জেমস নামে কোনো শিল্পী এই শহরে থাকেন না...
তাঁকে মঞ্চে পাওয়া যায় না, টেলিভিশনে লাইভে দেখা যায় না, আড্ডা জমায়েতেও তিনি নেই। জেমস নামে কোনো শিল্পী যেন এই শহরে থাকেন না। অথচ হাতিরপুল, এলিফ্যান্ট রোডে এখনো ভালো করে কান পাতলে বাতাসে শোনা যেতে পারে পুরোনো জেমসের খলখল হাসি। সেই নব্বই দশকের কথা। তখন নাকি তাঁর অনেক বন্ধু ছিল। নতুন সব অভিজ্ঞতা, গান, প্রেম, ভক্তদের পাগলামিতে উচ্ছল হয়ে উঠত আড্ডা। এখন জেমস যেন নির্বাসিত এক সম্রাট। দূরদ্বীপে স্বেচ্ছাবন্দি!
জেমসকে এখন পাওয়া যায় ইউটিউবে। পুরোনো গান যেমন খুঁড়ে তুলে আনে পুরোনো স্মৃতি, সেভাবে ইউটিউবে একা হেডফোনে জেমসের কণ্ঠ মানুষকে স্মৃতিতে ভাসায়। কৈশোর, তারুণ্য কিংবা যৌবনে জেমসের গান শোনার অভিজ্ঞতা ছিল অন্য রকম।
নব্বইয়ে জেমস ছিলেন গানের ফেরিওয়ালা। চট্টগ্রাম থেকে খুলনা, রাজশাহী থেকে বরিশাল গান ফেরি করতেন। তার আগেই ক্যাসেট বাজিয়ে গানগুলো শুনতে শুনতে মুখস্থ করে ফেলত ‘দুষ্টু ছেলেরা’। কনসার্টে পুরোনো গানগুলোই ‘গুরু’র সঙ্গে একস্বরে গাইত হাজার হাজার ভক্ত। বহু মঞ্চে ‘লেইস ফিতা লেইস’ দিয়ে শুরু হতো কনসার্ট। তখনকার হিট ট্র্যাক ছিল ‘তারায় তারায় রটিয়ে দেব’, ‘দুঃখিনী দুঃখ করো না’, ‘তুমি যদি নদী হও’, ‘পথের বাপই বাপ রে মনা’, ‘জিকির’।
একসময় কমে গেল একক অ্যালবাম। শুরু হলো মিক্সড অ্যালবামের যুগ। জেমসের একটা গান নিয়ে তখন সন্তুষ্ট থাকতে হতো। তখন হঠাৎ হঠাৎ টেলিভিশনে জেমসকে গাইতে দেখা যেত।
নব্বইয়ে জেমস ছিলেন গানের ফেরিওয়ালা। চট্টগ্রাম থেকে খুলনা, রাজশাহী থেকে বরিশাল গান ফেরি করতেন। তার আগেই ক্যাসেট বাজিয়ে গানগুলো শুনতে শুনতে মুখস্থ করে ফেলত ‘দুষ্টু ছেলেরা’।
দরাজ কণ্ঠে তিনি শোনাতেন ‘তেরো নদী সাত সমুদ্দুর’, ‘যেদিন বন্ধু চলে যাব’, ‘মীরাবাঈ’, ‘কবিতা’, ‘বিজলি’, ‘দুষ্টু ছেলের দল’, ‘পাগলা হাওয়ার তোড়ে’, ‘মা’, ‘বাবা’, ‘এক নদী যমুনা’, ‘ভালোবেসে চলে যেয়ো না’, ‘লিখতে পারি না কোনো গান’, ‘সুরের টানে’, ‘প্রথম স্পর্শ’।
আগের শতকের জনপ্রিয় গান ‘পৃথিবীটা নাকি ছোট হতে হতে’র সুরে নতুন লিরিকে হিন্দি ভাষায় জেমস গাইলেন ‘ভিগি ভিগি সিহে রাত ভিগি’।
এই এক গানেই হিন্দিভাষী মানুষ জেমসকে বুকে টেনে নেন। সিনেমায় ‘আসবার কালে আসলাম একা’, ‘তোর প্রেমেতে অন্ধ হলাম’ গানগুলো যথাক্রমে ‘মনের সাথে যুদ্ধ’ ও ‘সত্তা’ সিনেমা দুটিকে দিয়েছিল অন্য রকম মাত্রা।
সেই জেমসকে নিয়মিত নতুন গানে পাওয়া যায় না। পাওয়া যায় না হাতিরপুল বাজারে, বেইলি রোডে, আশুলিয়ার পুরোনো বটতলায়। বদলে পাওয়া যায় নিউজ পোর্টালের অন্য রকম সব খবরে, টিকাকেন্দ্র বা আদালতে। আশৈশব যাঁরা জেমস শুনেছেন, তাঁদের হয়তো প্রায়ই মনে হয়, জেমস কোথায়! তিনি আছেন, নাকি নেই? নাকি তাঁর অনুপস্থিতি ভক্তদের আগাম সইয়ে নিচ্ছেন শিল্পী?
একবার সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, নির্জনতা খুব টানে তাঁকে। ঢাকা থেকে গাড়িপথে দু থেকে তিন ঘণ্টার দূরত্বের কোনো নির্জন জায়গায় বসত গড়ার ইচ্ছা তাঁর। প্রয়োজন হলে ঢাকায় আসবেন, কাজ সেরে ফিরে যাবেন ডেরায়, ডাল-ভাত আর মাছে।
নির্জনতা খুব টানে তাঁকে। ঢাকা থেকে গাড়িপথে দু থেকে তিন ঘণ্টার দূরত্বের কোনো নির্জন জায়গায় বসত গড়ার ইচ্ছা তাঁর।
গান আর জীবন নিয়ে তাঁর সোজাসাপটা বয়ান, ‘প্রতিটা দিনই আমি আমার মতো করে উপভোগ করি। কোনো লক্ষ্য ঠিক করে সামনে চলি না। যে কাজটা করে আনন্দ পাই, সেটা করি। আগ্রহ না হলে কখনোই করি না। আমার জীবনে অনেক ওঠানামা ছিল। গান গাইতে এসে কোনো লক্ষ্য স্থির করিনি। গান করছি, এটাই আমার আনন্দ, এটাই আমার প্যাশন। তারপর কী হয়েছে না হয়েছে ভাবিনি। কিছু না হলেও গানই করতাম।’
জেমসের ৫৯তম জন্মদিন আজ। ১৯৬৪ সালের ২ অক্টোবর নওগাঁয় তাঁর জন্ম। জেমসের ছোট ভাই রুশো এখনো আছেন নওগাঁয়, দেখাশোনা করেন পারিবারিক ব্যবসা। ভক্তরা জানেন, জেমস বেড়ে উঠেছেন চট্টগ্রামে। তাঁর পুরো নাম ফারুক মাহফুজ আনাম। জেমস নামটি রেখেছিলেন তাঁর বাবা মোজাম্মেল হক। তিনি চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। আর মা জাহানারা খাতুন ছিলেন গৃহিণী। বাবার সরকারি চাকরি সূত্রে জেমসের প্রথম স্কুল ছিল সিলেটের ব্লু-বার্ড স্কুল। তারপর রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল। আর নীলফামারী ও সিরাজগঞ্জের কলেজজীবনে কেটেছে দারুণ কিছু সময়। কলেজজীবনের পর জেমসের মাথায় ঢোকে গানের পোকা।
পরিবারের কেউ কখনো গানের সঙ্গে যুক্ত ছিল না। ফলে বড় ছেলে জেমসের গায়ক-জীবন চাননি বাবা মোজাম্মেল হক এবং মা জাহানারা খাতুন। আর তাই অভিমানী জেমসকে ঘর ছেড়ে পথে নামতে হয়। তাঁর গানের কথায়, ‘পথের বাপই বাপ রে মনা, পথের মা-ই মা...’। সেই পথ চলতে চলতে তাঁর ঠিকানা হয়ে যায় চট্টগ্রামের কদমতলীর পাঠানটুলি রোডে মতিয়ার পুলের সেই আজিজ বোর্ডিংয়ের ৩৬ নম্বর কক্ষটি। জেমস বলছিলেন, ‘আড্ডা আর গান যা-ই হোক না কেন, সব ওখানেই। আজিজ বোর্ডিংয়ের দিনগুলো কখনো ভুলব না।’
বাংলাদেশের আনাচকানাচে যেমন চষে বেড়িয়েছেন, তেমনি গানের জন্য পৃথিবীর বহু দেশ, বহু শহর ঘুরেছেন জেমস।
জেমসকে এখন পাওয়া যায় ইউটিউবে। পুরোনো গান যেমন খুঁড়ে তুলে আনে পুরোনো স্মৃতি, সেভাবে ইউটিউবে একা হেডফোনে জেমসের কণ্ঠ মানুষকে স্মৃতিতে ভাসায়। কৈশোর, তারুণ্য কিংবা যৌবনে জেমসের গান শোনার অভিজ্ঞতা ছিল অন্য রকম।
সবচেয়ে প্রিয় শহরের তালিকায় আছে ভারতের কলকাতা, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক ও সুইজারল্যান্ডের জুরিখ। বলাবাহুল্য, সবচেয়ে প্রিয় বাংলাদেশ। লেখাবাহুল্য, জেমসকে কিছুটা সরব দেখলে তাঁর ভক্তদের ভালো লাগত। মঞ্চ, টিভি, ফেসবুকে তিনি আসতেই পারেন। প্রয়াত বন্ধুর স্মরণে কথা বলতে পারেন কোথাও না কোথাও। অথচ জেমস যেন এক সুদূরের তারা। সেই তারকার মতোই কখনো আছেন, কখনো নেই।
(সংকলিত লেখাটির কিছু অংশ ২০২১ সালের ২ অক্টোবর জেমসের জন্মদিনে ‘জেমস আছেন, জেমস নাই’ শিরোনামে প্রথম আলো বিনোদনে প্রকাশ করা হয়েছিল)