিলে, আজ এক বছর পরে তুমি নেই।’
তরুণ এই গায়ক তাঁর ক্যারিয়ারের নানা বাধা পেরিয়ে এখন সুসময়ের পথে হাঁটছিলেন। প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে গান নিয়ে তাঁর অনেক পরিকল্পনা ছিল। গানই তাঁকে স্বপ্ন দেখাচ্ছিল। ইতিমধ্যে পাগল হাসানের গাওয়া ‘আসমানে যাইও নারে বন্ধু’, ‘জীবনখাতায় প্রেম কলঙ্ক’, ‘মন আমার মরা নদী’, ‘মাটির বালাখান’ এমন বেশ কিছু জনপ্রিয় গান ভক্তদের কাছে পৌঁছেছে।

ইউটিউব ঘুরে দেখা যায় তাঁর ‘জীবন খাতা’ গানটির ভিউ ৩০ মিলিয়ন, ‘আসমানে যাইওনারে বন্ধু-২’ গানটি ২৪ মিলিয়ন দর্শক দেখেছেন। এ ছাড়া তাঁর বেশ কিছু গান কোটি ভিউ হয়েছে। তাঁর গানে উঠে এসেছে জীবনবোধের কথা। বেশির ভাগ তিনি ফোক গান করতেন। গান করার পাশাপাশি তিনি ছিলেন গীতিকার ও সুরকার।

মারা যাওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগেই ছবিটি পোস্ট করে লিখেছিলেন, ‘সাদা কালোই প্রথম আলো।’

বেশির ভাগ জীবনবোধের গানগুলো তিনি গাইতে ভালোবাসতেন। সেই গানগুলোই ফেসবুকে পোস্ট করতেন। সেগুলো নিয়ে ভক্ত–সহকর্মীদের সঙ্গে নানা প্রসঙ্গে কথা বলতেন। মতিউরের সর্বশেষ গানটি রাতে শুনেছেন সুরঞ্জিত পাল নামের এক ভক্ত। তিনি এই গায়কের প্রয়াণে শোক প্রকাশ করে লিখেছেন, ‘রাত প্রায় তিনটার দিকে ঘুমানোর আগে হাসান ভাইয়ের এই গানটি শুনে ঘুমিয়েছিলাম, সকালে হাসান ভাই নেই, এমন অবিশ্বাস্য খবরে ঘুম ভাঙবে, এটা বিশ্বাস করতে পারছি না।’
‘জীবন আমার রেলগাড়ির ইঞ্জিন’ সেই গানটি যেন এখন শোকের হয়ে গেল। এই ইঞ্জিনের যাত্রা এত তাড়াতাড়ি শেষ হবে, সেটা কেউ ধারণা করতে পারেননি। শোক প্রকাশ করে নুরুল আমিন নামের একজন লিখেছেন, ‘ইঞ্জিন কখন কার কোথায় গিয়ে থেমে যাবে, কেউ জানে না ভাই। এখন থেকে ১৪–১৫ ঘণ্টা আগে তোমার গলায় কী সুর ছিল আর এখন তোমার সুর চিরতরে থেমে গেল (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।’

ভাটির দেশের এই তরুণের মৃত্যুতে সংগীতশিল্পী আসিফ আকবর ফেসবুক পোস্ট করে লিখেছেন, ‘সুনামগঞ্জের ছেলেটা গীতিকার, সুরকার ও গায়ক হিসেবে ছিল অমিত প্রতিভার অধিকারী। ‘‘মানুষ মইরা গেলে কদর বাইড়া যায়’’ এই গানটির মাধ্যমেই তাঁর সঙ্গে সখ্য আমার। সৎ স্পষ্টবাদী বন্ধুবৎসল হাসান সিলেটি টোনে কথা বলত। “আফনে বারিত যাইবেন, ঘরে হাই কমোড লাগাইসি। নতুন ঘর বানাইসি, পানি কমলে যাইবেন।” দুজনের ব্যস্ততায় আর যাওয়া হয়নি।’

আসিফ তাঁর সঙ্গে কাটানো দিনগুলোর কথা স্মরণ করেছেন। ছবি: ফেসবুক

আসিফ তাঁর সঙ্গে কাটানো দিনগুলোর কথা স্মরণ করে আরও লিখেছেন, ‘একদিন বলল, ভাই কোনো দিন সাগর দেখছি না। নিয়ে গেলাম পতেঙ্গায়। গভীর সাগরে চলে গেলাম স্পিডবোটে। সেকি আনন্দ তার! সে ভাবত পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী মানুষ আমি, ভাবত আমাকে দিয়ে সব সম্ভব! বোকা ছেলে! আমার অফিসে পাশের রুমে দোতারা একটা নিয়ে উদাস মনে গান গাইতেই থাকত, আমি শুনতাম নিজের রুম থেকে। একদিন বেগমকে ফোনে বলছিলাম টাকা লাগবে, সে বাইরে বের হয়ে বুথ থেকে টাকা তুলে এনে দিয়ে বলল লাগলে আরও দেবে, আমি তো অবাক!! এ রকম হাজারো স্মৃতি আমাদের। তোর মৃত্যুর খবরে অনেক দিন পর অনেক কাঁদলাম ভাই আমার, আরও অনেক কাঁদব।’

জানা যায়, গতকাল বুধবার রাতে সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলায় হাসান একটি অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করেন। সেখানে থেকে আজ বৃহস্পতিবার ভোরে একটি অটোরিকশায় করে তিনি ও তাঁর সঙ্গীরা বাড়ি ফিরছিলেন। পথে সকাল ছয়টার দিকে ছাতকের সুরমা সেতু এলাকায় যাত্রীবাহী বাসের সঙ্গে ওই অটোরিকশার মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে ঘটনাস্থলেই হাসান ও ছাত্তার নিহত হন। আহত হন একই গ্রামের জাহাঙ্গীর, রূপণ ও লায়েছ।

মতিউরের সঙ্গে আসিফ। ছবি: ফেসবুক