ফেরদৌস আরার কণ্ঠে গান শুনে কবি যা বলেছিলেন
নজরুলসংগীতের জনপ্রিয় শিল্পী ফেরদৌস আরা তরুণদের মধ্যে নজরুলসংগীত তালিম দেওয়ার কাজটি করছেন। গানের জীবনের শুরুতে এই শিল্পীর ক্ল্যাসিক্যাল সংগীতের প্রতি টান ছিল। কারণ, প্রকৌশলী বাবা এ এ কে এম আবদুল হাইকে সকালবেলায় দেখতেন, ক্ল্যাসিক্যাল সংগীত শুনছেন। তিনিও খুব ভালো ক্ল্যাসিক্যাল গাইতেন। কলেজে পড়ার সময়ও বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় নজরুলসংগীতের পাশাপাশি আধুনিক গানে প্রথম হতেন ফেরদৌস আরা। এখন পর্যন্ত জীবনের পুরোটা সময় ধরে নজরুলসংগীতের সঙ্গে নিজেকে নিবেদিত রাখা এই শিল্পীর সৌভাগ্য হয়েছে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে গান শোনানোর।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৭তম জন্মদিন আজ। কবির জন্মদিনে শোনা যাক কবিকে গান শোনানের সময়ের সেই অভিজ্ঞতা। ১৯৭৫ সালে গান শোনানোর সেই অভিজ্ঞতা জানিয়ে ফেরদৌস আরা বলেন, ‘কবিকে যখন আমার দেখার সুযোগ হয়েছিল, তখন কবি নির্বাক ছিলেন। দিনটার কথা যদিও মনে নেই, শুধু এটুকু বলতে পারি—১৯৭৫ সালের কোনো একদিন বাবার সঙ্গে আমি আর আমার বোন জান্নাত আরা কবি ভবনে গিয়েছিলাম। আমরা তখন ছোট, স্কুলে পড়ি। কবিকে গান শোনানোর জায়গাটাতে বোনের সঙ্গে আমিও বসে পড়ি। সেদিন ‘নীলাম্বরী শাড়ি পরি নীল যমুনায়’ গানটি গেয়েছিলাম। একপর্যায়ে কবি “বাহ্” বলে উঠলেন। আমরা দুই বোন তো ভয় পেয়ে দৌড় দিলাম। পরে শুনলাম, গান পছন্দ হলেই নাকি কবি বাহ্ বলে উঠতেন। আফসোস, কবির কথা শোনা হলো না।’
গানে ফেরদৌস আরার হাতেখড়ি বাবা এ এ কে এম আবদুল হাইয়ের কাছেই। পিডব্লিউডির প্রধান প্রকৌশলী বাবা অনেক বড় মাপের সংগীতজ্ঞদের সংস্পর্শে আসেন। ওস্তাদ সালামত আলী, নাজাকাত আলী, মেহেদি হাসান, ফরিদা খানম—তাঁদের সঙ্গে বাবার দারুণ সম্পর্ক ছিল বলে জানান ফেরদৌস আরা। তিনি বলেন, ‘ওই সময় সারা রাত আমাদের বাসায় তাঁদের নিয়ে আসর জমত। ওখানে তাঁরা দেখতেন, সবচেয়ে ছোট আমি সারা রাত জেগে ক্ল্যাসিক্যাল গিলছি। তাঁরা একদিন অবাক হয়ে বললেন, “এটা কার মেয়ে! এ রকম শ্রোতা তো আর এখানে নেই।” তখন আমার আব্বা বললেন, “এই একটাই মেয়ে আমাকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে শেষ করে দিচ্ছে। সে কোনোভাবে গান শেখে না।” তখন তাঁরা উর্দুতে বললেন, “হাই ভাই, আপনি ভুল বলছেন, “ওর মধ্যে কিন্তু ভয়ংকরভাবে সংগীত বাস করছে। এখানে অনেক বড় সংগীতের ওস্তাদও ঘুমিয়ে গেছে; কিন্তু সে তো নড়েও না, চড়ে না।” তখন আমার আব্বা বললেন, “হয়তো–বা চেষ্টা করলে হবে।” তখন ওস্তাদ সালামত আলী ও নাজাকাত আলী একটা গান শুনতে চাইলেন। আমিও শোনালাম। আমরা তখন ঢাকায় নয়, রাজশাহীতে থাকতাম। বাবার কাছ থেকে আমি সব সময় লুকিয়ে লুকিয়ে চলতাম। বাবা চেয়েছিলেন, আমি ক্ল্যাসিক্যাল গানই করি। তবে বাসার কাউকে রাগাতে চাইলে আমি আধুনিক গাইতাম। আধুনিক গাইলে মা-বাবা দুজনই বেত নিয়ে দৌড়ানি দিতেন। বাসায় কোনো পরিবেশই ছিল না আধুনিক গাওয়ার। ক্ল্যাসিক্যালই ছিল প্রধান। আমার আব্বা বলতেন, “নোট টু নোট”। ১৯৭২ সালে আমি রেডিও টেলিভিশনে অডিশন দিতে গেলাম।’
এখন ফেরদৌস আরার কাছে অনেকে অডিশন দেন। তিনি দীর্ঘ সময় ধরে নজরুলসংগীতের তালিম দিচ্ছেন অনেক শিক্ষার্থীকে। নজরুলসংগীতের তালিম দেওয়ার কাজটি প্রসঙ্গে ফেরদৌস আরা বলেন, ‘আমরা যারা শিক্ষকতা করি, তারা উপলব্ধি করতে পারি, তরুণদের মধ্যে নজরুল দারুণভাবে উদ্দীপনা জাগিয়ে রেখেছেন। এই চর্চা আরও বেশি দরকার। আরও পৃষ্ঠপোষকতা দরকার। আমি মনে করি, সারা বিশ্বের যাঁরাই বাংলা চর্চা করে থাকেন, তাঁরা নজরুলের আদর্শ ও চেতনা নিয়ে ভাবেন। বিশ্বে তিনি এখনো আধুনিক।’
আজকাল তরুণ শিল্পীদের অনেকে নজরুলসংগীতকে আধুনিক যন্ত্রানুষঙ্গে উপস্থাপন করছেন। এ বিষয়টাকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন জানিয়ে ফেরদৌস আরা বলেন, ‘আমাদের কবিও কিন্তু নতুনের কথা, তারুণ্যের কথা, বৈচিত্র্যের কথা বলেছেন। বিকৃত না করে আধুনিক যন্ত্রানুষঙ্গে নজরুলের গানের উপস্থাপনা আমার কাছেও ভালো লাগে। আমরা সব সময়ই ভাত খাই। কোনো একদিন যখন একটা আকর্ষণীয় প্লেটে ওই ভাত খেতে দেওয়া হবে, তখন সেটা অন্য রকম লাগে। এ ব্যাপারগুলোও কিন্তু তা–ই।’