ব্যাঙ ডাকে ঘন ঘন, শীঘ্র হবে বৃষ্টি জানো
যদি হয় চৈতে বৃষ্টি, তবে হবে ধানের সৃষ্টি...’
খনার বচন আমাদের অনেকের জানা। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এটা সুরে সুরে গুনগুন করছেন অনেকেই। এর পুরো কৃতিত্বই কোক স্টুডিও বাংলার ও ব্যান্ড মেঘদলের। সঙ্গে আছে ঘাসফড়িং ও জোহরা বাউল। বলছি কোক স্টুডিও বাংলা দ্বিতীয় সিজনের দ্বিতীয় গান ‘বনবিবি’র কথা। সুন্দরবনের কল্পিত চরিত্র বনবিবি, খনার বচন ও এস এম সুলতানের শৈল্পিক ভাবনাকে ফুটিয়ে তোলা ‘বনবিবি’র দৃশ্যায়ন দর্শক–শ্রোতাকে নিয়ে গেছে ভিন্ন এক ঘোরের জগতে।
মজার বিষয় হলো গানটি মুক্তি দেওয়া হয়েছে রাত একটায়। যখন প্রকৃতি শান্ত থাকে, চারপাশে বিরাজ করে অদ্ভুত প্রশান্তি। সবুজ-শান্ত একটা ঘোরের মধ্যে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা সম্পর্কে গানটির সংগীত প্রযোজক শিবু কুমার শীল জানান, ‘গানের শুরুতেই আমাদের ভাবনা ছিল সবুজ-শান্ত পরিবেশকে প্রাধান্য দেওয়া। তাই গান ও পুরো সেটে সেই আবহ নিয়ে আসা হয়েছে। “বনবিবি” মুক্তি দেওয়ার জন্য আমরা সপ্তাহের শেষ দিন গভীর রাতকে নির্বাচন করেছি। কারণ, গভীর রাতে দর্শক-শ্রোতারা তাঁদের দৈনন্দিন জীবনের সব কাজ শেষে কোলাহলমুক্ত পরিবেশে গানটি উপভোগ করতে পারবেন। পুরো গানের পরিকল্পনা-দৃশ্যায়ন আমাদের লোকগাথা আর প্রকৃতিকে নিয়েই করা হয়েছে।’
যেহেতু গানটিতে লোকগাথা ও সুন্দরবন মুখ্য ছিল, তাই দৃশ্যায়ন বাস্তবধর্মী করতে পুরো ‘বনবিবি’ টিমকে প্রচুর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। টিম ‘বনবিবি’ সূত্রে জানা যায়, গানে খনার বচন ব্যবহার করা হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় গানটির সুরে ভিন্নতা আনার জন্য বাদ্যযন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে কুলা-ঢেঁকিকে। সেই ঢেঁকি সংগ্রহ করা হয়েছে বান্দরবান থেকে। একতারার সুরের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে তারযন্ত্র। এর সঙ্গে গ্রামীণ পরিবেশের নানা আনুষঙ্গিক জিনিস সংগ্রহ করতে হয়েছে দৃশ্যায়নটি সুন্দর করার জন্য। আর সেটের সৌন্দর্য বাড়াতে ব্যবহৃত হয়েছে এস এম সুলতানের শিল্পকর্ম। বরেণ্য এই শিল্পীর কাজে প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণের বিষয়টি সব সময় গুরুত্ব পেয়েছে। তাঁকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করার আয়োজনে কমতি ছিল না আন্তরিকতার।
কোক স্টুডিও বাংলার সংগীত প্রযোজক অর্ণব জানান, ‘খনার বচন ও বনবিবি কিংবদন্তি চরিত্র। তা নিয়েই করা হয়েছে গান। এই গান আমাদের নিয়ে যায় দূরের কোনো বনে, যেখানে আমরা নিজেদের প্রকৃতির কাছাকাছি অনুভব করতে পারি। সেই অনুভবের জন্য প্রকৃতিতে শুনতে পাওয়া নানা সুরের মিশ্রণ ঘটানোর চেষ্টা করেছি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কুলা-ঢেঁকি-পাতার শব্দ। গ্রামীণ বাংলার চিত্র এখানে খুব সুন্দরভাবে উঠে এসেছে। দর্শক-শ্রোতাদের আমরা একটি ম্যাজিক্যাল অভিজ্ঞতা উপহার দিতে চেয়েছি।’
গানে জোহরা বাউলের অংশগ্রহণ ও তাঁকে নিয়ে গান গাওয়ানোর অভিজ্ঞতাটিও ছিল ভিন্ন রকমের। জোহরা বাউলের গানে অংশগ্রহণ নিয়ে জানান শিবু কুমার শীল।
‘আমরা প্রথমে অন্য একজন বাউলকে নিয়ে কাজটা এগিয়েছিলাম। শেষ পর্যন্ত তাঁকে নিয়ে কাজটা করা হয়নি। এর মধ্যে জোহরা বাউলকে পেলাম। কিন্তু জোহরাবু পড়াশোনা জানেন না। গানের কথাগুলো লিখে দিলে উনি যে দেখে দেখে গাইবেন—সেই উপায় নেই। তাই আমরা গানটি তুলে রেকর্ডকৃত অংশটুকু তাঁকে পাঠিয়ে দিই। গ্রামের মধ্যে কানে হেডফোন লাগিয়ে জোহরাবু সারাক্ষণ তা চর্চা করেছেন। তাঁর দৈনন্দিন কাজ করে গেছেন কিন্তু ঠোঁটে আর মনে ছিল সারা দিন এই গান। একদিন আমাকে ফোন দিয়ে জানালেন, তিনি পুরো অংশটুকু আয়ত্ত করে ফেলেছেন। সুরে সুরে আমাকে গেয়ে শোনালেন। সেদিন আনন্দে আমার চোখে পানি চলে এসেছিল। এত সুন্দর রপ্ত করেছেন তিনি তার অংশটুকু!’ নিজের আবেগ–ভালো লাগার কথা এভাবেই প্রকাশ করেন শিবু।
টিম ‘বনবিবি’ জানায়, আরও একজন মানুষ পুরো দলকে চমৎকৃত করে রেখেছেন সব সময়ই। তিনি হলেন মিথুন চক্রবর্তী। কাজপাগল এই মানুষ সারাক্ষণ সব জিনিস ঘেঁটে প্রাকৃতিক শব্দ বের করায় নিমগ্ন থাকতেন। ছোট থেকে ছোট বস্তুতে তিনি নানা রকম শব্দ করে দেখতেন। এরই মধ্যে কাজের নিমগ্নতায় তিনি বিড়ালের বর্জ্যও হাত দিয়ে ধরে ফেলে পুরো টিমকে মজার একটা স্মৃতি তৈরি করে দেন।
‘বনবিবি’র ভিজ্যুয়াল ডিরেক্টর কৃষ্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায় জানান, ‘মেঘদলের সঙ্গে কাজ করা আমার জন্য একটা ভালোবাসার বিষয়। আনন্দের বিষয়। কাজের শুরুতে সবাই মিলে পরিকল্পনা করি স্টুডিতেই একটা জঙ্গল বানানোর। প্রাণ-প্রকৃতির শিল্পী এস এম সুলতানের কাজের ধারা আমরা “বনবিবি”তে ব্যবহার করি। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রত্যেকে আমার দৃষ্টিতে ম্যাজিকের মতো কাজ করে গেছেন। মেঘদল, জোহরাবু, ঘাসফড়িং—সবাই মিলে যে ঘোর তৈরি করল, আশা করি, তাতে দর্শক-শ্রোতা বুঁদ হয়ে থাকবেন অনেক অনেক দিন।’